হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ : কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ‘ছাড়পত্র’ কবিতার এক জায়গায় লিখেছেন, ‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান; জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে, চলে যেতে হবে আমাদের। চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ শিশুর প্রতি মায়া-মমতা মিশ্রিত এবং তাদের প্রতি পৃথিবীর নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অনেক কবিই এমন কবিতা রচনা করে গেছেন। তাদের এই কবিতা রচনা না করলেও যে শিশুর প্রতি মানুষের ¯েœহ ও ভালবাসা এবং দায়িত্বের কোনো কমতি থাকত, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। শিশুদের ভালবাসে না- এমন মমতাহীন মানুষ খুব কমই রয়েছে। তারপরও কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় বারবার শিশু অধিকার ও তাদের প্রতি কী দায়িত্ব পালন করতে হবে তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে যেভাবে শিশুর প্রতি অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, কবি ও সাহিত্যিকদের এসব লেখা যথার্থ হয়ে উঠছে। সাধারণত কবি ও সাহিত্যিকদের অনেকটা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হতে হয়। আজ থেকে একশ বছর পর কী হবে বা হতে পারে, বর্তমানের উপর দাঁড়িয়ে তা বিবৃত করা দূরদৃষ্টি দিয়ে তাদের দেখতে হয়। এসব লেখাই কালজয়ী হয়ে উঠে। আবার কেউ কেউ মানুষ ও মানবিকতার প্রতি সবসময় দরদী হয়ে থাকার আহ্বানও জানান। মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াই হচ্ছে, শিশুর জন্ম। শিশুর জন্ম না হওয়া মানে মানবসভ্যতা থেমে যাওয়া। অথচ এই সভ্যতার ধারাবাহিকতা যেন আমাদের দেশের কিছু নরপশুরূপী মানুষ থামিয়ে দিতে চাইছে। তারা শিশুর প্রতি এতটাই অমানবিক হয়ে উঠছে যা দেখে মায়া-মমতাসম্পন্ন সভ্য মানুষকে শিউরে উঠতে হয়। ইতোমধ্যে আমরা কিছু নিষ্ঠুর ঘটনা অবলোকন করেছি। এসব ঘটনা সবারই জানা। আলোচিত এসব ঘটনা যে নীরবে-নিভৃতে ঘটে যাওয়া অনালোচিত শিশু নির্যাতনের মুখ হয়ে উঠেছে, তা বলা বাহুল্য। খুব বেশি আগে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। শিশু নির্যাতন ও নির্মূল করার ঘটনা যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা গত বছর ও এ বছরের চার মাসের চিত্র দেখেই বোঝা যায়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ২০১৫ ও এ বছরের প্রথম চার মাসে শিশু নির্যাতনের একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর ৭২৭ শিশু ধর্ষণ ও ২৯২ শিশু হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। এ বছরের প্রথম ৪ মাসে ধর্ষিত হয়েছে ১৩৮ এবং খুন করা হয়েছে ৯৫ শিশুকে। এ হার উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এর অর্থ হচ্ছে, নরপশুরূপী কিছু মানুষ মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার ধারক-বাহক এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যেন রুখে দিতে চাইছে। এই পশুসদৃশ মানুষকে কোনভাবেই যেন নিবৃত করা যাচ্ছে না। মাংসাশী পশু যেমন তার চেয়ে দুর্বল প্রজাতিকে আহার হিসেবে শিকার করে, ঠিক তেমনি কিছু নরপশু সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণীর উপর তাদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে চলেছে। ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে লোমহর্ষক পন্থায় মেরে ফেলছে। কেবল খুন-ধর্ষণের শিকার বাবা-মায়ের হাহাকারের চিত্র আমরা অহরহ দেখছি। নরপশুদের বিচার দেখছি না। ঘাতকরা সমাজের রীতিনীতি-নৈতিকতা এবং মানবিকতাকে যে পদদলিত করে চলেছে এ নিয়ে সামাজিক প্রতিরোধ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও তেমন কোনো কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে শিশু নিধন চলছে এবং বাবা-মায়ের বুক খালি হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া হয়, শিশুর অভিভাবক শুধু তার মা-বাবাই নন, সমাজের সকলেই তার অভিভাবক। প্রত্যেক শিশুকেই তার নিজের সন্তান হিসেবে গণ্য করা হয়। এই মূল্যবোধ যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে। তা না হলে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে কিভাবে শিশুদের প্রাণ হরণ করা হয়! কেন এই চিলকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারছি না?
দুই.
শিশু নির্যাতন ও খুন-ধর্ষণের এই চিত্রের পাশাপাশি আমরা বাবা-মা কর্তৃক সন্তানের প্রতি উদাসীনতার আরেকটি চিত্রও বেশ উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ্য করছি। সম্প্রতি একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল ফোন, টেলিভিশনের আসক্তির কারণে শিশুরা দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে। সময়ের আগেই তাদের চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা উঠছে। দীর্ঘ সময় চোখের সামনে রেখে শিশুদের কম্পিউটার, ট্যাব বা মোবাইলে গেমস খেলার কারণে তাদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হাসপাতালটিতে মাসে ৩ হাজার ৭০০ শিশু আসে। এদের ৭০ শতাংশ দূরের জিনিস দেখতে পায় না। এর অধিকাংশ কারণ শিশুদের কম্পিউটার, ট্যাব ও মোবাইলে দীর্ঘ সময় ধরে একদৃষ্টিতে গেমস খেলা। চক্ষু বিষেশজ্ঞরা একে অত্যন্ত ‘অ্যালার্মিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এমন ধারণা পোষণ অমূলক হবে না, অভিভাবকরা যেন জেনেবুঝে একটি ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন ও অন্ধ প্রজন্ম সৃষ্টি করে চলেছে। শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ এবং সুস্থ ও শক্তিশালী প্রজন্ম গড়ে তোলার বিষয়টি উপেক্ষা করে চলেছে। একদিকে দুর্বৃত্ত কর্তৃক শিশুদের নির্যাতন অন্যদিকে অভিভাবকদের অসচেতনতা- এই উভয় সংকটে পড়ে শিশুরা এক চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, শিশুদের দিকে অভিভাবকসহ সমাজের সচেতন শ্রেণীর তেমন কোনো নজর নেই। এক ধরনের অবহেলা ও উদাসীনতা তাদের মধ্যে কাজ করছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যে সঠিক যতœ নেয়া ও গড়ে তোলা প্রয়োজন, এ বোধ যথাযথভাবে কাজ করছে না। যদি করতো তাহলে শিশুদের প্রতি নির্মম আচরণ হতো না। শিশু নির্যাতনের পরিসংখ্যানও এতো ভয়াবহ হতো না। বলাবাহুল্য, বাইরের দুর্বৃত্ত শ্রেণীর নিষ্ঠুরতা থেকে অভিভাবকরা যেমন তার সন্তানকে রক্ষা করতে পারছেন না, তেমনি ঘরের ভেতরও তাদের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত রাখতে পারছেন না। তবে এ কথা মানতেই হবে, অভিভাবকদের এমন আচরণের অন্যতম কারণ নিরাপত্তা। সন্তানকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে যে তারা নিরাপদবোধ করবেন, এ নিশ্চয়তা তারা পাচ্ছেন না। খেলাধুলার জন্য ঘরের বাইরে পাঠানোর মতো নিরাপত্তা এখন নেই বললেই চলে। এর উপর পর্যাপ্ত মাঠ এবং উন্মুক্ত জায়গারও অভাব রয়েছে। বিনোদনের জন্য সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে সন্তানদের অনেকটা ঘরবন্দি করে রাখতে হচ্ছে। তাদের হাতে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব, মোবাইল তুলে দিতে হচ্ছে। এভাবেই শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বীজ বপিত হচ্ছে। একনাগাড়ে গেমস খেলতে গিয়ে তারা দৃষ্টিশক্তি হারাচ্ছে আবার কোনো ধরনের নড়াচড়া না করায় তাদের শারীরিক সক্ষমতাও হ্রাস পাচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শহরের শিশুদের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ স্থূল হয়ে পড়ছে। এর মূল কারণ তাদের খেলাধুলার সুযোগ না থাকা। স্থ’ূলাকৃতি হওয়ার এই প্রবণতায় শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে শহরের কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইলের মাধ্যমে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের সমস্যা। চিকিৎসকরা এই সমস্যাকে ‘কম্পিউটার ভিশন সিনড্রম’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ রোগে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একে ‘মাইয়োপিয়া’ বলা হয়। এতে শিশুরা চোখে ঝাপসা দেখা, চোখ পিটপিট করা ও মাথাব্যথায় আক্রান্ত হয়। চিকিৎসকরা বলেন, শিশুরা যখন খুব কাছ থেকে এসব যন্ত্র ব্যবহার করে তখন চোখের মণি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। চোখের পাতা পড়ে না। পাতা পড়লেও চোখের ভেতরের পানি চোখের মণিকে আর্দ্র করে ফেলে। পাতা না ফেললে কর্ণিয়ার যে পানি তা বাতাসে মিলিয়ে যায়। এই পানির অভাবে শিশুরা অনবরত চোখ পিটপিট করে। তাদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পেতে শুরু করে। এজন্য চিকিৎসকরা বলেন, দৃষ্টিকে একদিকে নিবদ্ধ রাখলে হবে না। দূরে তাকাতে হবে। আগের দিনে দাদি-নানিরা দূরের দিকে তাকিয়ে সবুজ দেখতে বলতেন। এর কারণ দৃষ্টি প্রসারিত করা এবং চোখের বিশ্রাম দেয়া। এতে চোখের ব্যায়াম হয়, দৃষ্টিশক্তিও স্বাভাবিক থাকে। এ সময়ে এসে বাবা-মায়েরা এ বিষয়গুলো বেমালুম হয়ে গেছেন। উল্টো কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে শিশুদের চোখের বারটা বাজিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শও মানছেন না। তারা মনে করছেন, সন্তানের ফ্রেন্ডসার্কেলে গেমস নিয়েই গল্প হয় বেশি। তাই সন্তানকে যদি কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইল না দেয়া হয়, তবে তো পিছিয়ে যাবে! অনেক অভিভাবকের এই মানসিকতা যে সন্তানের কত বড় ক্ষতি করে চলেছে, তা তারা বুঝতেই পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না। সন্তানকে যে ধীরে ধীরে অন্ধত্বর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন এ বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন না। চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের ৭০ শতাংশ কারণ হচ্ছে এই কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইলে একদৃষ্টিতে গেমস খেলা। এ পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে পরিবার তো বটেই জাতির সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও মারাত্মক ক্ষতিকর। এ যেন চোখ থাকিতে অন্ধের দিকে ধাবিত হওয়া। অভিভাবকরা এ কথা বুঝতে পারছেন না, অন্ধ ব্যক্তি শক্তি ও সামর্থ্যে যতই সক্ষম হোক না কেন, দৃষ্টিশক্তি না থাকায় তার কোনো মূল্যই থাকে না।
তিন.
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত, পড়াশোনার বাইরে শিশুরা দল বেঁধে মাঠে-ময়দানে যাবে, খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করবে, এটা আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক চিরায়ত প্রথা। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক গঠন দৃঢ় হওয়া থেকে শুরু করে শিশুদের সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। গ্রামগঞ্জে এই ধারা বজায় থাকলেও শহুরে সমাজ থেকে প্রায় উঠে গেছে। শহরে বসবাসকারী অভিভাবকরা সন্তানদের ঘরবন্দি করে রাখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর ফলে শহরের শিশুদের অনেকে ফার্মে লালিত-পালিত শিশু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কয়েক দিন আগে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন দুটি ছবি পাশাপাশি দিয়ে মন্তব্য করেন ‘দেশি’ ও ‘ফার্ম’-এর শিশু। দেশি চিত্রে দেখা যায়, গ্রামের একদল উলঙ্গ শিশু পুকুরের পাড়ের গাছের উপর থেকে অসীম সাহসে নির্দ্বিধায় ডিগবাজি দিয়ে লাফিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে। ফার্ম চিত্রে দেখা যায়, একদল শিশু শহরের আধুনিক সুইমিংপুলের পাশে শর্টপ্যান্ট পরে লাফ দেবে কি দেবে না এমন দ্বিধা ও শংকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাফ দিতে সাহস পাচ্ছে না। বলাবাহুল্য, গ্রামের শিশুরা মাঠে-ময়দানে দৌড়াদৌড়ি করার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা পায়। খেলাধুলা ও ছোটাছুটি করতে গিয়ে পড়ে ব্যথা পায়, আবার উঠে দাঁড়ায়। এভাবে তারা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে দৃঢ়ভাবে গড়ে উঠে। অন্যদিকে শহরের শিশুদের এ সুযোগ যেমন নেই, তেমনি পর্যাপ্ত নিরাপত্তাও নেই। ফলে প্রযুক্তির উৎকর্ষ দিয়েই তাদের ঘরে থাকতে বাধ্য করছে। যদি খেলাধুলার যথেষ্ট সুযোগ ও নিরাপত্তা থাকত তবে তাদের জন্য ক্ষতিকর কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবাইল থেকে অনেকখানি দূরে রাখা সম্ভব হতো। দুঃখের বিষয়, আমরা কেবল নিরাপত্তাহীনতা ও শিশুর ক্ষতিকর দিকটি অবলোকন করছি, এ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় ও উদ্যোগ নিচ্ছি না। এটাও লক্ষ্যণীয়, অভিভাবকের তার সন্তানকে যে পরিমাণ সময় দেয়া প্রয়োজন তা তারা দিচ্ছেন না। অনেকে সময় দিতে পারলেও সন্তানকে বড় করার যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন না। অনেকে আবার প্রযুক্তিকে আভিজাত্যের লক্ষণ মনে করেন। তারা টেলিভিশন ছেড়ে বা সন্তানের হাতে ট্যাব, মোবাইলে গেমস খেলতে দিয়ে খাওয়ান। এটাও দেখা যায়, পড়াশোনায় সন্তানকে প্রথম করার প্রতিযোগিতায় অভিভাবকরা লিপ্ত হয়ে সন্তানের উপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ করেন। অভিভাবক বিশেষ করে মায়েদের এ ধরনের আচরণকে ‘টাইগার মাম অ্যাটিচ্যুড’ বলা হয়। এই আচরণের কারণে সন্তানের মানসিক ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এসবই যে সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুষমভাবে বেড়ে উঠার অন্তরায় তা বিশ্লেষকরা একমত প্রকাশ করেছেন। এ কথাও অস্বীকারের উপায় নেই, পাড়া-মহল্লায় শিশুদের খেলাধুলা করার মতো যথেষ্ট সুযোগ নেই। তারা যে ছুটির দিনে বা বিকেলে দল বেঁধে মাঠে খেলতে যাবে এ ধরনের মাঠ ও খোলা জায়গা অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়েছে। মাঠ-ময়দানে বাড়িঘর তুলে একদিকে খেলাধুলার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে অন্যদিকে দৃষ্টিকে সীমিত করে ফেলা হয়েছে। যেদিকে তাকানো যায়, কেবল ইট-পাথরের দেয়াল ছাড়া কিছু দেখা যায় না। দূরের কোনো মাঠে যে সন্তানকে খেলতে পাঠাবে, নিরাপত্তার অভাবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। অথচ আগে প্রায় প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় একাধিক মাঠ ও খোলা জায়গা ছিল, যেখানে একসাথে অনেক শিশু খেলাধুলা করতে পারত। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি সব মাঠ ও খোলা জায়গায় বাসস্থান বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের কথা কেউ চিন্তাই করছে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ‘একটি বাসযোগ্য পৃথিবী’ রেখে যাব বলে সুকান্ত যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন তা না করে দেখা যাচ্ছে, ‘বাঁশডলা’ দিয়ে শিশুদের ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলছে। তাদের ঘরবন্দি করে রাখা হচ্ছে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলা হচ্ছে।
চার.
শিশু নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টি আমরা কতজন নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করি, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ রয়েছে। শিশু নির্যাতন বা হত্যার বিষয়টিকে কেউ বড় করেও দেখছে না। শিশুরা ছোট বলে চোখে পড়ছে না বা শিশু হত্যা করলে তেমন কোনো ক্ষতি নেই- এমন মানসিকতা প্রতীয়মাণ হচ্ছে। এ ধরনের সিডেটিভ মাইন্ড বা অবশ হয়ে পড়া মানসিকতা খুব বেশি চোখে পড়ছে। এমনকি যে নরপশু আরেক জনের সন্তানকে নির্যাতন ও হত্যা করার সময় নিজের সন্তানে বা ছোট ভাইবোনের কথা একবারের জন্যও মনে করে না। এ ধরনের মানবিক গুণাবলীশূন্য নরপশুদের ধরে যদি দ্রুত শাস্তি এবং একের পর এক শাস্তি দেয়ার নজির সৃষ্টি করা না যায়- তবে শিশু নির্যাতন ও হত্যা কোনভাবেই বন্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সর্বাধিক। কারণ শিশুরাই একদিন রাষ্ট্রের হাল ধরবে। সমাজ ও পরিবারের অভিভাবকদেরও রাষ্ট্রের আগে দায়িত্ব পালন করতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে সন্তানের চেয়ে পৃথিবীতে মূল্যবান আর কিছু নেই। এই মূল্যবান ধন তাদেরই যক্ষের মতো আগলে রাখতে হবে। তাদের যথাযথ যতœ নিতে হবে। সুষমভাবে গড়ে তোলার জন্য পারিবারিক মূল্যবোধ, নীতিনৈতিকতা এবং নিয়মানুবর্তিতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব ও মোবইল, অনেক রাতে ঘুমাতে যাওয়া, খুব সকালে ঘুমকাতুরে চোখে সন্তানকে উঠিয়ে অনেকটা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার জীবন চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বুঝতে হবে সন্তানের সাময়িক বিনোদন এবং আধুনিকতার প্রতিযোগিতায় শামিল করতে গিয়ে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ঠেলা দেয়া হচ্ছে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় শিশুদের সুরক্ষায় আমাদের প্রত্যেকের মানবিকবোধ সদা জাগ্রত রেখে রক্ষাব্যূহ গড়ে তুলতে হবে। যেখানেই শিশু নির্যাতন হয় সেখানেই প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করতে হবে। শিশুদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার আমাদের যে চিরায়ত মূল্যবোধসম্পন্ন রীতি রয়েছে তা অনুসরনে মনোযোগী হতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।