রামগতিতে আ.লীগ নেতাকে বহিষ্কার
লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চরআলগী ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় ইউনিয়ন আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আলী মনুকে দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গত
নজির হোসেন নজু, সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে
টুং টাং শব্দে সকালের ঘুম ভাঙে মানুষের। উত্তরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র নীলফামারীর সৈয়দপুরে অলিগলি, পাড়া-মহল্লার ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে মিনি কারখানা। যেখানে দিনে-রাতে কাজ করছেন শ্রমিকরা। তাদের তৈরি পণ্য ট্রাঙ্ক, বালতি, মোমবাতি, আগরবাতি, শোকেস, ফাইল কেবিনেট, সাবান, গুল, জর্দা, প্লøাস্টিকের কৌটা প্রভৃতি দেশের বিভিন্নস্থানে পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, পাঁপড় ফ্যাক্টরি, ফাউন্ডারী কারখানা, বেনারসী শাড়ি তৈরি, পোশাকে কারচুপি ও পাথর বসানোর বাজ, রেডিমেড ফার্নিচার, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গার্মেন্টস ইত্যাদি বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এখানে। কিšুÍ সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায় এসব মিনি কারখানা সম্প্রসারিত হতে পারছে না। প্রায় দেড় লক্ষাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত সৈয়দপুরে এসব কারখানা নানা কারণে গড়ে উঠেছে। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ৩৪.৪২ বর্গকিলোমিটারের সৈয়দপুর পৌরসভার ৩ লক্ষাধিক মানুষের অর্ধেকের বেশি রয়েছে অবাঙ্গালী (বিহারী)। এছাড়া দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা ১৮৭০ সালে সৈয়দপুরে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দক্ষ শ্রমিক-কর্মচারি তৈরি হয়েছে। সড়ক, রেল ছাড়াও বিমানবন্দর সৈয়দপুরের গুরুত্বকে বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। সৈয়দপুর উপজেলা শহরটি বিশিষ্ট ব্যবসা কেন্দ হিসেবে গড়ে উঠায় প্রায় ২৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলা হয়েছে। কিন্তু গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান রেলওয়ের জায়গায় অবস্থানের কারণে কোন ঋণ সুবিধা পাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান পরিদর্শনের পর থেকেই ক্ষুদ্র গার্মেন্টস কারখানাগুলো ঋণ সুবিধা নিয়ে বিকশিত হয়েছে। সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার দক্ষ শ্রমিকরা জীবিকার তাগিদে কুটির শিল্পের ভিত্তিতে গড়ে তুলে শিল্প প্রতিষ্ঠান। শহরের বাঁশবাড়ি, সাহেবপাড়া, উত্তরা আবাসন, রেল লাইনের পাশেসহ বিভিন্ন মহল্লায় বালতি, ছোট- বড় ট্রাঙ্ক, রিকশার হুড, স্টীল আলমিরা, খাট, ফাইল কেবিনেট, সাবান ফ্যাক্টরি, গুল, জর্দা, আগরবাতি, টিনের কৌটা, কুপি, প্লøাস্টিকের কৌটা, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, পাঁপড় ফ্যাক্টরি, ফাউন্ডারী কারখানা, বেনারসী শাড়ি তৈরি, শাড়িতে কারচুপি ইত্যাদি বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। তাদের তৈরি ট্রাঙ্ক উন্নতমানের হওয়ায় সেনাবাহিনীর জোয়ানরা শান্তি মিশনে যোগ দিতে এটি সাথে করে বিদেশের মাটিতে নিয়ে যাচ্ছেন। সৈয়দপুরে লেদ মেশিনে এমন সব ডাইস তৈরি হচ্ছে যা দেশের অন্যান্য স্থানে করা সম্ভব নয়। সৈয়দপুর শহর থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। সৈয়দপুরকে এ কারণে ঢাকার জিঞ্জিরা বা চায়নার সাথে তুলনা করেন অনেকেই। উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান অন্যান্যের চেয়ে অনেক ভাল বলে এরই মধ্যে সুনাম অর্জন করেছে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, বহু নারী-পুরুষ ও শিশু শ্রমিক চুক্তিভিত্তিতে বা দৈনিক হাজিরায় কাজ করছে। কতিপয় প্রতিষ্ঠান স্থানীয় ব্যাংকের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ ঘটালেও খুদে প্রতিষ্ঠান সমূহের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সৈয়দপুর শহরটি গড়ে উঠেছে রেলওয়ের জমির উপর। ব্যাংক ঋণ নিতে হলে মালিকানাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দরকার হলেও ছোট শিল্পের মালিকরা তা দিতে পারছেন না। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান আথিক সহায়তা পেলে পরিধি বৃদ্ধি করে বেশি সংখ্যক শ্রমিকের কর্মের সংস্থান করতে পারে। সৈযদপুর শহরের নতুন বাবুপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, মুন্সিপাড়া, পুরাতন বাবুপাড়া, গোলাহাট, ঘোড়াঘাট, বাঁশবাড়ি প্রভৃতি এলাকায় গড়ে ওঠা প্রায় অর্ধশতাধিক কারখানায় তৈরি হচ্ছে মজাদার চিপস। এসব চিপ্স স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়াসহ দেশের প্রায় সর্বত্র পাঠানো হচ্ছে। এসব চিপস তৈরিতে অতি নি¤œমানের ময়দা, লবণ, অ্যারারোট, বেকিং পাউডার, অ্যামুনিয়া বাই কার্বনেট, সোহাগা ও এক ধরনের ফার্টিলাইজার ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন কোন কারখানার মালিক নামি-দামি কোম্পানির প্যাকেটে এসব চিপস বাজারজাত করছেন। কারখানার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফুড কালার ব্যবহার না করে কেমিক্যাল রং ব্যবহার করা হচ্ছে। পাইকাররা মণ ধরে কিনে প্যাকেট করে খুচরা দোকানীদের কাছে বিক্রি করেন। পাইকাররা প্রতিকেজি ২৫ টাকা কিনে খুচরা ব্যবসায়ীরা তা ৪০/৪৫ টাকা কেজি বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।
শহরের নতুন বাবুপাড়া, মিস্ত্রীপাড়া, মুন্সিপাড়া, হাওয়ালদারপাড়া, সৈয়দপুর প্লাজা, রেলওয়ে বাজার প্রভৃতি স্থানে প্রায় দেড় শতাধিক ঝুট কাপড়ে তৈরি পোশাকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গার্মেন্টস কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব পোশাক এখন যাচ্ছে ভারত, নেপাল ও ভুটানে। মূলত ২০০২ সালে এর পরিধি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়। গড়ে ওঠে রফতানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপ। এই সংগঠনের সদস্যরা ঝুট কাপড় দিয়ে ট্রাউজার, জ্যাকেট, টি-শার্ট, শর্ট প্যান্ট, মোবাইল প্যান্ট ইত্যাদি তৈরি করে দেশের বাজার দখল করে নিয়েছে। এমনকি তৈরিকৃত এসব পোশাক পাঠানো হচ্ছে ভারত, নেপাল ও ভুটানে। সৈয়দপুর রফতানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান দুলু জানান, তারা ঢাকার মিরপুর, কালিগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বড় বড় পোশাক কারখানাগুলো থেকে ঝুট কাপড় সংগ্রহ করে এনে এসব পোশাক তৈরি করে। এরপর সুই-সুতার মাধ্যমে দর্জি কারিগররা তা নিখুঁতভাবে তেরি করে থাকেন। এরপর দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। শহরের গোলাহাট, নতুন বাবুপাড়াসহ বিভিন্ন অলগলিতে ৫০টির বেশি আগরবাতি ও মোমবাতির কারখানা গড়ে উঠেছে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে এসব কাজ করছেন। হাতে ও মেশিনে আগরবাতিতে মসলা লাগিয়ে রোদে শুকানো হচ্ছে। এরপর বড় বড় নামি-দামি কোম্পানিগুলো এসব আগরবাতি পছন্দমত সুগন্ধি ব্যবহার করে বাজারজাত করছেন। আগরবাতি কারখানার মালিক শওকত আলী জানান, কাঠের গুঁড়ো ও অন্যান্য উপকরণ মেশিয়ে আগরবাতি তৈরি করা হয়। আর মূল লাভটা করেন কোম্পানিগুলো। মোমবাতি গলিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন সাইজের মোমবাতি। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলেছে। শহরের কাজীহাট, হাওয়ালপাড়া, নিচু কলোনীতে গড়ে ওঠা বেনারসী পল্লøীতে তৈরি করা হচ্ছে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকার দামের শাড়ি। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ২২টি ক্যাম্প ও বিভিন্ন মহল্লøায় পোশাকে কারচুপির কাজ করছেন নারী-পুরুষ ও শিশু- কিশোররা। এসব শাড়ি ও কারচুপির কাজ পাঠানো হচ্ছে ঢাকার বড় বড় শপিং মলে। তৈরি এসব শাড়ি ও কারচুপির কাজ কুরিয়ার মাধ্যমে পাঠানো হয়। সেক্ষেত্রে মাঝে মাঝে পুলিশ সদস্যরা তল্লাশির নামে হয়রানি করেন বলে অভিযোগ করেন তারা। বাড়িতে বসে কাঠ মিস্ত্রীরা তৈরি করছেন খাট, ড্রেসিং টেবিল, সোফা, চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি সৌখিন আসবাবপত্র। পাইকাররা এসব কিনে নিয়ে বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করছেন। কম দামি কাঠে তৈরি এসব আসবাবপত্র সস্তায় মেলায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শহরের সিংগীপুকুর এলাকায় কারখানাগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে সুস্বাদু শনপাঁপড়ি ও তিলের খাঁজা। এখান থেকে হকার ও দোকানদাররা কিনে বিক্রি করেন। হকাররা বাস-ট্রেনে ও দোকানীরা দোকানে বিক্রি করেন। বাঙালিপুর নিজপাড়ায় জুতা তৈরির চামড়ায় নকশা করছেন প্রায় ৩ শতাধিক নারী। দৃষ্টিনন্দন এসব কাজ পাঠানো হচ্ছে ঢাকার জুতা ফ্যাক্টরিতে। তারপর দেশের গ-ি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে চলে যাচ্ছে। সৈয়দপুর শহরের ওয়াপদা গোলাহাটে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে শুধুমাত্র দা ও কুড়াল। প্রায় ৭০ জন কামার ও শতাধিক কর্মচারি কাজ করছেন এই কারখানায়। তৈরি এসব দা ও কুড়াল পাঠানো হচ্ছে দক্ষিণের জেলাগুলোতে। কারখানার মালিক শাহিন হোসেন জানান, লোহা, কয়লা ও মজুরির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় লাভের পার্সেন্টটেজ কমে এসেছে। ক্রেতাদের চাহিদার কারণে কারখানাটি চালু রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি। দি সৈয়দপুর বণিক সমিতির সভাপতি ইদ্রিস আলী জানান, শহরের নানা স্থানে গড়ে ওঠা মিনি কারখানাগুলো ঋণ সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিকশিত হতে পারছে না। ব্যাংকগুলো শর্ত শিথিল করে এসব কারখানার মালিকদের ঋণ সহায়তা দিলে এখানকার চিত্র পাল্টে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। সৈয়দপুরের সচেতন মানুষ মনে করেন, এখানে নেতৃত্বের অভাবে মিনি কারখানাগুলো বিকশিত হতে পারছে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জায়গা বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করলে মিনি কারখানাগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। শত শত লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে করে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যাবে বলে মনে করেন তারা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।