ব্যর্থতার ভিতে গড়ে তুলতে হবে সাফল্যের সুউচ্চ মিনার
আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবসের ক্রোড়পত্রে প্রকাশের জন্যে দৈনিক ইনকিলাবের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কে ইতোপূর্বে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেন। অবশ্য এসব তথ্য এবারই যে প্রথম প্রকাশিত হলো তা নয়, ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত জাসদ এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা এসব তথ্য প্রকাশ করেছেন। সেগুলো বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এখনকার তরুণ সমাজের সেগুলো জানার কথা নয়। আমি নিজেও জানিনা যে, স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের দলিলে ঐ তথ্য গুলি সন্নিবেশিত রয়েছে কি না। সন্নিবেশিত থাকলে ভালো কথা। আমি যতটুকু পড়াশোনা করেছি, সেই সব থেকে আমার মনে হয় যে, স্বাধীনতা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অজানা তথ্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আব্দুর রাজ্জাক।
আব্দুর রাজ্জাক শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে পানিসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে যখন এক দলীয় বাকশাল পদ্ধতি বিলোপ করে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তিত হয় তখন অন্যান্য দলের মতো আওয়ামী লীগও স্বনামে পুনরুজ্জীবিত হয়। কিন্তু আব্দুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন নি। তিনি বাকশাল নামে আলাদা একটি দল গঠন করেন। আব্দুর রাজ্জাক যে সব অজানা কিন্তু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন সেগুলো ছাপা হয়েছিলো সাপ্তাহিক ‘মেঘনা’ পত্রিকায়। এছাড়া কাজী আরেফ আহমাদ ও হাসানুল হক ইনু আরো কিছু তথ্য দিয়েছেন। তাদের তথ্যের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
শেখ হাসিনার দেওয়া তথ্য মতে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আর্মি ক্র্যাকডাউনের পর লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যায়। তিনি প্রশ্ন করেন, এটি কিভাবে সম্ভব হয়েছিলো? ভারত গমনে তারা বাধা প্রাপ্ত হন নি কেন? ভারতে প্রায় এক কোটি শরণার্থীর খাওয়া-দাওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র-শস্ত্রের যোগান কি হাওয়া থেকে এসেছিলো?
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৬৯ সালের ২২ এপ্রিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২২ অক্টোবর লন্ডন যান। তখন শেখ হাসিনা তার স্বামীর কর্মস্থলের সুবাদে ইটালি ছিলেন। তিনিও ২৩ অক্টোবর লন্ডনে পৌঁছান। লন্ডনে বঙ্গবন্ধু মিটিং করে ঠিক করেন, কখন মুক্তিযুদ্ধ হবে, কোথায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হবে এবং শরণার্থীরা কোথায় যাবেন- সব প্রস্তুতি সেখানেই হয়।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘হঠাৎ করে একটি দেশের স্বাধীনতা আসে না। এজন্য বছরের পর বছর প্রস্তুতির প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে বাঙ্গালী জাতিকে বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথা থেকে অস্ত্র আসবে, কে প্রশিক্ষণ দেবে, এমনকি হাজার হাজার শরণার্থীর খাবার কোথা থেকে যোগাড় হবে, এর সবই ঠিক করে রেখে ছিলেন বঙ্গবন্ধু।’ স্বাধীনতার ঘোষক প্রসঙ্গ নিয়েও শেখ হাসিনা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘যেনতেনভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে স্বাধীনতা আসে না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আগাম ঘোষণা দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হতে চান নি। যদি চিহ্নিত হতেন তাহলে বিদেশী সাহায্য আর স্বীকৃতি আসতো না। তিনি চেয়েছিলেন, আগে পাক বাহিনী অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান আক্রমণ করুক। শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটেছিল। অর্থাৎ পাক বাহিনী প্রথম বাঙালীদের উপর হামলা করেছিলো।’ শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি। কারণ সেটি করা হলে দেশ কোনদিন স্বাধীন হতো না।’ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, লন্ডনে বসেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নির্বাচন হবে, আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করবে, কিন্তু তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না। ফলে মুক্তিযুদ্ধ হবে এবং আমরা বিজয় অর্জন করবো। আমাদের বিজয় লাভের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।’
দুই
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা সংগ্রামের অজানা তথ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ১৯৬৯ সালের অক্টোবরের কথা বলেছেন। অবশ্য তিনি বক্তৃতার এক পর্যায়ে এও বলেছেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম আসলে শুরু হয়েছে ১৯৪৮ সাল থেকে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যারা রাজনীতির উচ্চমার্গে বিচরণ করি না, যাদের ক্ষমতার করিডোরে যাতায়াতের সুযোগ নাই, তাদের পক্ষে এসব তথ্য নিয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু অনেক ঘাঁটা ঘাঁটি করে বিক্ষিপ্তভাবে যেসব দলিল পাওয়া যায় সেগুলো থেকে ১৯৪৮ সাল না হলেও ১৯৫০ সালে স্বাধীনতার পরোক্ষ কিন্তু প্রথম ধাপের সন্ধান মেলে। এই ধাপটিতে রয়েছে একটি চার্টার, একটি সনদ, একটি ফর্মুলা।
আরেকটি কংক্রিট প্রমাণ পাওয়া যায় আওয়ামীলীগ সংবিধান কমিটি কর্তৃক ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণীত খসড়া সংবিধানে। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ পাকিস্তানের মিলিটারী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহইয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৫ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত এই ৮ দিন ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার ভুট্টো এবং শেখ মুজিবের মাঝে ম্যারাথন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা কয়েক দিন অনুষ্ঠিত হওয়ার মাঝে নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দলের নেতা হিসাবে ঢাকা আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনিও আলোচনায় যোগ দেন। ফলে ইয়াহিয়া, মুজিব দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ত্রিপক্ষীয় রূপ ধারণ করে। এই ম্যারাথন আলোচনার সময় শেখ মুজিব ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণীত খসড়া সংবিধান দাখিল করেন। এই খসড়া সংবিধানেও দ্ব্যার্থহীনভাবে বলা না হলেও স্বাধীনতার পরোক্ষ ছায়াপাত লক্ষ করা যায়। এটিকেও বলা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরোক্ষ চার্টার, সনদ বা ঘোষণা।
রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্ররা জানেন যে, পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করতে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠির সময় লেগেছে সুদীর্ঘ নয় বছর। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করতে সময় লেগেছে মাত্র এক বছর। আসলে পাকিস্তানের সাংবিধানিক সংকট শুরু হয় ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে, যখন পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ ‘অবজেক্টিভ রেজ্যুলিউশন’ নামক প্রস্তাবটি পাশ করে। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে গঠিত হয় মূলনীতি কমিটি। সংবিধানের মূলনীতি সংবলিত কতিপয় সুপারিশ এই মূলনীতি কমিটি রচনা করে এবং সেগুলি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এগুলি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে ‘বিপিসি সুপারিশ’ বলে পরিচিত। বিপিসি কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে তদানিন্তন পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশে) তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। সেই ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন সেদিনের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। মুসলিম ছাত্রলীগের পথ ধরে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় পূর্ব বঙ্গ আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীকালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয় এবং সংগঠনটির নতুন নাম হয় আওয়ামী লীগ।
তিন
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক এবং আইনজ্ঞদেরকে নিয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে এই কমিটির সংক্ষিপ্ত নাম হয় ‘গণতান্ত্রিক ফেডারেশন।’ ১৯৫০ সালের ৪ নভেম্বর একটি জাতীয় মহাসম্মেলন (গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন) অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সম্মেলনের সভাপতি সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ নেতা আতাউর রহমান খান একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘১৯৪৬ সালের নির্বাচনের ভিত্তিতে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছে সেটি স্বাধীন পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করতে পারে না। তাই তিনি অবিলম্বে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের দাবী
তোলেন এবং বলেন যে, ঐ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পাকিস্তানের ভবিষ্যত সংবিধান রচনা করবেন।”’
ঐ মহাসম্মেলনে যে সব সাংবিধানিক প্রস্তাব অনুমোদিত হয় তার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার দাবী জানানো হয়। ঐ প্রস্তাবে বলা হয় যে, পাকিস্তানের নাম হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় পাকিস্তান (ইউনাইটেড স্টেটস অব পাকিস্তান)। পাকিস্তানের থাকবে একটি এক কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ঐ পার্লমেন্ট সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। ফেডারেল সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে মাত্র দুইটি বিষয়। একটি হলো প্রতিরক্ষা আরেকটি হলো পররাষ্ট্র। প্রতিরক্ষা বাহিনীর থাকবে দুইটি ইউনিট। একটি থাকবে পূর্ব পাকিস্তানে। আরেকটি থাকবে পশ্চিম পাকিস্তানে। কোনো অবস্থাতেই সংবিধান বাতিল করা যাবে না। কনভেনশনের প্রস্তাবে বৈদেশিক বাণিজ্য, মুদ্রা, ব্যাংক প্রভৃতি সমস্ত বিষয় প্রাদেশিক সরকারে হাতে ন্যাস্ত করা হয়।
আজ যদি কেউ আওয়ামী লীগের ৬ দফা প্রস্তাবের সাথে মহা-সম্মেলনের প্রস্তাব গুলোকে মিলিয়ে দেখেন তাহলে তিনি পাবেন এই দুটি সাংবিধানিক প্রস্তাবের মধ্যে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী ধাপ হলো আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ৬ দফা ফর্মুলা। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে অনুমোদিত এই প্রস্তাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি মুদ্রা রাখার ব্যবস্থা করা হয়। অনুরূপভাবে দুইটি প্রদেশের জন্য দুইটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়। ৬ দফায় বলা হয় যে, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কর ধার্যের কোন ক্ষমতা থাকবে না। সেটি থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। পূর্ব পাকিস্তান যা আয় করবে তার নিয়ন্ত্রণ থাকবে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের হাতে। অনুরূপভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় থাকবে পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের হাতে। প্রাদেশিক সরকারসমূহ বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্য মিশন স্থাপন করবেন এবং বিদেশের সাথে বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি করবেন।
চার
স্বাধীনতার তৃতীয় ও চূড়ান্ত ধাপ হলো ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খান, মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে আওয়ামী লীগের খসড়া শাসনতন্ত্র উত্থাপন। এই শাসনতন্ত্র প্রণীত হয় ৬ দফার ভিত্তিতে। এই বিষয়টি আলোচনার আগে একটু পেছনে ফিরে যেতে হয়।
১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পরেও যখন পাকিস্তানের প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক সংকট কাটেনা, যখন সঙ্কট আরো ঘনিভূত হয়, তখন সেই সঙ্কট সমাধানের জন্য শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো। একটু আগেই সেকথা বলা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া মুজিব বৈঠক শুরু হয়। পরবর্তীতে ভুট্টো ঐ আলোচনায় যোগ দেন। ২২ মার্চ পর্যন্ত ৮ দিন এক নাগাড়ে এই আলোচনা চলে। তাদের মধ্যে কি আলোচনা হয় সেই কথা সরকারিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সরকার আজ পর্যন্ত জনগণকে জানায়নি। অথচ ঐ ৮ দিনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমস্ত প্রশ্নের জবাব। শেখ মুজিব স্বাধীনতা চেয়েছিলেন কি না, কেন পাকিস্তান বাহিনী ২৫ মার্চের কালো রাতে বাংলাদেশিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ইত্যকার যাবতীয় প্রশ্নের জবাব রয়েছে ঐ ৮ দিনে।
সম্ভবত ঐ ৮ দিন আর কোনো সময় দিনের আলোর মুখ দেখবে না। তবে যে সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে সেটি হলো এই যে, এই আলোচনায় শেখ মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সারা পাকিস্তানের জন্য একটি খসড়া শাসনতন্ত্র উত্থাপন করেছিলেন। ঐ শাসনতন্ত্রের মূল বিষয় ছিলো:
দেশে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা প্রবর্তন।
পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গঠন।
পাকিস্তানের থাকবে দুটি কেন্দ্রীয় রাজধানী। একটি বাংলাদেশের ঢাকায় এবং অপরটি পাঞ্জাবের ইসলামাবাদে।
ফেডারেল পার্লামেন্ট অর্থাৎ জাতীয় সংসদের সদর দফতর থাকবে ঢাকায় এবং ফেডারেল কোর্টের সদর দফতর থাকবে ইসলামাবাদে।
কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকারের কর ধার্য্যের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। প্রাদেশিক সরকারগুলো কর-রাজস্ব আদায় করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ চালানোর জন্য প্রাদেশিক সরকারগুলো চাঁদা হিসেবে রাজস্বের একটি অংশ ফেডারেল সরকারকে দেবে। সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের চাঁদার পরিমাণ হবে কেন্দ্রকে প্রদেয় মোট অর্থের ২৭ শতাংশ।
স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান বিলুপ্ত হবে। তার পরিবর্তে আসবে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম। এই পদ্ধতির অধীনে বাংলাদেশের জন্য প্রতিষ্ঠিত হবে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক।
পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের নতুন নামকরণ হবে। সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাবের নাম অপরিবর্তিত থাকবে। তবে পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নাম হবে পাখতুনিস্তান।
কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পাদনের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। প্রাদেশিক সরকারগুলো বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করবেন। এমনকি পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসিত প্রদেশগুলোর মধ্যেও একটি প্রদেশের সাথে অপর প্রদেশের বাণিজ্য চুক্তি সাক্ষরিত হবে।
পাঁচ
প্রিয় পাঠক, শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন নি। সেটি শেখ হাসিনাও স্বীকার করেছেন। কিন্তু ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খানের কাছে তিনি যে খসড়া সংবিধান পেশ করেছিলেন সেটি ছিল আসলে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের ‘চার্টার ফর ইনডিপেনডেনস’ বা স্বাধীনতার সনদ। এটি যখন ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খানের হাতে পৌঁছে তখন তারা বিলক্ষণ বুঝতে পারেন যে, শেখ মুজিব পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার দাবি করেছেন। এই সনদ পেশের পর তাজউদ্দীন আহমাদ ঘোষণা করেন, ‘আর আলোচনা নয়, আমরা চাই ঘোষণা।’ (No more disscussion, we want
declaration).
তাজউদ্দীনের এই বিবৃতির পর ২৫ মার্চের কালো রাতে বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক বাহিনী। শুরু হয় স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
যারা বলেন যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতা নয়, পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন চেয়েছিলেন তারা ইতিহাস আশ্রয়ী নন। তাদের বক্তব্য ও ব্যাখ্যাও সঠিক নয়। শেখ মুজিব স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি অর্জনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন দারুণ কৌশলী। আমার মতে, তিনি ছিলেন মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।