Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

অগ্নি বীরের বিদায়

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

পরিবারের উপযুক্ত সদস্যকে চাকরি দেয়া হবে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি চায় পরিবার কিশোরগঞ্জের ইটনায় দাফন
রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাÐে আটকে পড়াদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া ফায়ার ফাইটার সোহেল রানাকে অশ্রæসিক্ত চোখে শেষ বিদায় জানিয়েছে দেশবাসী। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে বঙ্গবাজারের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সোহেলের দীর্ঘদিনের সহকর্মী, ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা এবং পরিবারের সদস্যরাসহ অনেকে উপস্থিত হয়ে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করেন।
জানাজা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আছাদুজ্জামান খাঁন কামাল নিহত সোহেল রানার পরিবারের উপযুক্ত সদস্যকে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলে আশ্বাস দেন। এদিকে, পরিবারের একমাত্র উপার্জক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চারিদিকে অন্ধকার দেখা সোহেলের পরিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।
জানাজা শেষে অ্যাম্বুলেন্সযোগে তার লাশ গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ইউনিয়নের কেরুয়ালা গ্রামে নেয়া হয়। সেখানেই চৌগাঙ্গা ফাজিল মাদরাসা মাঠে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও স্বজন সূত্রে জানা যায়, গতকাল বেলা ১১টার দিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমইএচ) হিমঘর থেকে ফায়ারম্যান সোহেল রানার লাশ বঙ্গবাজারের ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরে আনা হয়। এ সময় সহকর্মী ও স্বজনদের কান্নায় সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। সেখানে শেষবারের মতো অল্প সময়ের জন্য সোহেলের মুখ সহকর্মীদের দেখতে দেওয়া হয়।
গতকাল সরজমিনে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরে দেখা যায়, সকালেই অ্যাম্বুলেন্স করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমইএচ) মর্চুয়ারিতে থেকে ফায়ার সদর দপ্তরে আনা হয় সোহেলের লাশ। অ্যাম্বুলেন্স থেকে বাহিনীর কমলা রঙের পতাকায় মোড়া সোহেল রানার কফিন নামানোর পরেই তার সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মুহুর্তেই সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
কফিনের পাশে অশ্রæশিক্ত চোখে দাঁড়িয়ে থাকা সোহেলের শেষ কর্মস্থল কুর্মিটোলা ফায়ার স্টেশনে সিনিয়র স্টেশন অফিসার বজলুর রশীদ বলেন, ছেলেটার মুখের দিকে আমি তাঁকাতে পারছি না। আমার সঙ্গে সে কাজ করতো। ঘটনার দিন আমার সঙ্গেই এফ আর টাওয়ারে গিয়েছিল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি সোহেলের বাবা, মা ও ভাইয়ের মুখের দিকেও তাকাতে পারছি না।
ফায়ারম্যান হাসান বলেন, আমরা একসঙ্গে অনেকদিন কাজ করেছি। কখনও ভাবতে পারিনি সোহেল এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। সোহেল খুব ভালো ছিল, কম কথা বলতো, কিন্তু সবার সঙ্গে মিশতো।
বেলা ১১টার দিকে সোহেল রানার প্রথম জানাজার নামাজ শুরু হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ফায়ার সার্ভিসের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান, লালবাগ বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্থরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সোহেলের জানাজায় অংশ নেন। জানাজার আনুষ্ঠানিকতায় স্বজনদের পক্ষ থেকে বক্তব্য দিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন সোহেলের ছোট ভাই উজ্জল মিয়া। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, আমার ভাই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুতে আমরা পথে বসে গেছি। আমরা চাই, প্রধানমন্ত্রী আমাদের পরিবারের প্রতি সুদৃষ্টি দেন।
তিনি আরো বলেন, আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। তিনি ছোট বেলা থেকেই মানুষের জন্য কাজ করতেন, পরোপকারী ছিলেন। তিনি দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন এ জন্য আমরা এতে গর্বিত। আমরা চাই সবাই যেন তার মতো দেশের জন্য কাজ করতে পারি। আমার ভাইয়ের যদি কোনো ভুল ত্রæটি থাকে তাহলে আপনারা ক্ষমা করে দেবেন। তার জন্য দোয়া করবেন, সে যেন জান্নাতবাসী হয়।
জানাজা শেষে সোহেল রানার পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সোহেল পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। ফায়ার সার্ভিসসহ আমরা সবাই তার পরিবারের প্রতি লক্ষ্য রাখব। তার পরিবারে যদি উপযুক্ত কেউ থাকে তাকে একটি চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
সাহসী সোহেলের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, সোহেল রানা জনগণকে ভালোবাসতো, দেশকে ভালোবাসতো, তারই প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এফ আর টাওয়ারে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজের নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। তার মৃত্যুর জন্য আমরা গভীরভাবে দুঃখিত। তিনি আরো বলেন, শুধু সোহেল নয়, আমি স্মরণ করতে চাইÑ সিলেটের জঙ্গি হামলার সময় নিহত ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তাকে। আমাদের যেখানে প্রয়োজন অগ্নি সেনারা সেখানে গিয়ে কাজ করছে, দুর্ঘটনাস্থল থেকে জানমাল রক্ষা করছে।
সোহেল রানার চিকিৎসার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করেছি। প্রথমে তাকে সিএমএইচে নেয়া হয়েছে, এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়েছে। সোহেল রানার পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পাবে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ক্ষতিপূরণ নয়, আমরা তাকে সহযোগিতা করবো। ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিস তাকে সহযোগিতা করেছে, প্রধানমন্ত্রীও সহযোগিতা করবেন। ভবিষ্যতে আপনারা তা দেখতে পাবেন।
কিশোরগঞ্জ থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গা ফাজিল মাদরাসা মাঠে সোহেল রানার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় নিহত সোহেলর আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের ময়মনসিংহ বিভাগের উপপরিচালক, ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারসহ বিপুল পরিমাণ মানুষ অংশ নেয়। পরে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
উল্লেখ্য, গত ২৮ মার্চ বনানীর ২৩ তলা এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর আটকে পড়াদের উদ্ধারে অংশ নিয়েছিলেন ফায়ারম্যান সোহেল রানা। উদ্ধারের এক পর্যায়ে ওভারলোড দেখায় লেডারটি (উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত এক ধরণের বড় মই)। পরে ওজন কমাতে মই বেয়ে নামতে গিয়ে লেডারের ভেতর পা চলে যায় সোহেল রানার। এসময় তার পেটের ভেতরে রড ঢুকে পেটও থেতলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত শুক্রবার রাতে তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই গত রোববার রাত ২টা সতেরো মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন সোহেল। পরে গত সোমবার রাতে তার লাশ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে আনা হয়।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অগ্নি

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ