পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘আকাশে শান্তির নীড়’ স্লোগান নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ঘুরছে বাংলাদেশের বিমান। সেই আকাশে পাইলট, ক্রু, যাত্রীদের জিম্মি করে বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা! দেড়শ’ মানুষকে জিম্মি করে একজন দস্যু ছিনতাই করার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ বিমান। বিমানবন্দরে স্ক্যানিংসহ নিশ্চিদ্র নিরাপত্তায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সে কিভাবে উঠল বিমানে? রহস্য উপন্যাসের নায়করূপী কে এই ভিলেন মাজিদুল-পলাশ-মাহাদী? এক যুবকের ‘বিমান ছিনতাই চেষ্টা’ এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। দেশের গন্ডি পেরিয়ে এই খবর এখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও শিরোনাম। সংসদে প্রতিমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন এবং দু’জন এমপি পাইলট ও ক্রুদের পুরস্কৃত করার দাবি জানান।
১৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর কুয়েত এয়ারওয়েজের করাচিগামী বিমান ছিনতাই; ১৯৮৫ সালের ২৩ নভেম্বর ইজিপ্ট এয়ারের গ্রিসের এথেন্স থেকে মিসরগামী বিমান ছিনতাই, ১৯৮৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের মুম্বাই থেকে নিউ ইয়র্কগামী প্যান অ্যামের বিমান ছিনতাই, ১৯৯৯ সালের ২৪ জানুয়ারি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে ছিনতাইয়ের রক্তাক্ত লোমহর্ষক ঘটনা এখন ইতিহাস। ওই সব ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সময় লেগে যায়। আর আমেরিকার ৪ বিমান ছিনতাই করে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার বিশ্বকাঁপানো ঘটনা কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয় বিশ্বমোড়ল মার্কিন প্রশাসনকে। বিমান ছিনতাইয়ের প্রাণহানিই ওই সব ঘটনাকে বিয়োগান্তুক পরিণতি দেয়। ভারতের বিমান ছিনতাইয়ে ‘প্রাণহানি’ ঘটনা নিয়ে মুম্বাইয়ে নির্মিত হিন্দি সিনেমা কোটি কোটি দর্শককে কাঁদিয়েছে। কিন্তু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ‘ময়ূরপঙ্খী’ নামের ‘বিমান ছিনতাই চেষ্টা’ এবং ৮ মিনিটের অভিযানে বিমানের পাইলট, ক্রু, যাত্রীদের নিরাপদে নিয়ে আসার সাফল্য ১৬ কোটি মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো, বিমানবাহিনীর টিম ও নৌ বাহিনীর অভিযান এবং র্যাব, পুলিশ বাহিনীর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা দ্রুত সঙ্কটের নিষ্পত্তি হয়। ছিনতাইকারী প্রাণ হারিয়েছে; বেঁচে গেছে প্রায় দেড়শ’ প্রাণ।
বিমান ছিনতাই চেষ্টা রুখে দেয়ার সাফল্য নিয়ে যখন গৌরবগাথা প্রচারণার কথা; তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল বিতর্ক। বিমান ছিনতাই চেষ্টাকে কেউ বলছেন ‘নাটক’ কেউ বলছেন ‘রহস্য উপন্যাস’। বিমানযাত্রীদের বক্তব্য, অভিযান পরিচালনার সময়ে দায়িত্বশীলদের বক্তব্য এবং পরবর্তীদের তাদের স্ববিরোধী কথাবার্তাই মূলত এই সন্দেহের সৃষ্টি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বিমান ছিনতাই চেষ্টা’ ঘটনা নিয়ে নানা মন্তব্য করা হচ্ছে। লাইক, পোস্ট দেয়া হচ্ছে নানা কথামালায়। কেউ বলছেন, চকবাজারের ঘটনা চাপা দেয়ার জন্য এটার অবতারণা করা হয়েছে। কেউ বলছেন, এয়ারপোর্টে এত নিরাপত্তার মধ্যেই এমন ঘটনা কিভাবে সম্ভব? কেউ বলছেন, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ও তথ্যই জানান দেয় এটা অবিশ্বাস্য। এমনকি সরকার সমর্থিত মিডিয়া হিসেবে পরিচিত একটি টিভি বিমান ছিনতাই চেষ্টা রুখে দেয়ার পরপরই খবর দেয় ‘বিমান ছিনতাই নাটকের অবসান’ ইত্যাদি। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম সফর উপলক্ষে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকার কথা দেশের দুই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সেখানে অস্ত্র নিয়ে যাত্রী আন্তর্জাতিক রুটের বিমানে ওঠে কেমন করে? প্রশ্ন ছুড়েছেন অনেকেই। তাছাড়া প্রথমে বলা হয় বিমানের ভেতরে গোলাগুলি হয়েছে, যাত্রীরাও গুলির শব্দের কথা জানান; অভিযান পরিচালনাকারীরাও প্রথমে গুলিবিনিময়ের তথ্য প্রকাশ করে; পরবর্তীতে বলা হয় খেলনা পিস্তল। আবার বিমানের দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেছেন, কোনোভাবেই পিস্তল নিয়ে বিমানে ওঠার সুযোগ নেই। আবার বলা হচ্ছে অস্ত্রের মুখে ছিনতাইকারী জিম্মি করেছিল। কোনটা সত্য?
বিমান ছিনতাই চেষ্টা এবং পরবর্তীতে সেটা রুখে দেয়ার পর সবার মুখে মুখে বিমান ছিনতাই চেষ্টা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্ক। বিমানের একজন পরিচালক জানান, বিজি-১৪৭ নম্বর ফ্লাইট গত রোববার বিকাল সাড়ে ৪টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার সিডিউল ছিল। এতে ১৩৪ যাত্রী ও ১৪ ক্রুসহ ১৪৮ জন ছিলেন। সাড়ে ৪টার কিছু সময় পর ‘ময়ূরপঙ্খী’ আকাশের প্রায় ১৫ হাজার ফুট ওপরের দিকে উড়ে যাচ্ছিল। তখন বিমানের ভেতরে যাত্রীদের আসনে থাকা এক ব্যক্তি উঠে ককপিটের দিকে আসেন। ওই ব্যক্তি এক ক্রুকে ধাক্কা দিয়ে একটি পিস্তল ও বোমাসদৃশ বস্তু বের করে বলেন, ‘আমি বিমানটি ছিনতাই করব। আমার কাছে পিস্তল ও বোমা আছে। ককপিট না খুললে আমি বিমান উড়িয়ে দেবো।’ কেবিন ক্রুরা ককপিটে থাকা পাইলট ও সহকারী পাইলটকে গোপনে সাঙ্কেতিক বার্তা দেন বিমানে অস্ত্রধারী আছে, বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও ঢাকার মাঝামাঝি আকাশে ওড়া বিমানটির পাইলট মো: শফি ও সহকারী পাইলট মো: জাহাঙ্গীর কৌশলে সফলভাবে চট্টগ্রামে জরুরি অবতরণ করেন।
বিমান ছিনতাই রুখে দেয়ার পর পুরো ঘটনা সম্পর্কে রোববার রাত পৌনে ৯টার দিকে ব্রিফিং করেন চট্টগ্রামের সেনা নিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান। তিনি বলেন, বিকাল ৫টা ৩৩ মিনিটে পাইলট ককপিট থেকে কন্ট্রোল টাওয়ারকে জানান, বিমানটি ছিনতাই হয়েছে। এরপর ৫টা ৪১ মিনিটে সেটি অবতরণ করে। অবতরণের পর বিমানবাহিনী দ্রুত ‘মুভ’ করে। অন্যান্য বাহিনী জরুরি অবস্থায় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়। সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডো ও বিমানবাহিনীর টিম দ্রুত বিমানবন্দরে অবস্থান নেয়। বিমানটি ঘিরে রাখে। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান প্রথমে মোবাইল ফোন থেকে ওই দুষ্কৃতকারীর সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, তার সঙ্গে আমরা অনবরত মোবাইল ফোনে কথা বলে তাকে ব্যস্ত রাখি যাতে কোনো ধরনের অঘটন ঘটাতে না পারে। আমরা দ্রুততম সময়ে অপারেশন শেষ করতে চেয়েছি, তাই দেরি না করে অভিযান শুরু করি। এতে দু’পক্ষের গোলাগুলি হয়। আহতাবস্থায় দুষ্কৃতকারীকে বিমান থেকে বের করে আনা হয়। পরে সে মারা যায়। ৮ মিনিটের মধ্যেই সফলভাবে কমান্ডো অভিযান সম্পন্ন হয়।
পুলিশের বিশেষ শাখার ডিআইজি আকমল হোসেন রোববার রাতেই বলেন, অস্ত্রধারী বিমানের ককপিটে ঢুকে পাইলটকে পিস্তল ধরে বলেন, আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে হবে।
প্রতিমন্ত্রী যা বললেন
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-১৪৭ বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনা নিয়ে স্পষ্ট কিছুই বলেননি বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা ত্রæটি নেই দাবি করে তিনি বলেন, তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে। এছাড়া ছিনতাইকারী মাহাদীর কাছে খেলনা নাকি আসল পিস্তল ছিল, সেটা নিয়ে কিভাবে বিমানে উঠল তাও নিশ্চিত করতে পারেননি। গতকাল বিমান ছিনতাই ঘটনা সম্পর্কে জানাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। এ সময় বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর সঙ্গে ছিলেন সচিব মহীবুল হক, সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, কলিগদের থেকে জানলাম বিমান হাইজ্যাক হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারের কথা বললাম। প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হলে দেখলাম তিনি ঘটনাটি জানেন। কমান্ডো প্রসিড করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সার্বক্ষণিক পুরো বিষয়টি মনিটর করেছেন। পরে জানলাম সবাই নিরাপদে রয়েছে। আমরা পুরো বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছি। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে এমন কোনো লিকেজ ছিল না বা নেই যে, একজন যাত্রী এভাবে বিমানে যেতে পারেন। বিমানবন্দরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয়হীনতা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয়হীনতা নেই। তাহলে অস্ত্রটা ভেতরে গেল কিভাবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিমান সচিব মহীবুল হক বলেন, সেটা অস্ত্র কি না আমরা ওয়াকিবহাল নই। খেলনা পিস্তল কি না... যেকোনো কিছু হতে পারে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে এটা নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারব। আমরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখেছি অন্য ১০ জন যাত্রীর মতো তাকেও তল্লাশি করা হয়েছিল। তার কাঁধে একটা ব্যাগ ছিল। সে স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে গেছে, সেখানেও কিছু দেখা যায়নি।
সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান বলেন, বিমান থেকে সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর ‘সো কলড’ হাইজ্যাকার বিমানে একাই ছিল। আমরা সেদিন অনেক কিছুই শুনেছি। তদন্ত প্রতিবেদনে পুরো বিষয়টি বিস্তারিত জানা যাবে। বিমানে গুলিবিনিময় হয়েছে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এয়ারক্রাফটে গুলিবিনিময় হলে তার চিহ্ন থাকত। আমরা কোনো চিহ্ন কোথাও পাইনি। খেলনা পিস্তলেও শব্দ হয়। যাত্রীরা গুলির শব্দ শোনার কথা বলেছেন। তদন্ত না করে পিস্তল আসল নাকি নকল বলা যাবে না।
সংসদে বিবৃতি এবং পুরস্কৃত করার দাবি
এদিকে সংসদে ৩০০ বিধিতে বিবৃতি দিয়েছেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তিনি বলেন, অবতরণের পূর্বে বিমানের যাত্রীবেশে অস্ত্রধারী আকস্মিক যাত্রীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিমান উড়িয়ে দেয়ার হুমকি ও চিৎকার করতে থাকে। বিমানের কর্তব্যরত ক্যাপ্টেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা, পেশাদারিত্ব ও সাহসিকতার সাথে দুষ্কৃতকারীকে কথাপকথনে ব্যস্ত রেখে কালক্ষেপণ করেন। ঘটনা চলাকালে বিমান বাহিনী, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশি¬ষ্টরা ত্বরিত ব্যবস্থায় যাত্রী ও ক্রুদের নিরাপদে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডো ও র্যাবের একটি চৌকস দল বিমানবন্দরে অবস্থান নেন। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদে রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, বিমান নিয়ে প্রায়ই এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। প্রধানমন্ত্রীও দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। আসলে এই যে ব্যক্তিটি বিমানে গেলেন। চারটি ধাপে চেক করে তারপর ভেতরে ঢুকতে হয়। তারপরও একটি লোক অস্ত্র নিয়ে কী করে গেল? সব দলের সংসদ সদস্যদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, তদন্ত করে সংসদকে জানাতে হবে। আর মন্ত্রীকে বলতে হবে, আর কখনও এমন ঘটনা ঘটবে না। সংসদে মইন উদ্দিন খান বাদল এমপি যাত্রীদের বাঁচানোসহ পুরো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাহসী ভূমিকার জন্য ওই বিমানের পাইলট ও কেবিন ক্রুদের পুরস্কৃত করার দাবি জানিয়েছেন।
র্যাবের সংবাদ সম্মেলন
‘বিমান ছিনতাই চেষ্টাকারী’ যুবক মো: পলাশ আহমেদ র্যাবের তালিকাভুক্ত অপরাধী বলে জানিয়েছে র্যাব। তাকে ২০১২ সালে তরুণী অপহরণের অভিযোগ এবং ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তখন পলাশের বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। গতকাল র্যাব সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। মুফতি মাহমুদ বলেন, পলাশ আগেও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল। ২০১২ সালের মার্চে পলাশ আহমেদ ও তার এক সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়। তার অপরাধ ছিল, সে একজন নারীকে অপহরণ করে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। র্যাবের ক্রিমিনাল ডাটাবেইজে এ তথ্য লেখা আছে।
র্যাবের অপরাধী তথ্যভান্ডারের বিবরণ দিয়ে মুফতি মাহমুদ আরো জানান, পলাশের জন্ম ১৯৯৪ সালে। ২০১২ সালে যখন পলাশকে গ্রেফতার করা হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। ওই সময়ই সে নিজেকে বিবাহিত বলে দাবি করে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি সমমানের।
মুফতি মাহমুদ আরো জানান, বিমান ছিনতাই চেষ্টার ওই ঘটনার পর র্যাব-৭ ঘটনাস্থলে যায়। র্যাবের বোমা ডিস্পোজাল ইউনিট সেখানে কাজ করে। পলাশের শরীরে বিস্ফোরক সদৃশ যা পাওয়া গেছে তাতে কোনো বিস্ফোরক ছিল না। এটা ভুয়া একটা জিনিস ছিল যেখানে ভুয়া তার-সার্কিট দিয়ে ভেস্টের মতো তৈরি করা হয়েছিল।
এর আগে এক মুঠোফোন বার্তায় র্যাবের পক্ষ থেকে পলাশের পরিচয় শনাক্ত হওয়ার বার্তা জানানো হয়। র্যাব জানায়, ছিনতাই চেষ্টাকারী ওই যুবকের নাম মো: পলাশ আহমেদ। তার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। সে বিমানের ১৭/এ নম্বর আসনের যাত্রী ছিল। পলাশ আহমেদ ঢাকা-চট্টগ্রাম অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী ছিল। র্যাব বলছে, নিহত বিমান ছিনতাই চেষ্টাকারী যুবকের আঙুলের ছাপ র্যাব ক্রিমিনাল ডাটাবেজের (অপরাধী তথ্যভান্ডার) একজন অপরাধীর সঙ্গে মিলে গেছে। ডাটাবেজ অনুযায়ী, যুবকের নাম পলাশ আহমেদ। তার বাবার নাম পিয়ার জাহান সরদার।
এর আগে বিমান ছিনতাইয়ের রাতে রাববার ওই যুবকের পরিচয় নিয়ে একাধিক তথ্য জানানো হয়; যা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। প্রথমে বলা হয় তার নাম মাহাদী। পরে বলা হয় মো: মাজিদুল। তবে টিকিটে তার নাম মো: মাজিদুল লেখা ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়। কিন্তু গতকাল যে তথ্য প্রকাশ করা হলো তাতে দেখা যাচ্ছে তার নাম মাহাদী ও মাজিদুল কোনোটিই নয়; তার নাম পলাশ। বিমান ছিনতাই চেষ্টা বানচালের পর গুলিতে নিহত হওয়ার সময় ছিনতাইকারী যুবকের নাম মাহাদী বলে জানান চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান। ওই সময় রাত পৌনে ৯টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ওই যুবকের নাম মাজিদুল।
কে এই পলাশ
চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে কমান্ডো অভিযানে নিহত বিমান ‘ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারী’ ২৩ বছর বয়সী মাহাদী ওরফে পলাশ আহমেদের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রামে। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে পলাশ ছোট। পিতার নাম পিয়ার জাহান সর্দার। তিন কন্যার পর এক পুত্র হওয়ায় পিতা-মাতার আদরের ছিল পলাশ। যা চাইত পিতা-মাতা তাই দেয়ার চেষ্টা করত। পলাশের বাবা পিয়ার জাহান জানান, ১৯৯০ সালে কাজের উদ্দেশ্যে তিনি ইরাক চলে যান। সেখানে চার বছর থাকার পর দেশে ফিরে আসেন। পরে তিনি আবার সউদী আরব চলে যান। ২০১২ সালে তিনি আবার দেশে ফেরেন। এর মধ্যে ছেলে পলাশ তাহেরপুর ইসলামিয়া আলিম মাদরাসা থেকে ২০১২ সালে দাখিল পাস করে। পরে সে সোনারগাঁও ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে পড়া অবস্থায় সে ঢাকায় চলে যায়। তারপর থেকে তার আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয়। গ্রামের মানুষ তাকে পলাশ নামেই চিনত। গ্রামের বাইরে পলাশ নিজেকে মাহাদী নামে পরিচয় দিত। ‘বিমান ছিনতাই’ ঘটনার পর পলাশের (মাহাদী) বাবা মুদি দোকানি পিয়ার জাহানের মুখোমুখি হন সাংবাদিকরা। পুত্রের অপকর্মে বিব্রত পিতা পিয়ার জাহান বলেন, পলাশ সোনারগাঁওয়ের তাহেরপুর মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করে সোনারগাঁও ডিগ্রি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়। এরপর সে আর পড়াশোনা করেনি। ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার পলাশ আমাকে জানায় সে আর বাংলাদেশে থাকবে না। দুবাই চলে যাবে কাজ করতে। এ কারণে সে আমার কাছে ৫০০ দিরহাম দাবি করে। আমি সেই টাকা জোগাড় করে দেই।
পিয়ার জাহানের দাবি, তার পুত্র পলাশ তাদের অবাধ্য সন্তান। এর আগেও বিদেশে যাওয়ার কথা বলে সে সংসারের অনেক টাকা নষ্ট করেছে। যে কারণে পুত্রের সঙ্গে তিনি ঠিকমতো কথা বলতেন না। তিনি বলেন, গত ১০ মাস আগে চিত্রনায়িকা সিমলাকে নিয়ে পলাশ বাসায় আসে। তখন সে জানায় সিমলাকে নিয়ে এলাকায় বেড়াতে এসেছে। কিন্তু দেড় থেকে দুই মাস পর লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারি তাদের বিয়ে হয়েছে। এর ঠিক দেড় থেকে দুই মাস পর পলাশ আবারও সিমলাকে নিয়ে বাড়ি আসে। তখন জানায় নায়িকা সিমলাকে সে বিয়ে করেছে। পলাশের চেয়ে শিমলার বয়স বেশি। প্রথমে না মানলেও পরবর্তীতে বিয়ে মেনে নেই এবং বউকে (সিমলা) বলি ছেলেকে ভালো করে তুলতে। এরপর পলাশের সঙ্গে যোগাযোগ তেমন হতো না। তবে এর আগে পলাশ আরেকটি বিয়ে করে বগুড়ায়। মূলত ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে ২০১৪ সালে বগুড়া সদর উপজেলার সাতমাথা ভাইপাগলা মাজার এলাকার মেঘলা নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন পলাশ। তাদের সংসারে আড়াই বছর বয়সী আয়ান নামে একটি সন্তান রয়েছে। মেঘলা বগুড়ার স্থানীয় নার্সিং ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপালের মেয়ে। পলাশের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণে প্রায় দেড় বছর আগে তাকে তালাক দিয়ে সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়ি বগুড়া চলে যান মেঘলা। পিয়ার জাহান জানান, পলাশ ২০-২৫ দিন আগে গ্রামের বাড়িতে আসে। সাধারণত সে বাড়িতে এসে এতদিন থাকত না। বাড়িতে আসার পর সে অনেকটা পাল্টে যায়। মসজিদে যাওয়া-আসা করে। শুক্রবার বাসা থেকে বিদায় নেয়ার সময় তার মাকে বলে যায় ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যাচ্ছে। আর বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনার বিষয়ে আমরা কিছুই জানতাম না। ফেসবুকের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারি। এছাড়া এলাকায় নারী কেলেঙ্কারির একটি ঘটনায় মামলাও হয়েছিল পলাশের নামে। সেই মামলায় ২০ দিন জেল খেটে সে জামিন পায়। তিনি বলেন, ‘বিমান ছিনতাইয়ের রাতেই সোনারগাঁও থানা পুলিশের একটি দল আমাদের বাসায় আসে এবং বাড়ি তল্লাশি করে। পরে আমি ও আমার স্ত্রীকে স্থানীয় এক মুরুব্বির জিম্মায় রেখে যায় পুলিশ। সোনারগাঁও থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনায় নিহতের ছবি রোববার রাত ১টার দিকে পিয়ার জাহানের বাড়িতে নিয়ে দেখালে তারা ছবিটি পলাশের বলে নিশ্চিত করে। তবে যতটুকু খবর নিয়েছি তাতে পলাশ নেশাগ্রস্ত ছিল বলে জেনেছি। ছিনতাইকারী পলাশের পোস্টমর্টেম করা হয়েছে চট্টগ্রামে। থানায় মামলাও হয়েছে। নিহতের বাবা পিয়ার জাহান সর্দারকে চট্টগ্রামে নেয়া হচ্ছে পুত্রের লাশ শনাক্তের জন্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।