Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উত্তরাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার লোকজসামগ্রী

প্রকাশের সময় : ২১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. হায়দার আলী গোদাগাড়ী (রাজশাহী) থেকে : গোদাগাড়ী উপজেলাসহ গোটা উত্তরাঞ্চল থেকে দিনে দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকজসামগ্রী। এখন ওই সব সামগ্রী রূপকথার গল্পমাত্র এবং বিলুপ্ত হয়ে স্থান পেয়েছে কাগজে-কলমে, বইয়ের পাতায়।
এক সময় আমাদের গ্রামবাংলার ঘরে ও বাইরে কাজ করার জন্য যে জিনিসগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল ঢেঁকি, যাঁতা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। গ্রামবাংলার কৃষাণ-কৃষাণীরা নবান্নের উৎসব পালন করত ঢেঁকি ও যাঁতার সাহায্যে।
অগ্রহায়ণ মাসে মাঠ থেকে রোপা আমন ধান ঘরে তোলার পর ধানকে চালে পরিণত করত ঢেঁকির মাধ্যমে। ধান ভাঙার মেশিন (রাইস মিল) প্রচলন হওয়ার আগে ঢেঁকিই ছিল ধান থেকে চালে পরিণত করার একমাত্র মাধ্যম। তখন গম, কলাই, চালকে আটায় পরিণত করা হতো যাঁতার মাধ্যমে। অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘÑ এ তিনমাস ঢেঁকি ও যাঁতার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাত গ্রামের গৃহবধূ, মা, বোন, খালা, নানীরা। সারা বছরের চাল, আটা করে নিত। তারা কাকডাকা ভোরে উঠে ঢেঁকিতে ধান ভাঙার কাজ করত এবং বিভিন্ন সুরে গীত গাইত। যেমন তারা পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের সুরে বলতÑ
“ও বউ ধান ভানেরে ঢেঁকিতে পাড় দিয়া,
ঢেঁকি নাচে বউ নাচে হেলিয়া-দুলিয়া
ও বউ ধান ভানেরে .................. ।”
তখন গ্রামের সব মানুষের বুঝতে বাকি থাকত না অমুক বাড়িতে ধান ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেছে। এ বাড়ির ধান ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেলে তাদের দেখাদেখি অন্যান্য বাড়িতে ঘুম থেকে জেগে ধান ভাঙা শুরু করে দিত। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে তারা দুপুর পর্যন্ত এ কাজে ব্যস্ত থাকত। যাঁতা দ্বারা গুঁড়ো করা আটা দিয়ে কৃষাণীরা শীত মৌসুমে বিভিন্ন সুস্বাদু পিঠা, পায়েস, তৈরি করত। তারা শুধু ধান থেকে চাল নয়, ধান থেকে চিড়া, খেসারি, মুড়ি, শুকনো হলুদ থেকে হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, ধনিয়ার গুঁড়াসহ বিভিন্ন রকমের গুঁড়া মসলা সুস্বাদু কলাই ও কুমড়োর বড়ি, মসুর, মুগ, ছোলা, মটর, কলাইসহ বিভিন্ন রকমের ডাল তৈরি করতে ঢেঁকি ও যাঁতার প্রয়োজন হতো। ওই সময় টাটকা জিনিস, চিড়া, মুড়ি, আটার নাড়ু পাওয়া যেত। এখন ওইসব রূপকথার গল্পমাত্র। বর্তমানে আমরা যা খাই তা ভেজালযুক্ত, নোংরা পরিবেশে তৈরি, অপবিত্র খেয়ে থাকি। গ্রমের মা বোনেরা আগেই মুড়ির ধান থেকে চাল তৈরি করে রাখত আসর নমাজ আদায় করে মুড়ি ভাজার কাজটি শুরু করে দিত। সে মা-বোনের হাতে ভাজা মুড়ি কতই না মজা লাগত। ঘ্রাণে আপন মনে খেতে ইচ্ছা করত। এখন বাজার থেকে ভেজালযুক্ত, রাসায়নিক সারযুক্ত মুড়ি, চিঁড়ায় সে স্বাদ লাগে না, খেতে ইচ্ছা হয় না। মুখে দিলে কেমন অরুচি ভাব লাগে। এমন কোনো কৃষকের বাড়ি ছিল না যে বাড়িতে ঢেঁকি, যাঁতা ছিল না। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে রূপসী বাংলার ঢেঁকি, যাঁতা ব্যবহার প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে। এ গুলোকে সংরক্ষণ ও সংগ্রহ করার কোনোই ব্যবস্থা নেই। গ্রামীণ ওইসব লোকজ শিল্পগুলোকে সংরক্ষণ করা না হলে এক সময় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগামী প্রজন্ম এগুলো চিনতে পারবে না। ব্যবহার বুঝতে পারবে না। শুধু ১ বৈশাখে ঘটা বাংলা নববর্ষ পালন করলে, পান্তা-ইলিশ মুড়ি, উখড়া খেলে পাঞ্জাবি, পাজামা, ধুতি পরলে কিংবা সে দিন মাটির কলস, মাটির পাতিল, টাপর তোলা গরু-মহিষের গাড়ি বর-বধূ সেজে বাংলা নববর্ষ পালন করলে হবে না। প্রতিটি দিন এগুলো সংরক্ষক করতে হবে, ব্যবহার বাড়াতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উত্তরাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার লোকজসামগ্রী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ