বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলামী বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাসের নাম রজব। জাহিলিয়া যুগে তা বছরের গ্রীষ্মার্ধের প্রথম মাস ছিল। পরবর্তীকালে প্রক্ষেপণ পদ্ধতি মতে মাস যোগ করার রীতি বর্জিত হওয়ার ফলে প্রত্যেকটি মাস প্রতি বছর একই ঋতুতে নিয়মিতভাবে পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রজব মাসটি শীত এবং গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতেই ঘুরেফিরে আসে, যা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
বস্তুত দিন, রাত, সপ্তাহ, মাস ও বছরের সময়কাল নির্ধারণ করেছেন আল্লাহপাক। সূর্যোদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়টি দিন, সূর্যাস্ত হতে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়টি রাত। সাত দিনে এক সপ্তাহ, ৩০ বা ২৯ দিনে মাস এবং ১২ মাসে এক বছর সময়কাল নির্ধারণ করে সৃষ্টজগতের নিয়ম-শৃঙ্খলাকে তিনি বিধিবদ্ধ আইনের আওতায় বিন্যস্ত করেছেন। কিন্তু দুনিয়ার পন্ডিত ব্যক্তিরা আল্লাহর দেয়া দিন, মাস ও বছর গণনার নিয়মের বাইরে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতির অনুসরণ করে চলেছে। এটা খুবই পরিতাপের বিষয়, তা বলাই বাহুল্য।
রজব মাসটি প্রকৃতই একটি পবিত্র মাস। জাহিলিয়া যুগে এই মাসে হজের অঙ্গীভ‚ত অনুষ্ঠান ওমরা পালন করা হতো। সুতরাং এই মাসে আল্লাহপাকের তরফ হতে শান্তি বর্ষিত হতো। এই মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ ছিল। অথচ কুরাইশ এবং আরব গোষ্ঠীর মধ্যে এই মাসেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এ কারণে একে ফিজার সমর বা অবৈধ যুদ্ধ নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
কোরআনুল কারীমে রজব মাসের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে তুলে ধরে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনার মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি মাস হচ্ছে পবিত্র ও নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে এবং জেনে রেখ, আল্লাহপাক মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন। (সূরা তাওবাহ : আয়াত ৩৬)।
এই আয়াতে কারীমায় যে চারটি মাসকে পবিত্র ও নিষিদ্ধ মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তা হলো জিলকাদ, জিলহজ, মুহাররম ও রজব। এই চারটি মাস আরববাসীদের নিকট খুবই পবিত্র ছিল এবং আছে। সেহেতু তারা এই চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো না এবং এই চারটি মাসকে খুবই সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করত।
লক্ষ করলে দেখা যায় যে, উপরোক্ত আয়াতে কারীমায় ‘আরবাআতুন হুরুম’ শব্দদ্বয় যোগে যে চারটি মাসের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর নাম কী কী তা বলা হয়নি। এই মাসগুলোর নাম বিবৃত হয়েছে সহীহ হাদিসে। প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. পাক জবানে সেগুলোর নাম তুলে ধরেছেন। উম্মতে মুহাম্মাদীয়া রোজ কিয়ামত পর্যন্ত এই চারটি মাসের মর্যাদা ও পবিত্রতা অক্ষুন্ন রাখবে, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
জাহিলিয়া যুগে তো বটেই বরং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর জীবনের অন্যতম ঘটনা ‘ইসরা’ বা নৈশ ভ্রমণের বিষয়টিও রজব মাসের সাথে জাড়িত। এতে করে ইসলামে রজব মাসের গৌরব বিশেষভাবে বর্ধিত হয়েছে। উক্ত মাসের ২৭ তারিখটি মিরাজের তারিখরূপে নির্ধারিত হয়। নৈশ ভ্রমণের এই রাতকে লাইলাতুল মিরাজ নামে আখ্যায়িত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পবিত্র ও মহিমময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন, মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি বরকতময় করেছিলাম, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য। তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা ইসরা বা বনী ইসরাঈল : আয়াত ০১)। এতে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়ে যে, রজব মাসটি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর মিরাজের স্মৃতি নিজের বক্ষে ধারণ করে আছে বলেই এ মাসের সম্মান ও মর্যাদা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
প্রসঙ্গত, একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, ইবনে সা’দের মতে (১/১, পৃ. ১৪৭) রাসূলুল্লাহ সা.-এর ইসরা বা নৈশ ভ্রমণ হয়েছিল ১৭ রবিউল আউয়ালে এবং মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল ১৭ রমজানে। তার মতে, ইসরা এবং মি’রাজ পৃথক পৃথক ঘটনা। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীর ঐকমত্য ও ইজমা হলো এই যে, ইসরা এবং মি’রাজ অভিন্ন ঘটনা। এ দু’য়ের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। ইসরা নৈশ ভ্রমণের প্রারম্ভ এবং মি’রাজ নৈশ ভ্রমণের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত প্রলম্বিত। সুতরাং ইবনে সা’দের অভিমত একান্তই বাতিল এবং পরিত্যাজ্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।