বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
প্রজা সাধারণের সঠিক অবস্থা অবগত হওয়ার জন্য ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর রা. রাতে তাঁর গোলামকে সঙ্গে নিয়ে ছদ্মবেশে সফরে বের হতেন এবং বিভিন্ন স্থানে গিয়ে চুপে চুপে সাধারণ লোকদের অবস্থা অবগত হওয়ার চেষ্টা করতেন।
রাতের এ ভ্রমণে যা জানতে পারতেন, দিনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। তাঁর খেলাফত আমলে এরূপ বহু ঘটনার বর্ণনা তার জীবনচরিতগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। ছদ্মবেশে রাতে প্রজা সাধারণের সরাসরি অবস্থা জেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত রাজা-বাদশাহ বা শাসকদের মধ্যে খুবই বিরল।
পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে হারুনুর রশীদ দ্বিতীয় খলিফার মতো ছদ্মবেশে তাঁর প্রজা সাধারণের অবস্থা জানার চেষ্টা করতেন। এ ন্যায়পরায়ণ দুঃসাহসী খলিফা তাঁর খেলাফত আমলে অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে লোকলস্কর বা দু-একজন বিশ্বস্ত লোককে সঙ্গে নিয়ে কখনো নৌকা ভ্রমণে এবং কখনো বিভিন্ন স্থানে গমন করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একবার খলিফা হারুন ছদ্মবেশে চোরের দলে শামিল হয়ে চোর ধরার অভিনব কৌশল অবলম্বন করলেন।
ঘটনাটি ইতিহাসে এই রূপ বর্ণিত হয়েছে, একবার গভীর অন্ধকার রজনীতে খলিফা হারুনুর রশীদ ও তাঁর মন্ত্রী জাফর ছদ্মবেশে বের হন। এক স্থানে তারা দশ-বারো জন ব্যক্তিকে আলাপরত দেখতে পান, যারা চুপে চুপে কথা বলছিল। খলিফা হারুন ধারণা করলেন, ওরা নিশ্চয়ই চোরের দল হবে এবং কোথাও ডাকাতি করার পরিকল্পনা করছে। খলিফা হারুন ও মন্ত্রী জাফর তাদের নিকট গমন করেন। তাদের একজন জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমরা কারা? এখানে কেন এসেছ?’
খলিফা হারুন জবাব দিলেন, ‘বন্ধুগণ! চিন্তা করো না, তোমরা যারা, আমরাও তোমাদের মতো এবং তোমরা যে কাজে বের হয়েছ আমরাও একই কাজে বের হয়েছি। ওই কাজের সন্ধান আমরাও করছি।’ চোরেরা মনে করল, ওদের মতো এ দুইজনও চোর হবে। তাই ওরা তাদেরকেও চোরদের দলে শামিল করে নেয়। অতঃপর চুরি করার কর্মসূচি নতুনভাবে করে। খলিফা হারুনের প্রস্তাব অনুযায়ী, শাহী মহলে ডাকাতি করার কর্মসূচি করা হয়। চোরেরা শাহী মহলে ডাকাতি করতে ঘাবড়ে যায়, কিন্তু খলিফা হারুন ওদেরকে আশ্বস্ত করেন যে, ‘খোদা না করুন ওরা যদি গ্রেফতার হয়ে যায়, তাহলে তিনি স্বীয় প্রভাব খাটিয়ে তাদের মুক্ত করবেন।
খলিফা হারুনের আশ্বাসের ভিত্তিতে সব চোর শাহী মহলে গমন করে। খলিফা হারুন ওদেরকে গোপন পথে মহলের সেই অংশে নিয়ে যান, যেখানে মূল্যবান জিনিসপত্র সংরক্ষিত ছিল। চোরেরা দামি জিনিসপত্র পুঁটলিতে বেঁধে নেয় এবং অত্যন্ত উৎফুল্লের সাথে মহল হতে বের হওয়া মাত্র পাহারাদারেরা ওদেরকে ধরে ফেলে এবং ওদের সবাইকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। ভোরে ওদেরকে খলিফা হারুনের দরবারে উপস্থিত করা হয়।
চোরেরা এক কোণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বসে থাকে এবং ওদের ওই দুই সঙ্গীকে গালাগাল করতে থাকে, যারা ওদেরকে শাহী মহলে নিয়ে এসেছিল। খলিফা হারুন সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে মনে মনে হাসছিলেন। শাহী রীতি-প্রথার কারণে কারো মাথা উঁচু করার দুঃসাহস হলো না। চোরেরা সাহস করে মাথা উঁচু করে খলিফা হারুনকে দেখার চেষ্টা করে থাকলেও তাকে চিনতে পারত না। কেননা খলিফা হারুন তখন শাহী পোশাকে সজ্জিত ছিলেন।
‘তোমাদের শাহী মহলে ডাকাতি করার দুঃসাহস কিভাবে হলো?’ খলিফা হারুন গর্জে উঠে ডাকাত সরদারকে প্রশ্ন করলেন। চোরদের সরদার মনে মনে ভাবল, এখানে মিথ্যা বলে পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। সাহস করে সে বলল, ‘সম্মানিত খলিফা! শাহী মহলে ডাকাতি করার কথা আমাদের কল্পনায়ও ছিল না। কিন্তু গত রাতে আমাদের সঙ্গে দুইজন নতুন সঙ্গী এসে যোগ দেয় এবং তারা আমাদেরকে প্ররোচিত ও উৎসাহিত করে শাহী মহলে নিয়ে আসে। আমাদেরকে বিপদে ফেলে ওরা পালিয়ে যায়।’
খলিফার খুব হাসি পেলেও তিনি ধৈর্যের সাথে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলেন, ‘তোমরা যদি তাদেরকে চিনতে পারো তাহলে মাথা উঁচু করে দেখো যে, তোমাদের সঙ্গীরা দরবারে উপস্থিত নেই তো?’ দরবারে তখন খলিফা হারুন ছাড়া তাঁর মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু চোরদের সাহস হলো না দৃষ্টিপাত করার। কিছুক্ষণ পর হারুন নিজেই বললেন, ‘তোমাদের দুই সঙ্গীদের মধ্যে একজন গ্রেফতার হয়েছে। সে স্বীকার করেছে যে, তোমাদেরকে ধোঁকা দিয়ে শাহী মহলে নিয়ে এসেছিল। সে এই কথাও স্বীকার করেছে, তোমাদেরকে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তোমরা যদি ধরা পড়ো তাহলে সে তার প্রভাব খাটিয়ে তোমাদেরকে মুক্ত করবে।’
‘হে আমিরুল মোমেনিন! এ কথা সম্পূর্ণ সত্য,’ চোরদের সরদার দ্রুত বলে উঠল। ‘আপনি তাকে আমাদের চেয়ে কঠোর শাস্তি দান করুন।’ ‘কিন্তু তার সুপারিশের ভিত্তিতে আমি তোমাদেরকে মুক্ত করে দিচ্ছি, যাতে তোমাদের অন্তর তোমাদের সঙ্গী সম্পর্কে পরিষ্কার হয়ে যায়।’ এ কথা বলে খলিফা হারুন পাহারাদারকে ইশারা করেন। অতঃপর চোরদের হাতকড়া খুলে দেয়া হয়।
চোরদের সরদার বিনয়ের সাথে আরজ করে, ‘হে আমিরুল মোমেনিন! আমাদের সে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী সঙ্গী কোথায়? যে চোর হওয়া সত্তে¡ও এতই সত্যবাদী, তাকে ডাকুন। আমরা তাকে দেখব, তার শুকরিয়া আদায় করতে চাই।’
‘তোমরা মাথা উঁচু করে এদিক-ওদিক তাকাও। তোমরা নিজেদের সেই সঙ্গীকে দেখতে পাবে।’ খলিফা হারুনের কণ্ঠ চোরদের কানে বাজার পর তারা সবাই গর্দান উঁচিয়ে শাহী সিংহাসনের দিকে তাকায়। অতঃপর বিস্ময়ে তারা অভিভূত হয় এবং লজ্জায় তাদের মাথা নুইয়ে পড়ে। খলিফা হারুনুর রশীদ তার মুকুট ও শাহী ‘আবা’ খুলে দিয়েছিলেন এবং রাতের ছদ্মবেশী পোশাকে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
এটি এবং এ ধরনের আরো বহু বিস্ময়কর ঘটনা খলিফা হারুনের খেলাফত জীবনে বাস্তব গল্প-কাহিনীর আকার ধারণ করেছে। তিনি ইনসাফ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এবং প্রজা সাধারণের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য অসংখ্য কীর্তির অধিকারী। বিশৃঙ্খলা ও চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই প্রভৃতি সামাজিক অপরাধ দমনে তার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, অপূর্ব কৌশল এবং দুঃসাহসিকতা ইতিহাসের বিরল ঘটনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।