হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ : দেশে এসব কী হচ্ছে! আমরা কোথায় যাচ্ছি! এমন শঙ্কা এখন সাধারণ মানুষের মনে। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশনে যেসব শিউরে ওঠার মতো খবর প্রকাশ ও প্রচার হয়, তা দেখে ভীত না হয়ে পারা যায় না। অজানা আতঙ্ক পেয়ে বসে। কখন যে কে অঘটনের শিকার হবে, এ আশঙ্কা নিয়ে সাধারণ মানুষকে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। বাইরে তো বটেই, ঘরেও কেউ স্বস্তিবোধ করছে না। দেশের পত্র-পত্রিকাগুলোর দিকে তাকালে কেবল বিপদের খবরই বেশি চোখে পড়ে। আনন্দ ও আশার দেখা যায় না বললেই চলে। এমন কোনো দিন নেই, যেদিন মৃত্যুর খবর নেই। সব মৃত্যুই অস্বাভাবিক এবং অনেকটা পৈশাচিকও। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির খবর বলতে কিছু নেই। মনুষ্যসৃষ্ট এসব জিঘাংসামূলক অপকর্মের পাশাপাশি প্রকৃতিও যেন ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তা না হলে বজ্রপাত বা ঠাটা পড়ে ৬০-৬২ জনের মৃত্যু হবে কেন? দেশে আগেও ঠাটা পড়ত। মানুষও মরত। তবে এরকম গণহারে নয়। হাতেগোনা দুয়েকজন। এখন বলা হচ্ছে, বিগত কয়েক বছরে এই ঠাটা পড়া এতটাই বেড়েছে যে, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এদিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। আগে ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে পরিচিত ছিল। বর্ষা এলে অনিবার্যভাবেই বন্যা হবে, ফসল-জনপদ ভেসে যাবে, ঝড়ে সব ল-ভ- হবে, এসব দুর্যোগ ধরেই নেয়া হতো। প্রাকৃতিক এসব দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বাংলাদেশ এখন অনেকটা অর্জন করলেও প্রকৃতি নতুন অস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে ভূমিকম্পের হার বেড়েছে। অল্প বিরতি দিয়ে প্রায়ই ভূমিকম্প হচ্ছে। একেকটি ভূমিকম্প হয় আর ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা সারাক্ষণ ফূর্তিতে মেতে থাকেন, তারাও আল্লাহ আল্লাহ করতে শুরু করেন। ‘ভূমিকম্প হচ্ছে এবং কত মাত্রায় হয়েছে’ এ ধরনের পোস্টও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেয়া হয়। ভূমিকম্পের পর গত কয়েক দিনে যেভাবে ঠাটা পড়া শুরু হয়েছে, তাতেও ফেসবুকাররা আল্লাহ আল্লাহ করে উঠছে। দেশের মানুষ যতই ফূর্তিতে থাকুক না কেন, বিপদে যে তাদের ভেতরকার ধর্মীয় চেতনাবোধ দ্রুতই জাগ্রত হয়ে ওঠে, তা ভূমিকম্প ও বজ্রপাত বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বোঝা যায়। আসলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করা ছাড়া কোনো গতিও থাকে না। পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই বা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর হিসেবে পরিচিত কোনো ব্যক্তিও মানুষকে এ বিপদ থেকে উদ্ধারের ক্ষমতা রাখে না। তারাও অসহায় হয়ে পড়ে। তবে মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয় থেকে মানুষ নিজেদের রক্ষা করতে পারে এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নিতে পারে। আবার এ বিপদ মানুষ বিশেষ করে যারা নিজেদের বিশ্বের ক্ষমতাবান মনে করে তারা স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের ওপর চাপিয়েও দেয়। যেমন বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ হাসিলের জন্য একেকবার একেক ইস্যু সৃষ্টি করে পররাষ্ট্রের ওপর দোষ চাপিয়ে এবং এ দোষে সে রাষ্ট্রের ওপর হামলা চালিয়ে তছনছ করে দেয়। তার মূল ইস্যুটি হচ্ছে ‘জঙ্গিবাদ’ ও ‘সন্ত্রাসবাদ’। আর তার নীতি অনুযায়ী এসবের সাথে একমাত্র মুসলমানরাই জড়িত। তাই এই অস্ত্র ব্যবহার করে ইরাকের মতো সমৃদ্ধ দেশ তছনছ করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলমান দেশে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনের নাম করে জনপদের পর জনপদ এবং লাখ লাখ নিরীহ সাধারণ মুসলমানকে নিশ্চিহ্ন করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা কেবল বাহানা খোঁজে কীভাবে মুসলমান নিধন করা যায়। প্রয়োজনে নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গের মতো হীন কাজ করতেও দ্বিধা করে না। যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সরকারই যে মূল নায়ক ছিল, তা অসংখ্য পুস্তক, সিনেমা ও প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়েছে। বলা হয়, এই হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র লাদেন ও আল-কায়েদা সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আইএস নামক যে ‘ফেনোমেনন’, এর সৃষ্টির নেপথ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে। এই আইএসই এখন তার অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠেছে এবং তার ফেনোমেনন মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। এখন তারা টার্গেট করেছে বাংলাদেশকে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও আইএস সৃষ্টি হয়েছে বলে জোর গলায় বলে যাচ্ছে।
দুই.
ইরাক, ইয়ামেন, লিবিয়া, মিসর, তিউনিসিয়াসহ অন্যান্য মুসলমান অধ্যুষিত দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কেন হামলা চালিয়েছে, তার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। এসব দেশ তো তাদের কোনো ক্ষতি করেনি। সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি, হোসনি মোবারকসহ অন্য রাষ্ট্রপরিচালকদের একনায়কতন্ত্র ও গণতন্ত্রহীনতার অভিযোগেই কি এসব দেশে ধ্বংসলীলা চালানোর কোনো যুক্তি হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাষ্ট্রগুলো হামলা চালানোর আগে কি এসব দেশের মানুষ অশান্তিতে ছিল? বরং আমরা জানি, এসব দেশের জনগণ যুগের পর যুগ তাদের শাসকদের মেনে নিয়ে ভালোই ছিল। সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিল। তাহলে কেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো এসব দেশকে অশান্ত করে তোলে এবং হামলা চালায়? একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, এসব মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলো সম্পদ ও শক্তিতে খুবই সমৃদ্ধশালী ছিল। তাদের অগাধ সম্পদ ছিল এবং স্বাবলম্বী জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্থনৈতিক ও সময়শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নেতৃত্বের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। বলাবাহুল্য, এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে খুব একটা তোয়াক্কা করত না। এটাই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা মনে করতে শুরু করে, মুসলমান অধ্যুষিত এসব দেশ যদি এভাবে এগোতে থাকে তবে, তাদের বিশ্বমোড়লগিরি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এটা তারা মেনে নিতে পারেনি, এখনও পারছে না। ফলে সমৃদ্ধ এ দেশগুলোকে রোখার একমাত্র পথ হচ্ছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের তত্ত্ব হাজির করা এবং দেশগুলোকে এই অপবাদ দেয়া। তারা তাদের মিশন হাসিল করার জন্য পথভ্রষ্ট মুসলমানদের একটি গোষ্ঠীকে বেছে নেয় এবং তাদের দ্বারা নিজেদের দেশে কিছু ঘটনা ঘটায়। এসব ঘটনার জের ধরে পুরো মুসলমান জাতির ওপর তার দায় চাপিয়ে এবং জঙ্গি আছে বলে সেসব দেশে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ হামলা ও কূটচাল দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। এতে তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। প্রথমত জঙ্গি অপবাদ দিয়ে মুসলমান নিধন করে এবং দ্বিতীয়ত দেশগুলোর তেল সম্পদ লুটে নেয়। মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য প্রথমে তারা আল-কায়েদা নামক ফেনোমেনন তৈরি করে। এ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আফগানিস্তানসহ মুসলমান দেশগুলোতে তারা একের পর এক হামলা চালিয়ে নিরীহ মুসলমান নাগরিক হত্যা, জনপদ ধ্বংস এবং লাখ লাখ মুসলমানকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করে। আল-কায়েদা পর্ব শেষ হতে না হতে সৃষ্টি করে আইএস নামক আরেক ফেনোমেনন। দেখা যাচ্ছে, আইএস দমন ও ধ্বংস করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলো টুঁ শব্দ করছে না। অথচ তারা ইচ্ছা করলে এক নিমেষে হামলা চালিয়ে আইএস ধ্বংস করে দিতে পারে। তা তারা করছে না। কারণ আইএস ধ্বংস করে দিলে তাদের হাতে মুসলমানদের জঙ্গি অপবাদ দেয়ার নতুন কোনো অস্ত্র থাকবে না। এখন এই আইএসই হচ্ছে মুসলমান নিধন ও মুসলিম বিশ্বকে অশান্ত রাখার তাদের মূল অস্ত্র। একে অন্যান্য মুসলমান দেশে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এর বীজ বপনের চেষ্টা করছে এবং নিজেদের অঞ্চলে কিছু হামলার ঘটনা ঘটিয়ে জিইয়ে রেখেছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেছে। সেসব দেশে তাদের কলের পুতুল আইএস স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কাজ করে চলেছে। কাজেই এখন তারা দৃষ্টি দিয়েছে এই উপমহাদেশের দিকে। বিশেষ করে বাংলাদেশ তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। এর কারণ ছোট্ট আয়তনের এই দেশে শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমান শান্তিতে বসবাস করে। বাংলাদেশের মুসলমানদের এই শান্তি তাদের সহ্য হচ্ছে না। এ ছাড়া ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলের গেটওয়ে হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো তাদের এক ঢিলে দুই পাখি মারা নীতি প্রয়োগ করতে চাচ্ছে। মুসলমানদের জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করে দমন প্রক্রিয়া অবলম্বন এবং এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা নিয়ে এগোচ্ছে।
তিন.
বাংলাদেশে আইএসের লেশমাত্র না থাকা সত্ত্বেও আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি, বর্তমান সরকারের আমলে জঙ্গি ধরেই আইএস বলে এন্তার প্রচার চালাতে। এসব তথাকথিত জঙ্গি ধরা মাত্রই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাড়ম্বরে প্রেস কনফারেন্স করে বলতে শুরু করত, এরা আইএস সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রও বেশ মনোযোগ সহকারে এসব কথা শুনেছে আর মনে মনে হেসেছে। কারণ তার অভিলাষেরই প্রতিধ্বনি করছে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের অর্ধেক কাজ মনের অজান্তেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করে ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রও ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে। শুরুতে মিনমিন করে আইএস দমনে আমরা সরকারের সাথে কাজ করতে চাই বলতে থাকে। বিলম্বে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের এ কথার মর্মার্থ যেন সরকার বুঝতে পারে এবং টনক নড়ে। সরকার উপলব্ধি করতে পারে, তাদের কাগুজে বাঘকে সত্যিকারের বাঘে পরিণত করতে যুক্তরাষ্ট্র উঠেপড়ে লেগেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার হাত না ধরে উল্টো বলতে শুরু করে, দেশে কোনো আইএস নেই। ততদিনে মনে হয় দেরি হয়ে গেছে। এর মধ্যেই হয় সিলেক্টিভ কিলিং। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক বিদেশি নাগরিক থেকে শুরু করে ইমাম, মুয়াজ্জিন, পুরোহিত, ভিক্ষু, ইসলামবিদ্বেষী ব্লগার হত্যাকা- ঘটতে থাকে। আর এর বেশির ভাগের দায় স্বীকার করা হয় আইএস বা তার অঙ্গ সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নামে। বিশ্লেষকদের অনেকে আকারে-ইঙ্গিতে বলতে চেষ্টা করেন, এসব ঘটনার সাথে বিদেশি ষড়যন্ত্র রয়েছে বা তাদের হাত রয়েছে। তাদের এ ধারণা যে একেবারে অমূলক নয়, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের একসঙ্গে কাজ করার পুনঃপুনঃ আগ্রহ ব্যক্ত করা থেকে। সর্বশেষ ইউএস এইড-এ চাকরিরত এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা সমকামী জুলহাজ হত্যাকা- যেন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোকে তাতিয়ে দেয়। এ নিয়ে তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তার মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে এ মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে পাঠিয়ে দেয়। তিনি এসেই বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করবে। তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এতদিন যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে আকারে-ইঙ্গিতে কথা বললেও এখন সে সরাসরি বলতে শুরু করেছে এবং এর সাথে ভারতকেও যুক্ত করেছে। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য হিন্দুতে সংবাদ প্রকাশিত হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ইস্যুতে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একযোগে কাজ করবে। নিশা দেশাইয়ের সফরের পরপরই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করও বাংলাদেশ সফর করেন। গত ১২ মে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ দমন করবে। এ কথাও বলেন, এ ইস্যুতে দুই দেশ একে অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে নয়াদিল্লি। অর্থাৎ স্বশরীরে হাজির হয়েও যদি সহযোগিতা করতে হয়, তাই করবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকও বলেছেন, সন্ত্রাস দমনে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে কাজ করবে। আমরা সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করছি। এ বিষয়ে তথ্য বিনিময় করেছি। নিশা দেশাই, জয়শঙ্কর ও শহীদুল হকÑ এই তিনজনের বক্তব্যে ‘করব’ ও ‘করছি’ নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিষয়টি পরিষ্কার নয়। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে তিন দেশ না দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে নাকি করবেÑ এ বিষয়টি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জয়শঙ্কর যখন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত কীভাবে কাজ করবে। এ কথা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, আমরা তো বলিনি।’ অন্যদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, ‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সব কিছুতেই একসঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে চিন্তা করে, এটা অবশ্যই না।’ পাঠক লক্ষ্য করুন, বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কী উদ্বেগ ও বিতর্ক। তাদের এই উদ্বেগ থেকে প্রতীয়মান হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, বাংলাদেশকে এ দুটি দেশ যেন জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের আখড়া বানিয়েই ছাড়বে। তা না হলে তারা এত কথা বলবে কেন? বাংলাদেশে কী এমন হয়ে গেছে যে, দুই দেশকে একেবারে উঠেপড়ে লাগতে হবে? বাংলাদেশে কী যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো স্কুল, রেল স্টেশন, জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় গোলাগুলি বা ভয়াবহ বোমাবাজির মতো ঘটনা ঘটছে? ভারতে অত্যন্ত উগ্র মৌলবাদী সংগঠন আরএসএস এবং তাদের প্রকাশ্য হিংসাত্মক কর্মকা- ঘটানোর মতো এমন কোনো সংগঠনের আবির্ভাব কি ঘটেছে? হ্যাঁ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে কথিত যে সংগঠনটি রয়েছে, তাদের প্রকাশ্য অস্তিত্ব আছে কিনা তা বাংলাদেশের মানুষ এখনও নিশ্চিত নয়। তারা কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখ থেকেই এ সংগঠনের নাম শুনছে। তবে এই সংগঠনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কি এবং তার শীর্ষ পর্যায়ের নেতা কারা, এ সম্পর্কে তারা কিছুই জানে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায়ই শোনা যায়, তাদের দমন করা হয়েছে। এখন এমন এক ভাসমান সংগঠনকে কি সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের মূল উৎস হিসেবে ধরা যায়? দেশের জনগণ তা মনে করে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষের মনে কোনো দিনই এ ধরনের চিন্তা ছিল না, এখনও নেই। তাহলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের যে কথা বলা হচ্ছে, তা কেন বলা হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর পাঠক ইতোমধ্যে পেয়ে গেছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্র এসব আনসারুল্লাহ বাহিনী-টাহিনীর নাম নিচ্ছে না। তারা কেবল আইএসের কথাই বলছে। কারণ তারাও জানে, এসব রুটলেস আনসারুল্লাহ দিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের ধোঁয়া তোলা যাবে না। এ জন্য তার প্রয়োজন আইএস। এর অস্তিত্ব এখানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তা নাহলে হবে না। তবে এ কথা না বললেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে আমাদের দেশ নিয়ে নাক গলানোর সুযোগ সরকারের নীতিনির্ধারকরাই করে দিয়েছেন। এখন না বললেও কিছু দিন আগ পর্যন্ত দেশে আইএস আছে বলে তাদের ক্রমাগত বক্তৃতা-বিবৃতিই এদেশে আইএস নামক বীজটি বপনের সুযোগ করে দিয়েছে। এমনকি প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপরও এর দায় চাপানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তাদের আন্দোলন-সংগ্রামকে আইএসের ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এই কিছু দিন আগেও সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন, দেশে আইএস না থাকলেও এর ভাবধারার মানুষ রয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা লাভ ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের এই আত্মঘাতী বক্তব্য-বিবৃতি যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হতে পারে, এ বিষয়টি তারা বেমালুম হয়ে গিয়েছিলেন। এখন এই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকেই লালন এবং তা দমন করার নামে যুক্তরাষ্ট্রসহ ভারত উঠেপড়ে লেগেছে। তারা বাংলাদেশকে একটি কুরুক্ষেত্রে পরিণত করার মিশন নিয়ে নেমেছে। এর লক্ষ্য যে মুসলমান নিধন, তা বোধকরি পাঠকদের ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই।
চার.
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ এখন এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। দেশের মানুষ শংকিত। তারা নিরাপদবোধ করছে না। জীবনযাপনের টানাপড়েনের মধ্যে জান বাঁচাতে তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দলমত নির্বিশেষে সবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এ উদ্যোগ নেয়ার মূল দায়িত্ব সরকারের। ‘সবকিছু ঠিক আছে’ বলে আশ্বস্ত করার এমন কথা এখন সাধারণ ও সচেতন মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। দেশ ‘ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড’-এর মধ্যে রয়েছে, এটা সরকারও যে বোঝে না তা মনে করার কারণ নেই। আমরা প্রত্যেকেই আশা করি, এ পরিস্থিতি উত্তরণে সরকার সফল হোক। তবে সরকার যদি গোঁ ধরে মনে করে, এই ঘোরতর সংকটকাল একাই সামাল দিতে পারবে, তবে তা সম্ভব নয়। এতে হয়তো গোঁ ধরে কিছুকাল ঠেলেঠুলে চলতে পারবে, তবে খুব বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। সরকারকে বাস্তব এই পরিস্থিতি বুঝতে হবে। তাই ‘ইগোস্টিক’ বা ‘অ্যারোগেন্ট’ না হয়ে সফিস্টিকেটেড হতে হবে। সংকট উত্তরণে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশকে অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে ধরতে বিশ্ব মোড়লরা যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে, এ থেকে বের হয়ে আসতে ঐকমত্যের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মানুষ এ ডাকেরই অপেক্ষায় আছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।