বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
উমাইয়া শাসনের দ্বিতীয় প্রবর্তক নামে খ্যাত আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান (৬৫-৮৬ হি:) যখন সিংহাসন লাভ করেন, তখন মুসলিম জাহানের সর্বত্র অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি এবং আন্দোলন-বিদ্রোহ বিরাজ করছিল। রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। তিনি অত্যন্ত দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা, অসীম সাহসিকতা এবং দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে সকল সঙ্কট-প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন।
আবদুল মালেক ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও অবদান রাখেন সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খানা ই কাবার পুনর্র্নিমাণ, দ্বীনি খেদমত, জনসেবা, বিভিন্ন শহর গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন সংস্কারমূলক তৎপরতা ছাড়াও ইসলামী মুদ্রার প্রচলন ও দফতরসমূহে আরবি ভাষার প্রবর্তন।
আরব বিশ্বে সে সময় স্বতন্ত্র ইসলামী মুদ্রার প্রচলন ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে ইরানি, রুমি এবং কিবতি মুদ্রার প্রচলন ছিল। নিজ মুদ্রার অভাব মুসলমানদের অর্থনৈতিক ক্ষতির অপরিহার্য কারণ হয়ে দেখা দেয়। আবদুল মালেক হিজরী ৭৬ সালে ইসলামী মুদ্রা চালু করার জন্য ‘টাকশাল’ কায়েম করেন, যার ফলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক ভিত সুদৃঢ় হয়।
আব্দুল মালেক সরকারী ফরমান ও চিঠিপত্রসমূহে ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ খুদাই করিয়েছিলেন এবং রাজা-বাদশাদের লিখিত পত্রাবলিতেও তা লিখিত হত। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একবার রুমক কায়সার খলিফা আবদুল মালেকের ইসলামী মুদ্রা তৈরির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং হুমকি প্রদান করেন যে, এ রীতি পরিহার করা না হলে তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, সুতরাং তা বর্জন করুন। এ প্রথা আপনার জন্য শুভ হবে না। আবদুল মালেক এ হুমকির প্রতিবাদে রুমি মুদ্রা বাতিল করে ইসলামী মুদ্রার প্রচলন করেন। আবদুল মালেকের ন্যায় দুঃসাহসী খলিফার পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল রুমক সম্রাটের কঠোর হুমকির এরূপ কঠোর জবাব দান করা। তিনি রুমি মুদ্রার স্থলে ইসলামী মুদ্রা চালু করে তাতে ‘কুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ খোদাই করে দেন।
খলিফা আবদুল মালেক ক্ষমতাসীন হওয়ার পূর্বে তাঁর নামাজ, তেলাওয়াতে কোরআন এবং সর্বদা এবাদত বন্দেগী উদাহরণে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে খেলাফতের নানা দায়িত্বে ব্যস্ততার কারণে সে নিয়ম আর কায়েম থাকেনি। তথাপি তাঁর আপাদমস্তক ধর্মীয় রঙে রঞ্জিত ছিল বলে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা হতে জানা যায়। তাই তার খেলাফত জীবনে দেখা যায়, তিনি নিজের আঙটিতে খোদাই করে রেখেছিলেন এই বাক্য, ‘আমানতু বিল্লাহি মুখলেসান’ অর্থাৎ আমি খাঁটি অন্তরে আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি। এ পবিত্র বাক্য আল্লাহর প্রতি তাঁর আনুগত্যের বলিষ্ঠ প্রমাণ।
খলিফা আবদুল মালেকের শাসনামাল পর্যন্ত সরকারী দফতরগুলোতে ফার্সি এবং রুমি ভাষা চালু ছিল। আবদুল মালেক দেখলেন যে, এ ব্যবস্থা বিভিন্ন অনিয়ম ও ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। তাই তিনি আরবী ভাষাকে দপ্তরী (সরকারি) ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন, যার ফলে কেবল রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সহজ হয়ে যায়নি, বরং আরবী ভাষার প্রচার-প্রচলনের ফলে বিরাট উন্নয়ন সাধিত হয়।
সরকারি দপ্তরসমূহে আরবী ভাষার প্রথম প্রবর্তক হিসেবে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ানের নাম ইসলামী ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার পরবর্তী সময়ে তার বড় পুত্র প্রথম ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালেকের শাসনামলকে বলা হয় উমাইয়াদের ‘সোনালী যুগ’। তার বিশাল বিজয় মালার জন্য তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ওয়ালিদের সৌভাগ্য হয়েছিল যে, তিনি মোহাম্মদ ইবনে কাসেম, কোতাইবা ইবনে মুসলিম, মুসা ইবনে নোসাইর এবং মাসলামা ইবনে আবদুল মালেকের ন্যায় বিশ্বসেরা সিপাহসালার পেয়েছিলেন, যারা ইউরোপ ও এশিয়ার রণাঙ্গনগুলোতে ঘোড়া ছুটিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে ইসলামী রাষ্ট্রের ঝান্ডা বুলন্দ করেছিলেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।