বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
গত ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলায় মৃতের সংখ্যা ৪০০-এর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। হামলায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে, যাদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। গোটা শ্রীলঙ্কা এখন শোকে স্তব্ধ। শোকের ছায়া বিস্তৃত হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়াসহ সারা বিশ্বে। দক্ষিণ এশিয়ায় এক দশকের মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাণহানিকর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা।
হামলার প্রকৃতি দেখে এটা একক গোষ্ঠীর হামলা বলেই প্রতীয়মান হয়। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে আন্তর্জাতিক শক্তির যোগসাজশ আছে বলেও এখন বলা হচ্ছে। শুরুতে হামলার দায় কেউ স্বীকার না করলেও পরে আইএস দায় স্বীকার করেছে। দেখা যাচ্ছে, অঙ্গুলি মুসলমানদের দিকেই উত্থিত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কারা এই হামলাকারী তা নিয়ে তদন্ত চলছে। নির্মোহ ও সঠিক তদন্ত হলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে বলে আশা করা যায়।
হামলাকারী যারাই হোক, তারা যে মানবতাবিরোধী, সভ্যতাবিরোধী এবং ধর্মবিরোধী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানবতার সকল মাপকাঠি, সভ্যতার ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এবং সকল ধর্মের মূল্যবোধ মানুষ হত্যার বিরোধী। সুতরাং যারাই এই সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে, তারা মনুষ্য পদবাচ্য হওয়ার সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। তারা পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট। তাদের নির্মূলকরণ ছাড়া বিকল্প নেই।
এ দিকে গত ২৫ এপ্রিল প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, সউদী আরবে এক দিনেই ৩৭ জন কট্টরপন্থীকে শিরশ্চেদ করা হয়েছে। সউদী প্রেস এজেন্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদ এবং দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার অভিযোগে তাদের শিরশ্চেদ করা হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত রোববার সউদী আরবের রাজধানী রিয়াদে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস হামলার ঘটনা ঘটাল। অনেক দেরি হয়ে গেলেও সন্ত্রাস ও চরমপন্থার অনুসারীদের বিরুদ্ধে এমন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অনেকের মতে ইতিবাচক এবং সউদী রাজ প্রশাসনের বোধোদয়ের উল্লেখযোগ্য নজির।
স্মরণ করা যেতে পারে, সউদী আরবভিত্তিক ওয়াহাবী-ইজম বা সালাফী-ইজম অত্যন্ত রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থী এক মতবাদ। গোটা বিশ্বে ইসলামের নামে উগ্রবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী উদ্ভাবের পেছনে এই ওয়াহাবী-ইজম বা সালাফী-ইজমের বিশেষ ভ‚মিকা রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
সাম্প্রতিক কয়েক বছর হলো এই রক্ষণশীল ও কট্টরপন্থী মতাদর্শের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সউদী আরব সরকার। খবরে প্রকাশ, এই মতাদর্শের উদ্ভব ও প্রসারের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিচক্রের ইন্ধন, মদদ ও সহযোগিতা ছিল এবং এখনো আছে। ইসলামকে হেয়প্রতিপন্ন করা এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ-সঙ্ঘাত সৃষ্টি ও অব্যাহত রাখাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিচক্রের মূল লক্ষ্য।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আলকায়েদা, আইএস প্রভৃতি সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলাম ও মুসলমানদের যত ক্ষতি করেছে, সাম্প্রতিককালে আর কেউ তা করতে পারেনি। তাদের সন্ত্রাসী হামলায় যত মানুষ হতাহত হয়েছে, পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, তাদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যায় বেশি।
ইসলাম অর্থই শান্তি। বিশ্বে শান্তি, শৃঙ্খলা, সৌহার্দ্য, সুষ্ঠু সহাবস্থান নিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য এবং মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ইসলামে সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার কোনো স্থান নেই। বিশৃঙ্খলার কোনো প্রশ্রয় নেই। ইসলাম বিনা কারণে মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন- এই কারণেই বনি ইসরাইলিদের এই বিধান দিলাম, নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করার কারণ ব্যতীত যদি কেউ কাউকে হত্যা করে তবে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল। যদি কেউ একটি প্রাণ রক্ষা করে তবে সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।
অতঃপর যদিও তাদের কাছে আমার রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছিল, এরপরও তাদের মধ্যে অনেকেই সীমালঙ্ঘনকারী থেকে গেছে। (সূরা মায়েদা : ৩২)। এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, হত্যাকান্ড সীমালঙ্ঘন করার মতো গুরুতর অপরাধ, যার শাস্তি জাহান্নাম; যা মুসলমানরা কোনোভাবেই করতে পারে না। স্বেচ্ছায় কোনো ঈমানদারকে হত্যা করার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো ঈমানদারকে হত্যা করে তার শাস্তি জাহান্নাম, যে চিরকাল সেখানেই থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য কঠিন শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। (সূরা নিসা : ৯৩)।
সূরা নিসার ২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন- হে মুমিনগণ, তোমরা একে অন্যের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং একে অন্যকে হত্যা করো না। পবিত্র কোরআনে আরো বলা হয়েছে- (ঈমানদার বান্দা তারাই) যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যের ইবাদত করে না এবং অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না। (সূরা ফুরকান : ৬৮)। মহান আল্লাহ ফেতনা-ফাসাদ হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন- ...বস্তুত ফেতনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ। (সূরা বাকারাহ : ১৯১))
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন- দুনিয়া ধ্বংস করে দেয়ার চেয়েও আল্লাহর কাছে ঘৃণিত কাজ হলো মানুষ হত্যা করা। (তিরমিজি)। আনাস বিন মালেক রা. বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, রাসূল সা. বলেছেন- কবিরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া ও মিথ্যা কথা বলা। (বুখারি)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন- কিয়ামতের দিন মানুষের প্রথম বিচার করা হবে রক্তপাত সম্পর্কে। বিদায় হজের ভাষণে রাসূলেপাক সা. বলেন- হে মানুষ, ঈমানদাররা পরস্পরের ভাই। সাবধান, তোমরা একজন আরেকজনের হত্যা করার মতো কুফরি কাজে লিপ্ত হয়ো না।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোক আমরা সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি, ইসলাম এসেছে শান্তির জন্য, শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য নয়। যারা ইসলামের নামে সন্ত্রাস করে, মানুষ হত্যা করে, বিশৃঙ্খলা-হানাহানি সৃষ্টি করে তারা মুসলমান হওয়ার অযোগ্য। তারা ঘাতক-সন্ত্রাসী, তাদের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। তাদের সম্পর্কে তাই সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। তাদের প্রতিরোধ বা প্রতিহত করার দায়িত্বও মুসলমানরা এড়িয়ে যেতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।