দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
ইসলামের সাধারণ ফারায়েজ
ও আহকাম এবং বিশেষ করে নামাজ এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়াবলী সম্পর্কে চিন্তা করার সময় একটি নির্দিষ্ট বিধানকে সর্বদাই নজরে রাখা দরকার। সেই বিধানাবলীই মূলত : ইসলামের আসল রহস্য এবং গোপন তত্তবলীর মূল নির্যাস।
ইসলামের আসল হাকীকত মাত্র একটিই। তাহলো তাওহীদ। এই তাওহীদ শুধু কেবল দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আধ্যাত্মিক চিত্তবৃত্তির উপরই নির্ভরশীল নয়; বরং তাহলো এমন কর্মানুষ্ঠানের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ততা, যেখানে সকলকেই ইসলামের প্রতিটি হুকুম-আহকামের সাথে পরিচিত হতে হয়। তাই ইসলামের অন্যান্য আহকামের মত নামাজও এই হাকীকত এবং বৈশিষ্ট্যাবলীর বিকশিত রূপ। নামাজের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কার্যক্রম, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি ইঙ্গিত-ইশারা দ্বারা পৃথক পৃথকভাবে সেই হাকীকত ও বৈশিষ্ট্যকে পরিস্ফুট করা অপরিহার্য।
তবে একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, দাওয়াতে মোহাম্মদী (সা:)-কে গ্রহণকারী লক্ষ-কোটি মুসলমানের উপর নামাজ ফরজ। এই অপরিহার্য এবাদত আদায়ের জন্য যদি নির্দিষ্ট কোন আকার-আকৃতি নিয়ম-পদ্ধতি এবং দিক ও সময় নির্ধারণ করা না হত, তাহলে সকল মুসলমান সমবেতভাবে কখনো তা আদায় করতে সক্ষম হত না। যদি তাদের মাঝে সকলকেই এই অনুমতি দেয়া হত যে, যিনি যেভাবে ইচ্ছা এবং যখন যেদিকে খুশী নামাজ আদায় করতে পারবেন, তাহলে ইসলামের একত্ববাদের নিয়ম-শৃঙ্খলা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত এবং নামাজীর দৈহিক ও আত্মিক কর্মকাÐের মাঝে একত্ববাদের মূল প্রবাহ কোনক্রমেই বিকশিত হত না, এমন কি সারা বিশ্বের লক্ষ-কোটি মুসলমান একক জামায়াতের আওতাভুক্তও হতে পারত না। তাদের মাঝে যদি প্রত্যেককেই এই অনুমতি দেয়া হত, যেদিকে যখন ইচ্ছা মুখ করে নামাজ পড়তে পারবে, তাহলে ইসলামে একত্ববাদের নেজাম ও বিধান কায়েম থাকত না। এমন কি বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাও অন্তরস্থিত তাওহীদের বিকাশ পরিস্ফুট হত না। বিশ্বব্যাপী লক্ষ-কোটি মুসলমানের মাঝে একতা, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার একাকীত্বও পরিদৃষ্ট হত না। মোটকথা এই একতা একত্ববাদীতার নিয়ম-শৃঙ্খলাকে সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলাই হচ্ছে তাওহীদের সবচেয়ে বড় চিহ্ন ও পরিচিতি। লক্ষ- কোটি মানুষের বিক্ষিপ্ত অন্তর ও দেহকে, একই দেহে এবং একই প্রতিকৃতির মাঝে এবং একই অন্তরপ্রসূর ধ্বনির মাঝে প্রতিন্বিত করা এভাবেই সহজ ও সম্ভব, যখন তাদেরকে একই আইন-কানুন, একই আকার-আকৃতি এবং একই কর্মকাÐের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করা হয়। সুতরাং মানব সমাজের যাবতীয় একতাভিত্তিক নিয়ম-শৃখংলা এই বিধানের উপরই প্রতিষ্ঠিত। জাতির একতা, সেনাবাহিনীর একতা, কোনও মজলিস ও সভা-সমিতির একতা, কোনও দেশ এবং সামাজ্যের একতা, মোটের উপর সবকটি একতা-কেন্দ্রিক নিয়ম-শৃংখলা এই নিয়মাবলীর উপরই প্রতিষ্ঠিত। আর এরই ফলশ্রæতিতে গড়ে উঠে এক মন-দেহ, এক রাষ্ট্র, জনপদ ও পৃথিবী।
নামাজে দৈহিক অঙ্গ সঞ্চালন :
একথাও সুস্পষ্ট যে, নামাজের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হচ্ছে, কতিপয় পবিত্র আশা-আকাঙ্খাকে প্রকাশ করা। মানুষের সহজাত স্বভাব এই যে, যখন মানুষের মাঝে কোনও নির্দিষ্ট আকাঙ্খা ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়, তখন অবস্থা অনুসারে তার মাঝে কোনও কাজ বা অনুপ্রেরণাও দেখা দেয়। রাগের সময় চেহারা লাল হয়ে যায়, ভয়ের সময় ফ্যাকাশে হয়ে যায়, আনন্দের সময় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে, চিন্তার সময় বিমর্ষ ও মলিন হয়ে পড়ে। যখন সে কাহারো নিকট কোন কিছু সাহায্য চায়, তখন উভয় হাত সম্প্রসারিত করে, কাউকে সম্মান দেখানোর জন্য দাঁড়িয়ে যায়, কাহারো প্রতি ন¤্রতা প্রকাশের সময় অধোবদন হয়ে যায়, এরচেয়েও বেশী দীনতা ও আনুগত্য প্রকাশের সময় মুখ নীচু করে, এমন কি কখনো পায়ের উপর মাথা ন্যস্ত করে। এগুলো হচ্ছে আকাঙ্খা ও অনুপ্রেরণা প্রকাশের ধারা। যা প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর মাঝেই কম-বেশী লক্ষ্য করা যায়। এই বিশ্লেষণের পর একথা বুঝে নিতে হবে যে, নামাজের দোয়া ও কালামসমূহকে যেভাবে মানুষের ব্যবহারিক কর্মকাÐের দ্বারা আদায় করা হয়, ঠিক সেভাবেই নামাজের আরকানসমূহ মানুষের সহজাত স্বভাবসিদ্ধ ও অভিব্যক্তির আকারে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
মানুষের আত্মিক কাজ-কর্ম ও প্রতিক্রিয়ার বিকাশস্থল হচ্ছে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ। কোনও মানুষের হাত-পা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হতে কোনরকম অভিব্যক্তি প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত একথা কেউ কল্পনা করতে পারে না যে, তার অন্তরে কি ভাব-ব্যঞ্জনা বা অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে। যদি এমনটি না হত, তাহলে প্রত্যেক মানুষই নিজের অধিকার ও সার্বিক মঙ্গলের দাবীদার হতে পারত। সমাজের কোন ব্যক্তিই তাকে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করতে পারত না। কিন্তুু এমন হলে সমাজ ও সভ্যতার বুনিয়াদ গোড়া থেকেই বিনষ্ট হয়ে যেত। মানুষের বাইরের কর্মকাÐ সম্পর্কে আল্লাহপাক যেমন সুপরিজ্ঞাত তেমনি আন্তরিক ও আভ্যন্তরীণ নকল ও হরকত সম্পর্কে তিনি অবহিত। এজন্য কেবলমাত্র বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা সম্পাদিত ক্রিয়া-কর্মই আল্লাহর নিকট একমাত্র লক্ষ্যণীয় বিষয় নয়, বরং বান্দাহদের উচিৎ নিজেদের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিককে একই কেন্দ্রে সন্নিবিষ্ট করে আরজ ও আকাঙ্খা প্রকাশ করা, নিজেদের হীনতা ও আনুগত্য প্রদর্শন করা। সত্যিকার অর্থে আনুগত্য ও কর্মসম্পাদনের ক্ষেত্রে দেহ ও মনের একান্ত নিবিষ্টতার দ্বারাই শুভফল লাভ করা সম্ভব। মানুষ দেহ এবং রূহ উভয় দিক থেকেই আল্লাহ পাকের মাখলুক। তাদের জীবনের এই উভয় অংশেই রয়েছে আল্লাহপাকের অসংখ্য দান ও অনুকম্পা, অজ¯্র নেয়ামত ও বরকতের পশরা। এজন্য তা’ একান্তই অপরিহার্য যে সেই ¯্রষ্টা, প্রতিপালক ও সর্বদয়ালু মহা মনিবের সামনে দেহ ও মন সহযোগে সেজদায় পতিত হওয়া, নিজের আরতী ও কাকুতি নিবেদন করা। একারণেই ইসলামী শরীয়তে দেহ ও মনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেই নামাজের আহকাম ও আরকান নির্বাচন করা হয়েছে।
উপরের আলোচনা হতে বুঝা যায় যে, মানুষের সহজাত স্বাভাবিক ক্রিয়া-কর্মের ও চিন্তাধারার প্রতিকৃতিতেই নামাজের আঙ্গিক কাঠামোকে বিন্যাস করা হয়েছে। দৈহিকভাবে আমরা কোনও মহান দাতার সম্মান এবং তার সামনে নিজের ভদ্রতা, শিষ্টাচার ও সৌজন্য এবং সম্মান প্রদশনের জন্য তিনটি পন্থা অবলম্বন করতে পারি। (ক) আমরা হয়ত দাঁড়িয়ে যাই, (খ) হয়ত তার প্রতি ঝুঁকে পড়ি এবং (গ) ভূমিতে মস্তক স্থাপন করি। নামাজের মাঝেও এই তিনটি অবস্থাই বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং পৃথিবীর শুভ আরম্ভ হতে আম্বিয়ায়ে কেরাম নামাজের যে শিক্ষা মানুষকে দিয়েছেন, সেখানেও আমরা এ তিনটি অবস্থার সমাহার দেখতে পাই। দাঁড়িয়ে যাওয়া (কিয়াম), ঝুঁকে পড়া (রুকু) এবং যমীনে মস্তক স্থাপন করা (সেজদাহ)।
আরকানে নামাজ :
একথা সুপরিজ্ঞাত যে, নামাজ মিল্লাতে ইবরাহীমীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। হযরত ইবরাহীম (আ:)-কে যখন আল্লাহর ঘর নিমার্ণের ও তার পবিত্র রাখার হুকুম প্রদান করা হয়, তখন এ কাজের উদ্দেশ্যও ব্যক্ত করা হয়। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, “এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, দÐায়মান হয়ে এবাদতকার,ি রুকু আদায়কারী এবং সেজদাহ পালনকারীর জন্য পাক-সাফ করুন। (সূরা হজ্জ : রুকু-৪) এই হুকুমের মাঝে নামাজের তিনটি রুকন : কিয়াম, রুকু এবং সেজদাহর বিস্তৃত ও পর্যায়ক্রমিক বিবরণ আছে। হযরত মারইয়ামের সময়ে বনী ইসরাঈলের শেষ পর্যায় ছিল। তার প্রতি খেতাব করে নির্দেশ করা হয়েছিল, হে মারইয়াম! স্বীয় প্রতিপালকের সন্নিধানে হাজির হয়ে বন্দেগী কর এবং সেজদাহ কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। (সূরা আলে ইমরান : রুকু-৫)
প্রচলিত তৌরাত পাঠেও নামাজের বিভিন্ন আরকানের কথা জানা যায়। কিন্তু মুস্কিলের কথা হচ্ছে এই যে, এর অনুবাদকারীরা ইবরানী ও ইউনানী শব্দাবলীর তরজমা নিজেদের খেয়াল-খুশী ও ধ্যান-ধারণা অনুসারে করেছেন। শব্দাবলীর তরজমা নিজেদের খেয়াল-খুশী ও ধ্যান-ধারণা অনুসারে করেছেন। যার ফলে মূল মর্মোদঘাটনের ক্ষেত্রে বহুলাংশে পর্দার আবরণ সৃষ্টি হয়েছে। মোটকথা ইবাদত এবং সম্মান প্রদর্শনের এ তিনটি তরীকা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর শরীয়তে এবং তাঁর বংশধরদের মাঝে জারী ছিল। নি¤েœ আমরা এর প্রত্যেকটির উদ্ধৃতি সমষ্ট্রিগত তৌরাত হতে পেশ করছি।
কিয়াম : অবশ্যই ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহর সন্নিধানে দাঁড়িয়েছিলেন। (পয়দায়েশ : ১৮-২২)।
রুকু: এবং হযরত ইব্রাহীম (আ:) যমীনের দিকে আরোও অবনমিত হয়ে আরতি জানালেন, হে আল্লাহ! (পয়দায়েশ : ১৮-২)
সেজদাহ : এবং একথা শুনে আল্লাহপাক বনী ইসরাঈলের প্রতি মনোযোগ স্থাপন করলেন এবং তাদের বেদনার প্রতি ¯েœহদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন, আর তারা নিজেদের মস্তক অবনত করল ও সেজদাহ করল। (নির্গমন ৪-৩১) তারপর ইব্রাহীম মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন এবং আল্লাহপাক তার সাথে কথাবার্তা বললেন, (পয়দায়েশ : ১৭-৩) তারপর ইব্রাহীম (আ:) স্বীয় সহচর নওজোয়ানদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা এখানে এই গর্দভটির পাশে অবস্থঅন কর, আমি এই ছেলেটির সাথে (স্বীয় পুত্রের কুরবানীর জন্য) সেখান পর্যন্ত গমন করব। সেখানে সেজদাহ আদায় করে পুনরায় তোমাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করব। (পয়দায়েশ : ২২-৫) তারপর সেই ব্যক্তি (হযরত ইসহাক (আ:)-এর দূত) মস্তক অবনত করল এবং আল্লাহ পাকের সেজদাহ আদায় করল এবং সে বললো, হে আমার পরওয়ারদিগার! ইবরাহীম (আ:)-এর প্রভু প্রকৃতই বরকতময়। (পয়দায়েশ : ২৪-২৬) এবং এমন হলো যে, যখন হযরত দাউদ (আ:) পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলেন, তখন তিনি আল্লাহকে সেজদাহ করলেন। (শামুয়েল : ১৫-৩২)।
যাবুর কিতাবে আছে, হযরত দাউদ (আ:) আল্লাহ পাকের কাছে ফরিয়াদ করলেন, “হে আল্লাহ! তোমারই ভয়ে ভীত হয়ে তোমার পবিত্র কেবলার দিকে মুখ করে আমি তোমাকে সেজদাহ করব।” (যাবুর : ৫-৭)।
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, মিল্লাতে ইবরাহীমীর মাঝে এবাদত এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে এ তিনটি পর্যায়ই প্রচলিত ছিল। আর ইসলামেও এগুলোকে বহাল রাখা হয়েছে। বর্তমান প্রচলিত ইঞ্জিলে দোয়া ও নামাজের উল্লেখ বহুস্থানে আছে। মথি ৬-৫ এবং ১৭-২১ এবং ২৬-৩৬ এবং মার্কস ১৪-২৩ এবং লুক ২২-৪১ ইত্যাদি শ্লোকে তার বিবরণ পাওয়া যায়। তবে একই ইঞ্জিলের বিভিন্ন স্থঅনে নামাজের বিভিন্ন অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। লুক-এ (২২-৪১) আছে হাঁটু ভেঙ্গে অবনত হওয়ার কথা। (হয়ত তা রুকু) মথি বলছে (২৬-৩৯) মুখ খুবড়ে পড়ে যাবার কথা। (সেজদাহ) আর অন্যান্য ইঞ্জিলে এ ব্যাপারে নীরবতা পালন করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আবির্ভাবের প্রাক্কালে ইহুদী ও নাসারাদের মাঝে যারা নামাজের পাবন্দ ছিল, তারাও এসকল আরকান আদায় করত এবং দাঁড়িয়ে তৌরাত অথবা যাবুরের বিভিন্ন আয়াত তেলাওয়াত করত এবং সেজদাহও আদায় করত। কুরআনুল কারীম সাক্ষ্য দিচ্ছে, “তারা সবাই এক বরাবর নয়, আহলে কিতাবের মাঝে এমন লোকও আছে যারা রাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে এবং সেজদাহ করে।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-১২) হাদীস শরীফে আছে, “রুকু অবস্থায় ইহুদেিদর মত উভয় হাত একত্রিত করে রেখ না।” (ফতহুল বারী, ইবনে হাজার, ২ খ: ২২৭ পৃ:)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, আরবের ইহুদীরাও নামাজের এসকল আরকান আদায় করত।
উম্মতে মোহাম্মদীর উপর ফরজ নামাজও যে সকল প্রাচীন আহকাম ও আরকানসহ অপরিহার্য হয়েছে, যা হযরত ইব্রাহীম (আ:) হতে আজ পর্যন্ত চলে আসছে। সুতরাং ‘ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলাম’-এর লেখকগণ এই বৈশিষ্ট্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন, “ইসলামী নামাজ তরতীব ও তরকীব অনুসারে বহুলাংশে ইহুদী এবং নাসারাদের নামাজেরই অনুরূপ।” (ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলাম : সালাত প্রবন্ধ, ৪ খ: ৯৬ পৃ:)
পবিত্র ইসলামের বৈপ্লবিক কর্মকাÐের দ্বারা এই খাজানাকে সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ইসলাম এর মাঝে নিহিত মানবিক ছোঁয়াচসমূহকে দূরীভূত করে দিয়েছে এবং অবলুপ্ত ফরজগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। বিস্মৃত নিয়মতান্ত্রিকতাকে সচল ও সজীব করেছে। প্রাণহীন নামাজের মাঝে প্রকৃত প্রাণসঞ্চারের পথ উন্মুক্ত করেছে। এর মাঝে পয়দা করেছে ইখলাসের জাওহার। একে বানিয়েছে দ্বীনের স্তম্ভ এবং স্বীয় অবিচ্ছিন্ন শিক্ষা ও কর্মপ্রবাহের দ্বারা এর বাহ্যিক আকার-আকৃতিকেও মানবিক পরিবর্তন হতে মাহফুজ করেছে। এভাবেই ইসলাম নামাজের চিরন্তন ফরজকে পরিপূর্ণতার দোড় গোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে, যার জন্য সৃষ্টির শুরুতেই এর চয়ন হয়েছিল।
এই বিষয়টি খুবই প্রণিধানযোগ্য যে, নামাজ শুধু কেবল তাসবীহ ও জিকরে ইলাহীর নামই নয়, বরং এর মাঝে আনুসঙ্গিক অনেকগুলো আরকানও রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সার্বিক আমল এবং সাহাবায়ে কেরামের নিয়মতান্ত্রিক কাজ-কর্ম ছাড়া পবিত্র কুরআনেও এই সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে। যুদ্ধ এবং ভয়ের সময় নামাজ কসর করা এবং আরকানগুলো সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি আছে। তারপর যখন ভয় দূরীভূত হয়ে যাবে, তখন নামাজকে বিধিবদ্ধভাবে আদায় করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “তোমরা নামাজসমূহ বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজকে হেফাজত কর এবং আল্লাহর সামনে আদবের সাথে দাঁড়াও, যদি তোমরা ভয় কর, তাহলে পদব্রজে হোক, অথবা আরোহী অবস্থায় হোক (নামাজ আদায় কর)। তারপর র্যখন ভয় চলে যাবে, তখন আল্লাহকে এভাবে- যেভাবে তোমাদেরকে শিক্ষঅ দেয়অ হয়েছে, যা তোমরা পূর্বে অবগত ছিলে না।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৩১) এই আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সেই জিকরে ইলাহীর একটি নির্দিষ্ট তরীকা ছিল। যার ব্যবহারিক সুরতই হচ্ছে নামাজ। এবং এর বিশ্লেষণই সূরা নিসাতে বিবৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে যুদ্ধের সময় এক রাকায়াত ইমামের সাথে নিয়ম মাফিক আদায় করার পর দ্বিতীয় রাকায়াত সম্বন্ধে এরশাদ হয়েছে, “(সুতরাং এক রাকায়াত) নামাজ আদায় করার পর আলাহকে দাঁড়িয়ে বসে ও এক কাতে শয়ন করে স্মরণ কর, তারপর যখন নিশ্চিন্ত ও নির্ভয় হয়ে যাবে, তখন নামাজ আদায় কর।” (সূরা নিসা : রুকু-১৫) এই আয়াতে দু’টো বিষয় বিবেচনা যোগ্য। (ক) এক রাকায়াত যা নিয়ম মাফিক আদায় করা হয়েছে, তাকে নামাজ বলা হয়েছে, এবং দ্বিতীয় রাকায়াত যা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়েছে এবং এবং শত্রæ প্রতিরোধের অবস্থায় পরিসমাপ্তি হয়েছে, তাকে শুধু আল্লাহর জিকির বলা হয়েছে। (খ) যুদ্ধের সময় সহজভাবে একামতে সালাতকে শব্দ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। অথচ জিকরে ইলাহ,ি তাসবীহ-তাহলীল এবং নামাজের কোন কোন আরকানও এর মাঝে শামিল রয়েছে। বরং শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, তারপর যখন নির্ভয় অবস্থঅ দেখঅ দেবে তখন নামাজ কায়েম কর। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ‘একামতে সালাত’ অর্থ জিকির, তাসবীহ, তাহলীল, হামদ, সানা ও তিলাওয়াতে কুরআন হতে ভিন্নতর। অর্থাৎ নামাজ কায়েম করার মাঝে জিকির, ফিকির, তাসবীহ, হামদ, সানা এবং কিরায়াত ছাড়াও আরোও কিছু আরকান শামিল রয়েছে। যা যুদ্ধাবস্থায় মওকুফ হয়ে গিয়েছিল। এই সাময়িক অসুবিধা দূরীভূত হয়ে যাওয়ার পর পরিশেষে নিয়ম মাফিক নামাজ আদায় করার পথ নির্দেশনা দান করা হয়েছে। এই আরকান সম্পর্কে সূরা বাকারাতে বলা হয়েছিল যে, যখন ভয় দূর হয়ে যাবে, তখন আল্লাহকে সেভাবেই স্মরণ কর, যেভাবে তিনি হুকুম করেছেন।
এখন আমাদেরকে দেখতে হবে যে, নামাজ কোন্্ কোন্্ আরকানসহ নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। এর জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) সারাজীবন কিভাবে আদায় করেছেন? এবং সাহাবাদেরকে কিভাবে নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন? কেননা নামাজের সার্বিক অবস্থার কথা অবিচ্ছিন্নভাবে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সময় হতে এখন পর্যন্ত চলে এসেছে। এ ব্যাপারে প্রত্যেক দোস্ত, দুশমন, স্বপক্ষীয় ও বিপক্ষীয় প্রত্যেক বন্ধুই জানেন যে, মুসলমানদের মাঝে সকলেই বিনা এখতেলাফে নামাজ আদায়ের ধারাবাহিকতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। এরপরও ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের জন্য কুরআনুল কারীম হতে এ ব্যাপারে প্রমাণ তুলে ধরা খুবই ভালো হবে। (চলবে)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।