বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
চেঙ্গীস বংশের চতুর্থ শাখা ‘ইলখানি’ নামে খ্যাত। তোলাই বা তাওয়াল্লী খান ছিলেন চেঙ্গীস খানের সর্ব কনিষ্ট ও চতুর্থ পুত্র। তার ভাগে পড়েছিল ইরান (পারস্য)। তার কুখ্যাত পুত্র হালাকু খান ছাড়াও আরও দুই পুত্র মঙ্গু খান ও কোবলাই খানের নাম বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়। এ ভ্রাতৃত্রয়ের মধ্যে কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। কোবলাই খান সম্পর্কে বলা হয় তিনি প্রপিতা চেঙ্গীস খানকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনে।
তবুও কোনো কোনো অমুসলিম লেখক বলেছেন, ‘কানা আফুফান আলাল মুসলিমিন’ অর্থাৎ কোবলাই খান ছিলেন মুসলমানদের প্রতি সহানুভ‚তিশীল। বাগদাদ ধ্বংসকারী হালাকুখানের পুত্র তাগুদার (তাকুদার) থেকে ইসলাম গ্রহণের সূচনা। হালাকু খান ‘ইলখানিয়া রাষ্ট্রের’-এর প্রতিষ্ঠাতা হলেও তার পুত্র তাগুদার এ বংশের ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম বাদশাহ। তিনি স্বীয় ভ্রাতা আবাক খানের স্থলাভিষিক্ত হন এবং তারা দু’জনেই ছিলেন চেঙ্গীস খানের প্রপৌত্র। তাগুদারের ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি অদ্ভুত ও চমৎকার। তার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে একজন খ্রিষ্টান লেখকের ভাষ্য:
তাগুদারের শিক্ষাদীক্ষা খৃষ্ট ধর্ম অনুযায়ী হয়েছিল। শৈশবে ‘ব্যাতেসমা’ করা হয়, অর্থাৎ ব্যাপটাইস করা হয়। খ্রিষ্টান রীতি অনুযায়ী খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা হয় এবং তার নাম রাখা হয় ‘ন্যাকুলাস’। কিন্তু তিনি যখন বড় হন তখন মুসলমানদের সংস্রবে থাকতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। এক সময় তিনি খ্রিষ্ট ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়ে যান এবং নিজের নাম রাখেন সুলতান আহমদ। সাধ্যমত তিনি চেষ্টা করেন যে, সকল তাতারি যেন ইসলাম গ্রহণ করে। তিনি এ কাজের জন্য লোকদের নানাভাবে দান করতেন, পুরস্কৃত করতেন, তাদেরকে উপযুক্ত পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতেন এবং তাদের প্রতি উত্তম আচরণ করতেন। এ কারণে তার সময়ে বহু তাতারি মুসলমান হয়ে যায়। তাগুদারের মুসলমান হয়ে যাওয়ার ফলে তাতারিদের অনেকে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। আরগুন খান নামক এক শাসক তার ওপর আক্রমণ চালায়। তাগুদার তার সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে শাহাদত বরণ করেন এবং আরগুন খান রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে। সে ১২৮৪ থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল। তার শাসনামলে তাতারি মুসলমানদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায় এবং সরকারি পদসমূহ এবং চাকরি হতে তাদেরকে বাদ দেয়া হয়।
ইলখানি বংশের সপ্তম বাদশাহ গাজান খান ১২৯৫ সালে ক্ষমতাসীন হন। তিনি ছিলেন এ বংশের সবচেয়ে প্রতাপশালী বাদশাহ। তিনি মুসলমান হয়ে যান এবং ইসলামকে ইরানের ‘শাহী মাজহাব’ ঘোষণা করেন। গাজান ছিলেন ইসলামে দৃঢ় বিশ্বাসী ও উৎসাহী মুসলমান। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে গভীরভাবে গবেষণা, অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান করতেন এবং বিভিন্ন মাজহাবের আলেম ও বিশেষজ্ঞদর সাথে ধর্মীয় বিষয়ে বাহাস-বিতর্কে লিপ্ত হতেন। বহু গবেষণা ও চিন্তাভাবনা করে, অত:পর তিনি মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। রাজকীয় সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ এবং শাসকগণ বাদশাহর অনুসরণ করেন এবং বিপুল সংখ্যায় তারা ইসলাম গ্রহণ করেন। বাদশাহ গাজান ফকির-দরবেশ ও আলেমদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত উদার, মুক্তহস্তে তাদেরকে দান করতেন। তিনি সূফী, সাধক ও আওলিয়ায়ে-কেরামের মাজার জিয়ারত করতেন এবং বহু মসজিদ স্থাপন করেন। মোট কথা, এ বাদশাহ নিজেকে সর্ব দিক দিয়ে একজন খাঁটি খোদা প্রেমিক মুসলমান রূপে প্রমাণ করেন। মুসলমান হওয়ার পর তিনি নিজের নাম রাখেন মাহমুদ। এ কারণে তিনি ইতিহাসে ‘গাজান মাহমূদ’ নামে প্রসিদ্ধ।
১৩০৪ সালে গাজান মাহমুদ ইন্তেকাল করেন এবং তার ভ্রাতা সুলতান মোহাম্মদ ‘খোদা বন্দা’ নামে ইরানের রাজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সুলতানের মাতা ছিলেন খ্রিষ্টান। শৈশবে তার শিক্ষাদীক্ষা হয়েছিল খ্রিষ্টান রীতিনীতিতে এবং তার নাম রাখা হয়েছিল ‘ন্যাকুলাস’ যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি নিজের স্ত্রীর তবলীগ প্রচারে মুসলমান হয়ে যান। বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘ন্যাকুলাস খান অর্থাৎ সুলতান মোহাম্মদ ‘খোদা বন্দা’র-এর মুসলমান হয়ে যাওয়ার ফলে মোগলদের মধ্যে বিরাট প্রভাব বিস্তার লাভ করে। বস্তুত সে সময় থেকে ইলখানিয়া সাম্রাজ্যে ইসলাম সকল মাজহাবের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে।’
ইসলাম প্রচারকদের প্রচার দ্বারা কেবল তাতারিরাই মুসলমান হয়নি বরং তাদের মধ্যে এমন সব বিখ্যাত খোদাভক্ত ও রসূলপ্রেমিক মনীষী তৈরি হয়েছেন, যারা বহু নাজুক ও কঠিন সময়ে ইসলামের সেবায় সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।