বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
‘মিসওয়াক’কে লাঠি ভেবে ভীত অবরুদ্ধ শত্রুদের দুর্গ খুলে দেয়ার ঘটনাকে ইসলামী সুন্নতের প্রভাব, এমনকি ‘মোজেযা’ বলেও আখ্যায়িত করা যায়। ‘আল্লাহু আকবার’, ‘আজান’ এবং ‘কলেমা তাইয়্যিবা’ ধ্বনি শুনলে অথবা জনমানবহীন স্থানে কলেমা লিখিত ইসলামী পতাকা দেখে শত্রু বাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ার নানা কাহিনী রয়েছে। ইসলামী সুন্নতের প্রতীক ‘মিসওয়াক’ এর ক্ষুদ্র কাঠের টুকরাকে লাঠি তথা ভয়ঙ্কর অস্ত্র মনে করে তাদের মধ্যে পলায়নপ্রবণতা বিদ্যমান থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আর যারা মুসলমান হয়ে ‘মিসওয়াক’কে অবমাননা করে, বিদ্রুপ করে তাদের শোচনীয় পরিণতির ঘটনাও ইতিহাসে রয়েছে। মসজিদের চালায় সাধকের ‘মিসওয়াক’ থাকায় মসজিদে জি¦নের উৎপাত বন্ধ হওয়ার ঘটনার কথাও জানা যায়। তবে এ পর্যায়ে আমরা দুই শতাধিক বছর আগের ভূপালের ন্যায় একটি প্রাচীন রাজ্যের সুন্নতে রাসূল সা. প্রেমিক প্রধানমন্ত্রীর কাহিনীটি তুলে ধরছি।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ভূপালে লাগাতার সোয়াশ’ বছর নারী রাজত্ব কায়েম ছিল এবং তারা ছিলেন সবাই পর্দানশীল মহিলা। চারজনের মধ্যে দ্বিতীয় রাণীর নাম ছিল নবাব সেকান্দার বেগম। খোদাপ্রদত্ত শক্তিতে বলিয়ান এই রাণী ছিলেন রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত দক্ষ। তার যোগ্যতা-প্রতিভার কথা ইংরেজ সরকারকেও বারবার স্বীকার করতে হয়েছে। সেকান্দার বেগমের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মুনশী জামাল উদ্দীন খান। তার কথাই আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়।
দুই শতাব্দী কালেরও আগে মুনশী জামাল উদ্দীন খানের জন্ম হয় দিল্লির নিকটবর্তী একটি কসবায়। এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণকারী জামাল উদ্দীন খান ফারসি ও আরবি বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিজ এলাকায় লাভ করার পর দিল্লিতে চলে যান এবং সেখানে হজরত মওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের দরসে যোগদান করেন এবং তার কাছ থেকে হাদীসের সনদ লাভ করেন। তিনি ছিলেন সে সময়কার সেরা মোহাদ্দেস।
জামাল উদ্দীন খান ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করার পর জীবিকা নির্বাহের তাগিদে চাকরির তালাশ করতে থাকেন। কোনো না কোনো মসজিদে ইমামতি করার সুযোগ থাকলেও তিনি ইমামতিকে জীবনযাপনের উপায় হিসেবে অবলম্বন করা পছন্দ করতেন না। ইংরেজদের আগ্রাসী তৎপরতা ও মুসলিমবিরোধী কার্যকালাপকে তিনি শুরু থেকে ঘৃণা করতেন। তাই তিনি সরকারি চাকরির পরিবর্তে অন্যত্র কয়েকটি স্থানে ব্যর্থ চেষ্টা করেন। অবশেষে তিনি ভূপালে চলে যান।
অনেক দিন পর সেখানে একটি দপ্তরে সাধারণ চাকরি হয় তার এবং ধাপে ধাপে উন্নতি করে তিনি অফিসারের পদ লাভ করেন। অত:পর ‘নায়েবে উজির’ পদে উন্নীত হন। তখন রাজ্যের প্রধান ছিলেন (রাণী) নবাব সিকান্দার বেগম। তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে জামাল উদ্দীন খানের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং তার অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর পদটি খালি হওয়ার পর নবাব সিকান্দার বেগম জামাল উদ্দীন খানকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। এভাবে তিনি ভূপাল রাজ্যের সর্বাধিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।
ভূপালের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশ ও জনগণের স্বার্থে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেন এবং নানা সংস্কার আনয়ন করেন। প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দীন খান ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বহু গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি সর্ব প্রথম কোরআনের পশতু ভাষায় অনুবাদ করান। বঞ্চিত মুসলমানদের দ্বীনি শিক্ষার জন্য তিনি একটি বিশাল মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদ্রাসায় বিনা বেতনে শিক্ষা এবং ছাত্রদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও বই পুস্তক ও বৃত্তি প্রদানসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। শিক্ষক হিসেবে দেশের বাইরে হতে খ্যাতনামা আলেমদের নিয়োগ করেন। শিক্ষা শেষে ছাত্রদের সরকারি দপ্তরসমূহে চাকরির ব্যবস্থা করেন।
অপরদিকে ইউরোপের খ্রিষ্টান মিশনারীদের মুসলমানদের খ্রিষ্টান বানানোর অপতৎপরতা এবং অন্যান্য সমাজের ইসলামবিরোধী শুদ্ধি অভিযান ইত্যাদি ছাড়াও ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার প্রতিরোধকল্পে জামাল উদ্দীন খান নানা বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজ্যে তিনি ইসলামী সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর রাজকীয় শান-শওকত বর্জন করে সহজ-সরল পদ্ধতি চালু করেন এবং ব্যায়বহুল জীবন পরিহার করেন। তিনি বাক-স্বাধীনতা প্রদান করেন, যে কেউ সত্য প্রকাশে স্বাধীন ছিল।
ব্যক্তি জীবনে জামাল উদ্দীন খান ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক। তিনি জমাতে নামাজ আদায় করতে অভ্যস্ত ছিলেন। কখনও একটি মসজিদে জামাত না পেলে অন্য মসজিদে চলে যেতেন। এভাবে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যেতেন এবং কোনো এক মসজিদে জামাত পেয়ে যেতেন। কখনও যদি মুসলমানদের কোনো বিজয় অর্জন ও দুর্গ দখলে বিলম্ব ঘটত, তখন তিনি তাৎক্ষণিক পরামর্শ সভা ডাকতেন এবং সর্ব প্রথম এই বিষয়টির আলোচনা করা হত যে, তাদের মধ্যে কে কোন ফরজ অথবা সুন্নত ‘তরক’ করেছে। জামাত ও ইসলামী সুন্নতের প্রতি এরূপ অনুসরণের দৃষ্টান্ত মুসলিম শাসকদের ইতিহাসে তেমন দেখা যায় না।
ভ‚পালের প্রধানমন্ত্রী জামাল উদ্দীন খানের রাষ্ট্রীয় জীবনের একটি বিস্ময়কর ঘটনা এই যে, তিনি একবার জানতে পারেন যে, সৈন্যরা নামাজের পূর্বে ‘মিসওয়াক’ করছে না। রাতেই তিনি সকলকে ‘মিসওয়াক’ করার নির্দেশ দিলেন। সকালে ফজরের নামাজের পূর্বেই সকল সৈন্য জঙ্গলের দিকে দৌড়াতে লাগল এবং ছোট বড় যার হাতে যে ডালি পড়ে তা দ্বারা ‘মিসওয়াক’ করতে আরম্ভ করে।
একদিকে এ সুন্নত আদায় হচ্ছিল, অপরদিকে আল্লাহতায়ালা দুর্গে অবরোধকারী শত্রু বাহিনীদের মধ্যে এই ধারণা সৃষ্টি করে দেন যে, মুসলমানগণ মানুষ নন জি¦ন। গাছগুলো চাবিয়ে খাচ্ছে, এবার হয়তো আমাদেরকে চাবিয়ে খাবে। এই ভয়ের এমন প্রভাব হয় যে, তারা দ্রুত দুর্গের দ্বার খুলে দিতে বাধ্য হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।