Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানি দূষিত করা অমার্জনীয় অপরাধ

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন : আর তিনিই (আল্লাহ) মানুষকে পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা ফুরকান ২৫ : ৫৪)। শুধু মানুষ নয়, গোটা জীবজগৎ তিনি সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : আল্লাহ পানি থেকে সমস্ত জীব সৃষ্টি করেছেন। (সূরা নূহ ২৪ : ৪৫)। এও বলা আবশ্যক, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির আগে আল্লাহপাক পানি সৃষ্টি করেছিলেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে : যখন আরশ পানির ওপর ছিল তখন তিনিই আকাশ ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা হুদ ১১ : ৭)।
পানি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠতম নিয়ামতগুলোর একটি। আমরা যাকে পৃথিবী বলে জানি, তার চার ভাগের তিন ভাগেই রয়েছে পানি। এই পানিরাশির অধিকাংশই অপেয়, লবণাক্ত। তবে অপবিত্র নয়। সব পানিই পবিত্র এবং পবিত্রতার জন্যও পানি অপরিহার্য। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি রাসূল সা.-এর কাছে সাগরের পানি দিয়ে অজু করা যাবে কি না জানতে চান। জবাবে রাসূল সা. বলেন : সাগরের পানিও পবিত্র। আল্লাহপাক আসমান থেকে যে পানি বর্ষণ করেন, তা পবিত্র ও বিশুদ্ধ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন : আমি আসমান থেকে বিশুদ্ধকারী পানি অবতীর্ণ করেছি। (সূরা ফুরকান ২৫ : ৪৮)।
আকাশ থেকে পবিত্রতা অর্জনের জন্যই কেবল আল্লাহ পানি বর্ষণ করেন না, আরো নানা কারণে তিনি পানি বর্ষণ করেন। মানুষ ও জীবসমূহের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য যেমন পানি প্রয়োজন, তেমনি তাদের খাদ্যসংস্থানের জন্যও পানির অপরিহার্যতা প্রশ্নাতীত। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন; এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয়। আর তার থেকে গাছপালা জন্মায় যাতে তোমরা পশুচারণ করে থাকো। তিনি তোমাদের জন্য তা দিয়ে শস্য জন্মান, জায়তুন : খেজুর, আঙ্গুর, আর সব রকম ফল। (সূরা নাহল ১০ : ১১)।
সূরা আবাসার ২৪-৩২ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক (কেমন করে) আমি প্রচুর পানি বর্ষণ করি, তারপর ভূমিকে বিদীর্ণ করি এবং তার মধ্যে উৎপন্ন করি শস্য, আঙ্গুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, গাছ-গাছালির বাগান, ফল ও গবাদিখাদ্য। এ তোমাদের ও তোমাদের গবাদি পশুর উপভোগের জন্য।
যে পানি আল্লাহতায়ালা মানুষ ও জীবসমূহের পানের জন্য, পবিত্রতার জন্য, খাদ্যসংস্থানের জন্য সৃষ্টি করেছেন, সংরক্ষণ করেছেন এবং বর্ষণের মাধ্যমে প্রেরণ করে থাকেন, তার প্রকৃতি ও বিশুদ্ধতা রক্ষা করা মানুষের অনিবার্য দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আল্লাহর খলিফা হিসেবে এ দায়িত্বে অবহেলা করা কিংবা দায়িত্ব পালন না করার সুযোগ মানুষের নেই। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, মানুষ এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না। করছে না বলেই বিশ্বে পানযোগ্য বিশুদ্ধ পানির ভয়াবহ সঙ্কটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি পানযোগ্য বিশুদ্ধ পানির জন্য ভবিষ্যতে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাগর-মহাসাগরে পানির অভাব নেই; কিন্তু তা পানের উপযোগী নয়। নদী-নালা, খালবিলসহ মিঠাপানির প্রাকৃতিক উৎসসমূহ মারাত্মক দূষণের শিকার। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতও আর আগের মতো সব জায়গায় হচ্ছে না। যা হচ্ছে, তার বেশির ভাগ সাগরে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মিঠাপানির সঙ্কট ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠছে। পানযোগ্য ও বিশুদ্ধ পানির আকাল হলে মানুষ ও জীবসমূহের অস্তিত্ব ও খাদ্য সংস্থান যে ভয়ঙ্কর ঝুঁকির মধ্যে পড়বে, তা বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশ মিঠাপানির প্রাচুর্যের দেশে হিসাবে খ্যাত। এখানে শত শত নদী আছে, অসংখ্য খাল-বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড় ও জলাশয় আছে। উপরন্তু এখানে প্রতি বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ভারতের পানি রাজনীতির কারণে এখানকার নদীগুলোর অস্তিত্ব আজ বিপন্নপ্রায়। ইতোমধ্যে কয়েকশ’ নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। বেঁচে থাকা নদীগুলোও মরো মরো। নদীর পানিশূন্যতার বিরূপ প্রভাব অন্যান্য উৎসেও দৃশ্যমান। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, নদীসহ পানির প্রাকৃতিক উৎসগুলো ব্যাপক দখল ও দূষণের শিকার। বলতে গেলে কোনো উৎসেই পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন নেই।
নদী-খাল-বিল এবং সব রকমের জলাশয় হয়ে পড়েছে মারাত্মক দূষণের শিকার। শিল্প-কারখানার বর্জ্য, মানববর্জ্য ও জীবজন্তুর বর্জ্যে রীতিমতো ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে পানির এসব প্রাকৃতিক উৎস। এতে পানির রঙ বদলে গেছে, বদলে গেছে গন্ধ ও স্বাদ। অনেক নদীতে মাছ ও জলজপ্রাণী পর্যন্ত থাকতে পারে না। পানি দূষণের কারণে পানযোগ্য, ব্যবহারযোগ্য পানির ব্যাপক সঙ্কটই দেখা দেয়নি, সেই সঙ্গে মানুষের মধ্যে রোগব্যাধির বিস্তার বেড়ে গেছে এবং কৃষিসহ সফল উৎপাদন ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে।
নদী দখল ও পানি দূষণ রোধের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে লাগাতার তাকিদ দেয়া সত্তে¡ও দখল ও দূষণ বন্ধ হচ্ছে না। এক শ্রেণীর মানুষের লোভের কাছে এবং তাদের অসতর্কতা ও অসচেতনতার কারণে পানি দূষণ বেড়েই চলেছে। এর পরিণতি এখন যেমন ভোগ করতে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো বেশি করে ভোগ করতে হবে, যদি এ অবস্থা অব্যাহত থাকে।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে পানির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথাই বর্ণনা করা হয়নি, পানিকে দূষিত করা, অপবিত্র করা এবং অপচয় করাও বারণ করা হয়েছে। রাসূল সা. পানিকে অপবিত্র করতে নিষেধ করেছেন, নিষেধ করেছেন অপচয় ও অপব্যবহার করতে। কোনো পানির রঙ, গন্ধ ও স্বাদ যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে সে পানি আর বিশুদ্ধ ও পবিত্র থাকে না। এ ধরনের পানি পান ও ব্যবহার করা বৈধ নয়।
যেকোনো উৎসের পানিকে দূষণ থেকে সুরক্ষা করা, বিশুদ্ধ ও পবিত্র রাখা মানুষেরই দায়িত্ব। যারা প্রতিনিয়ত পানিকে দূষিত, অপবিত্র এবং পান ও ব্যবহার-অযোগ্য করে তুলছে তারা গুরুতর অপরাধ করছে। তাদের এ অপরাধ অমার্জনীয়। তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এই জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা সর্বপ্রকারের পানি দূষণ থেকে বিরত থাকে।



 

Show all comments
  • মোঃ এনায়েত উল্লাহ্‌ ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৫ এএম says : 0
    আপনি কি জানেন, ছিদ্রযুক্ত কল বা নল দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে একটি করে পানির ফোঁটা পড়লে প্রতি বছর ২ হাজার ৭০০ গ্যালন পানির অপচয় হয়? টয়লেট একবার ফ্লাশ করলে ৩ গ্যালন পানি খরচ হয়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের প্রতিজন প্রতিদিন সেই একই পরিমাণ পানি দিয়ে জীবন ধারণ করে।
    Total Reply(0) Reply
  • হাসিবুল ইসলাম ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৬ এএম says : 0
    ইসলামে পানি সংরক্ষণের গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনায় স্বভাবতবই আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যেমন ইসলামে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব; জীবনের জন্য নদনদী ও সমুদ্রের প্রয়োজনীয়তা; পানি রক্ষণাবেক্ষণ ও তা দূষণমুক্তকরণ; পানি ব্যবহারে অপচয় রোধে ইসলাম ইত্যাদি।
    Total Reply(0) Reply
  • হাসিবুল ইসলাম ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৬ এএম says : 0
    মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তায়ালা পানিকে পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। অজু, গোসল ও ইবাদত পানি ছাড়া কল্পনা করা যায় না। এ থেকেই পানির স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা রক্ষার প্রতি ইসলাম কতখানি গুরুত্ব দিয়েছে অনুধাবন করা যায়।
    Total Reply(0) Reply
  • মিরাজ মাহাদী ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৬ এএম says : 0
    পানি ছাড়া এ পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। আর এসব নদনদী ও সমুদ্র হলো এই পানির উৎস। আল্লাহ তায়ালা সমুদ্র ও নদীনালার পানি দ্বারা উপকৃত হতে তা মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন। এ নদীনালা, খালবিল ও সমুদ্রের মাছ না হলে তো পৃথিবীর খাদ্যাভারেই রাতারাতি টান পড়ে যাবে। তাছাড়াও এ সমুদ্রগর্ভে লুকিয়ে রয়েছে আমাদের জন্য অফুরন্ত প্রাচুর্য ও সম্পদ। আল্লাহ তায়ালা এ নেয়ামতের প্রতি কোরআনের বহু আয়াতে গুরুত্বারোপ করেছেন। যেমন তিনি মানুষকে পানির কোনো প্রকার অপচয় না করে রক্ষণাবেক্ষণ করতে ও তা থেকে উপকৃত হতে আহ্বান করেছেন।
    Total Reply(0) Reply
  • স্বদেশ আমার ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৭ এএম says : 0
    ‘আর আল্লাহ তায়ালা আসমান থেকে বারি বর্ষণ করেন অতঃপর তা দ্বারা জমিনকে পুনর্জীবিত করেন।’ (সূরা বাকারা : ১৬৪)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর আমি পানি দ্বারা সব জীবনকে সংরক্ষণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ৩০)।
    Total Reply(0) Reply
  • মাওলানা রূহুল আমীন'সানী' ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ১:২৭ এএম says : 0
    কোরআনের বহুসংখ্যক আয়াতে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আকাশ থেকে বর্ষিত পানির একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতি রয়েছে। তা নির্মল, বিশুদ্ধ ও সুপেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাদের পান করাই সুপেয় পানি।’ (সূরা মুরসালাত : ২৭)।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন