Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নির‌বে চ‌লে গেলে ২৬শে এপ্রিল

সাটুরিয়ার ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের ৩০ বছর

সাটু‌রিয়া (মা‌নিকগঞ্জ) সংবাদদাতা ‌ | প্রকাশের সময় : ২৬ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:২৭ পিএম

নির‌বে চ‌লে গেল সেই ভয়াল ২৬ শে এপ্রিল পূর্ণ হল সাটুরিয়া টর্নেডোর ৩০ বছর। সাটুরিয়ায় কোন ধরনের অনুষ্ঠা‌নিকতা ছিল না এ বা‌রের ২৬ শে এপ্রিলে।

পালাবদলের ধারাবাহিকতায় আবার চ‌লে গেল ২০১৯ সালের ২৬ শে এপ্রিল। অন্য অন্য জায়গার মানুষের কা‌ছে প্রতিবছর ক্যালেন্ডারের পাতার এই দিনটিকে খুব সাধারণ মনে হলেও এটা মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলাবাসীর নিকট কোনভাবেই সাধারণ একটি দিন নয়।

২৬ শে এপ্রিল ঠিক এই দিনেই ১৯৮৯ সালে সাটুরিয়ায় ঘটে যায় একটি প্রলয়ংকরী টর্নেডো আর ২০১৯ সালের এই দিনে সেই প্রলয়ংকরী টর্নেডোটি পূরণ করতে চলেছে ৩০ বছর। ৩০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজকের দিনটি সাটুরিয়া উপজেলাবাসীর জন্য অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় টর্নেডোর ঘটনা ঘটে মানিকগঞ্জ জেলায় সাটুরিয়া থানায় ১৯৮৯ সালের ২৬ শে এপ্রিল। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি ছিল বুধবার। ঠিক তার পরের দিন সাটুরিয়াতে সাপ্তাহিক হাটের দিন ছিল। এই হাটের দিনটি সাটুরিয়ার ব্যবসায়ীদের নিকট কেনাবেচা করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সাপ্তাহিক হাটের ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের ২৬ শে এপ্রিল সাটুরিয়াতে হয়ে যায় সর্বনাশা টর্নেডো। টর্নেডোতে সাটু‌রিয়ার অনেককে ক‌রে‌ছে নি:শ্ব আব‌ার বেশ ক‌য়েকজন হ‌য়ে‌ছে ধনবান।
সে সময় অবজারভার পত্রিকায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ধ্বংসযজ্ঞ এতই নিঁখুত যে, সেখানে কিছু গাছের কঙ্কাল ছাড়া দৃশ্যত দাঁড়ানো আর কোনো বস্তু নেই৷
এলাকায় লোকজ‌নের মু‌খে বল‌তে শোনা যায়, টর্নেডোর বেশ ক‌য়েক দিন আগে থে‌কে সাটু‌রিয়ায় বৃ‌ষ্টি হ‌চ্ছিল না। দীর্ঘ দিন ধ‌রে বৃ‌ষ্টি না হওয়ায় টর্নেডোর আগের দিন সাটু‌রিয়ায় বৃ‌ষ্টি প্রার্থণা ক‌রে উ‌ল্টো হাত ক‌রে মোনাজাত করা হয়।

২৬ এপ্রিল টর্নেডোর ওই দিন সকাল থেকেই সাটুরিয়ায় প্রচন্ড গরম অনুভূতি হচ্ছিল এবং কোন রকমের বাতাসের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। তখন ছিল রমজান মাস। রোজাদার মুসলমানরা সারা দিন রোজা থাকার পর সন্ধ্যার ‌আগে ইফতারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক এমন সময়ই আকাশটা কালো মেঘের ছায়ায় আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসছিল। মাগরিব ওয়াক্তের (সন্ধ্যার) পূর্ব মুহূর্তে আকস্মিকভাবে ঘূর্ণিবায়ুর উৎপত্তি হয়ে ধ্বংসাত্মক এক ভয়াবহ টর্নেডোর আকার ধারণ করে সাটুরিয়া উপজেলার ওপর আঘাত হানে। এ সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮০ থেকে ৩৫০ কিলোমিটার । এক মিনিটেরও কম সময়ের স্থায়ী হওয়া ওই টর্নেডোর আঘাতে এ উপজেলার ছয় বর্গকিলোমিটার এলাকার সাটুরিয়া, হরগজ, তিল্লী, ফুকুরহাটি ইউনিয়নের প্রায় ২০ টির মতো গ্রামের সবকিছুই লণ্ড ভণ্ড হয়ে যায়। আর এতে প্রাণ হারায় প্রায় ১,৩০০ মানুষ এবং অঙ্গ হানী হয় প্রায় ২ হাজার লোক। প্রায় ১২ হাজার লোক আহত হয় এবং প্রায় এক লাখ লোক গৃহহীন হন। উপজেলার ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, সাটুরিয়া বাজারের ৪ শতাধিক দোকানপাট, উপজেলা সরকারি খাদ্যগুদাম, বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার গাছপালা উপড়ে লণ্ডভণ্ড হয়। বিশেষ করে টর্নেডোর আঘাতে প্রায় শত বছ‌রের প্রাচীন সাটুরিয়া বাজার সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বিধ্বস্ত সাটুরিয়া উপজেলা পরিদর্শন করেছিলো। তারা বিধ্বস্ত সাটুরিয়ার উন্নয়ন করার জন্য নানারকম প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যান। কিন্তু তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
অল্প সময়ের মধ্যে টর্নেডোতে এ ধরণের ভয়াবহ ধ্বংস লীলার কারনে ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ টর্নেডো গু‌লোর ম‌ধ্যে সাটুরিয়ার টর্নেডোকেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
২৯ টি বছর পার হলেও সাটুরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় এখন পর্যন্ত দেখা মিলে ১৯৮৯ সালের টর্নেডোর স্মৃতিচিহ্ন। সে সময় টর্নেডোর আঘাতে পঙ্গুত্ব বরন করে এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে অনেকে। এ জন্য প্রতিবছর দিনটি সামনে এলে এ উপজেলায় শোকের ছায়া নেমে আসে এবং স্বজন হারা পরিবারগুলো সৃতিকাতর হয়ে পরে।

টর্নেডোর আঘাত সহ্য করে যারা বেঁচে আছেন, তাদের মধ্যে সাটুরিয়া বাজারের এলুমিনিয়াম ব্যবসায়ী খসরু জানায়, সাটুরিয়া বাসস্ট্যান্ডে বৃষ্টির কারনে একটি ঘরে সে অপেক্ষা করছিল। সর্বনাশা টর্নেডোর কারনে ঘরের সার্টার গেট এসে লাগে তার ডান হাতে। আজও খসরু একটি হাত হারিয়ে অন্য হাতে জীবিকা চালাচ্ছেন।
সাটুরিয়া উত্তর কাওন্নারার চা দোকানদার মনু মিয়া জানায়, টর্নেডো কেঁড়ে নিয়েছে তার স্ত্রী ও আপনজন অনেককে। বাঁচার জন্য ৭ বছরের মেয়ে লিপিকে নিয়ে দৌঁড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছিল স্ত্রী সেলিমা বেগম। একটি গাছের টুকরো তার বুক ভেদ করে হৃদপিন্ড বের করে নেয়। আহত হয় তার মেয়ে লিপি।

সাটু‌রিয়ার রাধানগড় গ্রামের মো: কুতুব উদ্দিন (৬২) জানায়, ঘটনার দিন বিকাল ৫টার দিকে আকাশটা কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে যায়। তুমুল বৃ‌ষ্টি শুরু হ‌য়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়াবহ টর্নেডোর আঘাতে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। চারদি‌কে শুধু লন্ড ভন্ড ধ্বংস স্তুপ। বাতা‌সের গ‌তি‌বেগ এতো বে‌শি ছিল যে সাটু‌রিয়া নদীর উত্তর পা‌ড়ে খাদ্য গুদা‌মের সাম‌নে থাকা এক‌টি চাল বোঝাই ট্রাক বাতা‌সে উড়ে নদীর অপর পাড় নি‌য়ে ফে‌লে‌ছিল।

চর সাটু‌রিয়ার আজাহার আলী (৫১) জানায়, সাটু‌রিয়ার মানুষজন এখ‌নো অাকা‌শে মেঘ দেখ‌লে ভয়াল ট‌নে‌র্ডোর কথা ম‌নে ক‌রে ভ‌য়ে আত‌কে উঠে। এ ট‌র্নে‌ডো‌তে সাটু‌রিয়ার অ‌নেক ব্যবসায়ী তা‌দের মুলধন হা‌রি‌য়ে‌ছে। আবার অ‌নেক মানুষ ট‌র্নে‌ডো‌তে টাকা ভ‌র্তি ক্যাশ ও টাকার থ‌লি কু‌রি‌য়ে পে‌য়ে পরব‌তি‌তে ধনবান হ‌য়ে‌ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এপ্রিল

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ