বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ধনসম্পদ বৃদ্ধির ঘৃণ্য উপায় হিসেবে সুপ্রাচীনকাল থেকে সুদি কারবারের প্রচলন রয়েছে। সব দেশে সব কালেই এর প্রচলন লক্ষ করা যায়। এখনো এমন কোনো দেশ ও সমাজ নেই, সেখানে এ কুপ্রথার প্রচলন নেই। কেউ কাউকে ঋণ দিয়ে নির্ধারিত সময়ান্তে তার ‘অতিরিক্ত’ আদায় করলে সেটাই সুদ।
এ ঋণ অর্থের আকারে হতে পারে, পণ্যের আকারেও হতে পারে। অর্থাৎ ঋণ হিসাবে অর্থ প্রদান করে তার অতিরিক্ত আদায় করলে যেমন সুদ হবে, তেমনি ঋণ হিসাবে পণ্য প্রদান করে তার অতিরিক্ত আদায় করলে সেটাও সুদ হিসাবে পরিগণিত হবে। এই কারবারের দু’টি পক্ষ- এক. ঋণদাতা। দুই. ঋণগ্রহীতা। যার বাড়তি অর্থ বা পণ্য আছে, সে যদি এই কারবারের শামিল হয়, তবে সে ঋণদাতা। আর যার অর্থ বা পণ্যের অভাব বা ঘাটতি আছে সে যদি ঋণদাতার কাছ থেকে অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে ঋণ গ্রহণ করে, তবে সে ঋণগ্রহীতা। এই কারবারে দায়গ্রস্ত ঋণগ্রহীতার ঋণদাতাকে অতিরিক্ত দিতে হয় বলে এটা একটা চরম শোষণমূলক ও অমানবিক ব্যবস্থা।
ইসলাম এই শোষণমূলক কারবারকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা সুদকে হারাম করেছেন এবং ব্যবসাকে হালাল করেছেন।’ (সূরা বাকারাহ : আয়াত ২৭৫)। অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টিতে সুদি কারবার ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়, যদিও অনেকে একে ব্যবসা বলে মনে করে। অতীতেও এমনটাই মনে করা হতো।
আমাদের দেশে এই সুদি কারবার ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা মূলত সুদনির্ভর। ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তার জন্য সুদ দিতে হয়। অন্য দিকে চালু রয়েছে এনজিও ঋণ, তাও সুদনির্ভর। গ্রামাঞ্চলে চালু আছে মহাজনী ঋণপ্রথা। অর্থঋণের পাশাপাশি সেখানে চালু আছে পণ্যঋণও। বলাবাহুল্য, ঋণ তারাই নেয়, যাদের অভাব আছে, যারা দায়গ্রস্ত কিংবা ঋণগ্রস্ত। সেই অভাবী, দায়গ্রস্ত ও ঋণগ্রস্তরাই অতিরিক্ত দেয়ার শর্তে ঋণ নেয় এবং ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
সুদি কারবার দারিদ্র্য বিস্তারের একটি বড় কারণ। যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারে না, তাদের দুর্ভোগ ও বিপর্যয়ের শেষ থাকে না। ঋণ পরিশোধের জন্য অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পলাতক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। এমন নজির আমাদের গ্রামীণ সমাজে মোটেই বিরল নয়। অনেকে সম্পূর্ণ নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। সে নজিরও আছে।
সুদি কারবারের কুফল ব্যক্তিপর্যায়ে যেমন তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও দেখা যায়। অনেক শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সুদে ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছে। এরূপ দৃষ্টান্ত অসংখ্য। রাষ্ট্রও ঋণ নিয়ে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় এবং তার উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়। সাম্প্রতিক এক খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশের জিডিপির আড়াই শতাংশ খেয়ে ফেলে সুদ। জাতীয় বাজেটের একটা বিরাট অংশ ব্যয় হয় ঋণের সুদ পরিশোধ করতে।
খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সুদ পরিশোধে সরকারকে ব্যয় করতে হয়েছে ৫৫ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। চলতি বছরের তিন মাসে ব্যয় হয়েছে বেশ মোটা অংকের অর্থ। এ বছর ঋণ পরিশোধে বরাদ্দ আছে ৫১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। বছরান্তে এ ব্যয় ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সুদ দেয়া ও নেয়া- দুই’ই হারাম। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিময়ে রুপা, গমের বিনিময়ে গম, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর, যবের বিনিময়ে যব, লবণের বিনিময়ে লবণ সমান সমান এবং উপস্থিত ক্ষেত্রে হাতে হাতে, পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বেশি দিয়েছে বা নিয়েছে সে সুদের কারবার করেছে। এ ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই সমান। তাই প্রত্যেক মুসলমানের সুদ নেয়া ও দেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। পারতপক্ষে তাদের উচিত ঋণ না নেয়া। আর সুদভিত্তিক ঋণ নেয়া তো নয়ই।
আল্লাহ যেহেতু সুদকে হারাম ও ব্যবসাকে হালাল করেছেন। সুতরাং সম্পদ বৃদ্ধির অন্যতম উপায় হিসেবে ব্যবসাকেই অবলম্বন করা উচিত। আল্লাহ সুদখোরদের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। তিনি বলেছেন : হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা সুদ খেয়ো না। আর আল্লাহকে ভয় করো। তবেই তোমরা সফল হতে পারবে। আর তোমরা সেই আগুনকে ভয় করো, যা অবিশ্বাসীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১৩০-১৩১)।
আল্লাহতায়ালা সুদের ব্যবসা ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছেন এবং ছেড়ে না দেয়াকে আল্লাহ ও তার রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধ করা বলে অভিহিত করেছেন। কাজেই, সুদি কারবারের সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিষয়ে সবাইকে অত্যন্ত সতর্ক ও সাবধান হতে হবে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক সুস্পষ্টভাবে বলেছেন : মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য তোমরা সুদে যা দিয়ে থাকো তা আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য জাকাত দিয়ে থাকো, তাদেরই সম্পদ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। (সূরা রুম : আয়াত ৩৯)। বলা বাহুল্য, সুদি কারবার নয়, জাকাত ব্যবস্থাই সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসন, দারিদ্র্য বিমোচন ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রকৃষ্ট উপায়। যারা জাকাত দেয়, সাদকাহ দেয়, স্বয়ং আল্লাহ তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে দেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।