Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য জাটকা সংরক্ষণে ছয়টি অভয়াশ্রমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ

বেকার জেলেদের খাদ্য সহায়তা সন্তোষজনক নয়

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০১৯, ৯:৫৯ এএম | আপডেট : ১০:০৩ এএম, ২ মার্চ, ২০১৯

জাতীয় মাছ ইলিশ পোনাÑজাটকা নিধন বন্ধে আট মাসের অভিযান অব্যাহত থাকার মধ্যে আগামী ১৬মার্চ থেকে ‘জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ’ পালিত হচ্ছে। ১৬মার্চ জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হচ্ছে ভোলার চরফ্যাশনে। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী ঐদিন চরফ্যাশনে জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন বলে জানা গেছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে জাটকা সংরক্ষণে শুক্রবার থেকে বরিশাল, ভোলা ও চাঁদপুরের ৪টি এলাকার বিভিন্ন নদ-নদীকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে ইলিশ সহ সব ধরনের মৎস্য আহরনে নিষেধাজ্ঞা বলবত হয়েছে।
প্রতিবছরের মত এবারো নিম্ন মেঘনা, শাহবাজপুর চ্যানেল ও তেতুলিয়া নদীতে এবং শরিয়তপুর জেলার নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা এবং দক্ষিণে চাঁদপুর জেলার মতলব ও শরিয়তপুর উপজেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০কিলোমিটার এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে সব ধরনের মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আগামী ৩০এপ্রিল পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে সরকার এবারই প্রথমবারের মত বরিশালের হিজলা উপজেলার নাছকাটি পয়েন্ট, হরিনাথপুর পয়েন্ট, ধুলখোলা পয়েন্ট এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার ভাষানচর পয়েন্ট এলাকার মেঘনার শাখা নদী, হিজলা উপজেলার ধর্মগঞ্জ ও নয়া ভাঙনী নদী এবং মেহেদিগঞ্জ উপজেলার লতা নদীর ৬০কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশ ও জাটকার ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেব ঘোষনার করেছে। দেশের ষষ্ঠ এ অভয়াশ্রমেও গতকাল থেকে আগামী ৩০এপ্রিল পর্যন্ত ইলিশ সহ সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা বলবত হয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে গত নভেম্বরÑজানুয়ারী মাসের সময়কালকে অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করে সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল।
তবে গত ১নভেম্বর থেকে আগামী ৩০জুন পর্যšত টানা ৮ মাস জাটকা আহরন, পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা বলবতকালীন সময়ে বেকার জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও পূণর্বাশনে এবার কোন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়নি। পাশাপাশি খাদ্য সহায়তাও মিলছে ৪ মাস পরে। ১ নভেম্বর থেকে জাটকা আহরনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও চলতি মাস থেকে আগামী জুন পর্যন্ত ৪ মাসের জন্য খাদ্য সহায়তা মঞ্জুরী প্রদান করেছে ত্রান মন্ত্রনালয়। দেশের উপকূলীয় ১১২টি উপজেলার ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬২টি জেলে পরিবারকে এবারো ৪০ কেজি করে চার মাস চাল প্রদান করার সুপারিশ ছিল মৎস অধিদপ্তরের।
ত্রান মন্ত্রনালয় থেকে গত সপ্তাহেই চাহিদার প্রায় অর্ধেক চালের বারদ্বপত্র পৌছেছে বরিশাল সহ দক্ষিণের জেলাগুলোতে। তবে জেলেদের কাছে ঐ চাল পৌছতে আরো অন্তত ১৫দিন লেগে যেতে পারে বলে জানা গেছে। এবার বরিশাল বিভাগের ১লাখ ২৯হাজার ৪৮৭ জেলে পরিবারের জন্য ৪০কেজি করে চার মাসে ২০ টনের কিছু বেশী চাল বরাদ্ব দেয়া হয়েছে বলে মৎস অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। তবে এ বিভাগে নিবন্ধিত ইলিশ জেলে পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার হলেও ১ লাখ ৯০ হাজার জেলে পরিবার এবারো কোন খাদ্য সহায়তা পাচ্ছেনা। অনুরূপ চিত্র গোটা উপক’লীয় এলাকাতেই। ফলে ৮ মাসের জাটকা আহরনে নিষেধাজ্ঞা সহ ৬টি অভয়াশ্রমে দুমাস করে সব ধরনের মৎস্য আহরন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে লাখ লাখ বেকার জেলেদের মাঝে অনেকটাই মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির আশংকা করছেন ওয়াকিবাহল মহল। তবে বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ত্রান মন্ত্রনালয় সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল বলে কোন মন্তব্য করতে চাননি মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল।
মৎস অধিদপ্তরের মতে, দেশের ৪০টি জেলার ১৪৫টি উপজেলার দেড় হাজার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৪ লাখ জেলে পরিবার ইলিশ আহরনে সম্পৃক্ত। যার ৩২% সার্বক্ষনিক এবং ৬৮% খন্ডকালীন। এমনকি ইলিশ বিপনন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাত করন, জাল, নৌকা ও বরফ তৈরী এবং মেরামত কাজেও প্রায় ২০-২৫ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত। আর দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলাতেই প্রায় সোয়া ৩ লাখ জেলে এ পেশার সাথে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষনিক ইলিশ আহরনে জড়িত বলে মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে। সারা দেশে গত বছর যে প্রায় ৫লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়েছে, তার ৬০%ই পাওয়া গেছে বরিশালে বিভাগের অভ্যন্তরীন ও উপক’লীয় জলাশয় থেকে।
আমাদের অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী। আর মৎস্য সম্পদে ইলিশ-এর অবদান প্রায় ১২-১৩%। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সারা বিশ্বে যেখানে ইলিশের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে প্রতি বছর তা গড়ে ৫-১০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দেড় দশকে দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০% বাংলাদেশে উৎপাদিত ও আহরিত হচ্ছে। আর গত দুই দশকে বরিশাল বিভাগের ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১শ গুনেরও বেশী।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষনা অনুযায়ী মেঘনার ভাটিতে সাগর মোহনার ৪টি এলাকার প্রায় ৭হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ইলিশ প্রজননস্থল হিসেবে চিঞ্হিত করে প্রতি বছর আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগেÑপড়ের ২২দিন সব ধরনের মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময় ২০১৫ সালের ১৫ দিনের স্থলে ২০১৭ সালে ২২ দিনে উন্নীত করায় ইলিশের নিষিক্ত ডিমের পরিমান ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৩৬৫ কেজি থেকে ৩৭% বেশী, অর্থাৎ ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৩৯৫ কেজিতে উন্নীত হয়। এমনকি ইলিশ পোনা জাটকার উৎপাদনও ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২ হাজার ২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে বলে মৎস অধিদপ্তর সূত্রে বলা হয়েছে। ‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান ’এর আওতায় ২০০৫ সালেই সর্বপ্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয় ১০ দিন। ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিনে উন্নীত করা হয়।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ও সহনীয় আহরনে প্রবৃদ্ধি গোটা বিশ্বের কাছেই ঈর্শনীয় সাফ্যল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ১৯৮৭-৮৮সালে দেশের অভ্যন্তরীন ও সামুদ্রিক জলাশয় থেকে সর্বমোট ইলিশ উৎপাদন ও সহনীয় আহরনের পরিমান ছিল মাত্র ১.৮৩ লাখ টন। ৯৪-৯৫ সালে তা ২.১৩ লাখ টন ও ২০০০-০১ সালে ২.২৯ লাখ টনে উন্নীত হলেও ২০০২-০৩ সালে ইলিশ উৎপাদনে পুনরায় বিপর্যয় নেমে আসে। ঐ বছর দেশে ইলিশের উৎপাদন ১.৯০লাখ টনে হ্রাস পায়। ফলে বিষয়টিকে ঝুকিপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে সরকার মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশের আলোকে ঐ বছর থেকেই ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে ‘জাটকা নিধন বন্ধ’র প্রথমিক কর্মসূচী গ্রহন করে। এর পর থেকে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচীর আওতায় ইলিশ সম্পদ রক্ষায় একাধীক প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় গত দেড় দশকে উৎপাদন প্রায় আড়াই গুন বৃদ্ধি পেয়ে ইতোমধ্যে তা ৫ লাখ টন অতিক্রম করেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ