Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ন্যায় বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্র

প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
বাংলাদেশের মানুষ কর্মক্ষম। তাই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এর সুফল দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। তার জন্য দরকার দেশে ন্যায় বিচার, সুশাসন ও নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র। এই তিনটি জিনিস ছাড়া অর্থনীতির সুফল মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব নয়। কাজেই একটি উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্রগড়ার পূর্বশর্ত হলো, ন্যায় বিচর, সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এককেন্দ্রিক বা কর্র্তৃত্ববাদী শাসনে পৃথিবীতে অনেক সম্ভাবনাময় দেশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সুস্পষ্ট উদাহরণ। কয়েক বছর আগেও এসব দেশে আমাদের জনশক্তি রফতানি হয়েছে। ন্যায় বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্র না থাকায়, এসব দেশে এখন অশান্তি বিরাজমান; নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় তারা জর্জরিত। এখান থেকে বাংলাদেশকে শিক্ষা নিতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে মন-মানসিকতায় ও আচার-আচরণে, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিভাজন থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের রাজনৈতিক সংস্কৃকি গড়ে তুলতে হবে। কেননা মাথা যেমন সমস্ত শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি দেশকে এবং দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে। রাজনীতিতে সংকট জিইয়ে রেখে কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সুদূরপরাহত। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনিত। এটি সবাইকে আশাহত করে, বিনষ্ট করে উদ্যম ও উদ্দীপনাকে। কাজেই রাজনৈতিক বিভাজন ও হানাহানি থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করতে হবে, জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে একটি সুস্থ, সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের সামনে যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে চ্যালেঞ্জও। আগামী দিনগুলোয় চীন, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পিলিপাইনসহ প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তুমুল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের দিকে বাংলাদেশকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা এ দু’টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুলপরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে এ দুটি দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে। তারা বাংলাদেশের বাজার ধরতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকেও চেষ্টা করতে হবে কিভাবে এ দুটি দেশে তার পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা যায়। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে-উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশকে ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে যা যা সহযোগিতার দরকার-ভারতের, বাংলাদেশকে করতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণেও। বাংলাদেশকে চীনের বাজারে প্রবেশ করতে হলে ভারত, ভুটান ও নেপালের সহযোগিতার প্রয়োজন। তাছাড়া মিয়ানমার দিয়েও বাংলাদেশ চীনে প্রবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশের ‘স্ট্যাট্রেজিক’ সুবিধাগুলো এ অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের নিয়ামক। রাজনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। উপমহাদেশ এবং এ অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখ-ের বৈচিত্র্য দিয়ে। বাংলাদেশের তিন দিকজুড়ে রয়েছে ভারত। তারপর দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার। এর পাশে রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া। তাছাড়া রয়েছে ভুটান, নেপাল ও সিকিম। ভৌগোলিক অবস্থানের দিকদিয়ে এই প্রতিটি দেশ খুবই সন্নিকটবর্তী। বাংলাদেশ থেকে নেপালের দুরত্ব মাত্র ১৮ মাইল, ভুটানের ৪৫ মাইল, এবং চীনের বর্ডার ৪০ মাইল। তাছাড়া বাংলাদেশ সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা শুরু সমুদ্রের জলরাশি দিয়ে। আর এ মহাসমুদ্রই বাংলাদেশকে দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ খ্যাতি। তাই বাংলাদেশকে বলা হয় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থল। এ জন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এক বিরাট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে আরও জোরালো ও শক্তিশালী করেছে। এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই রাজনীতিবিদদের পথ চলতে হবে এবং তৈরি করতে হবে কর্ম-কৌশল।
আগামী দিনগুলোয় যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপরের তালিকায় ওঠে আসবে, এরমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। স্ট্র্যাটেজিক দিকদিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এটি বাংলাদেশের জন্য চমৎকার রাজনৈতিক সুযোগ। এজন্য বাংলাদেশকে দেখতে হবে ভিন্ন আঙ্গিকে ও ভিন্ন দৃষ্টিতে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, সিকিম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল। তাছাড়া ‘সেভেন সিস্টার’ বলে খ্যাত ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রবেশ দ্বারও বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল। ফলে প্রায় শত কোটি মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকা- নিয়ন্ত্রিত হবে বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশ ছোট কোনো জনপথ নয়; জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের অষ্টম রাষ্ট্র। বিশ্বের প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি। পরিবর্তিত বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ আরও বড় বড় দেশ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষ! তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান! জনশক্তি রফতানি ও ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে! কাজেই বাংলাদেশের শত্রু এখন চর্তুমুখী। ওপরে উঠতে হলে বাংলাদেশকে এসব চিন্তা মাথায় রাখতে হবে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে; সুনিশ্চিত করতে হবে ন্যায় বিচার, সুশাসন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং গণমাধ্যমরে স্বাধীনতা। তাহলেই কেবল একটি দেশের অর্থনীতির আকার বড় হতে পারে, দেশটি হতে পারে উন্নত, আধুনিক একটি দেশ।
বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কর্মক্ষম। গত ২০ বছরে প্রায় ৫ কোটি উদ্যমী, তরুণ ও যুবক যোগ হয়েছে বাংলাদেশের জনশক্তিতে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, জনশক্তি ও বেসরকারি খাত একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে, যা একটা রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বে একটি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের খ্যাতি অর্জন করেছে। পাশাপাশি এ শিল্পটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পের গৌরবের অধিকারি। তাছাড়া চা, চামড়া, ওষুধ ও হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতেও বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অবস্থান রয়েছে। এসব কোনো কল্পকাহিনী নয়, বাস্তব সত্য; তাহলে এ দেশের উন্নয়নকে আটকে রাখার সাধ্য কার? যদি নিজেরা মারামারিতে লিপ্ত না হই-নিজেদের মধ্যে যদি শৃঙ্খলা না থাকে, কোনো সিস্টেম না থাকে; না থাকে দায়িত্বশীলতা। কাজেই বাস্তববাদী হতে হবে, দূরের জিনিস দেখতে হবে; জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে, নদীগুলোকে খনন করে মাছ চাষ ও সম্পদের উৎসে পরিণত করতে হবে, কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে, কারিগরি শিক্ষার ওপর অধিক জোর দিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী গণপরিবহন ব্যবস্থা, রেলকে করতে হবে যুগোপযোগী ও আধুনিক, রাজধানী ঢাকাকে গড়ে তুলতে হবে পরিকল্পিত শহর হিসেবে। সর্বোপরি সংঘাতপূর্ণ, অশান্ত ও হানাহানির রাজনীতি থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। রাজনীতিবিদদের মন বড় করতে হবে এবং দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। অনৈক্য ও বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি পরিত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে এক প্লাটফর্মে থেকে দলমতের উর্ধ্বে উঠে এক সুরে কথা বলতে হবে। অহমিকা ত্যাগ করে পরমতসহিষ্ণুতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে হবে এবং সবদলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের পথ সুগম করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে, স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নবষধুবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স



 

Show all comments
  • babul ২০ মে, ২০১৬, ১২:১৭ এএম says : 0
    good writng
    Total Reply(0) Reply
  • anicur rahman ২০ মে, ২০১৬, ১২:২৪ এএম says : 0
    excellent write up
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ