বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হাল জমানায় ‘কুফর’ ও ‘কাফের’ শব্দের ব্যবহার বহুলাংশে বেড়েছে বলেই মনে হয়। কেননা, মুসলমান রাজা-বাদশাহদের দ্বারা শাসিত রাষ্ট্রগুলোতে ব্যক্তিবিশেষের প্রতি ‘কুফর’ ও ‘কাফের’ শব্দের ব্যবহার ঢালাওভাবে করা হচ্ছে। বাছ নেই, বিচার নেই, শরয়ী প্রমাণের বালাই নেই, যত্রতত্র রাজানুগত্য প্রদর্শনের আলখাল্লাহ গায়ে দিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ উল্লিখিত শব্দ দু’টির দ্বারা অন্যকে হেয়, অপাঙ্ক্তেয় ও ইসলাম থেকে খারিজ প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে অপতৎপরতায় মেতে উঠেছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এটা যেন পদ্মদীঘির নৃত্য চপল তরঙ্গের অথৈ মেলা। যার কোনো এক প্রান্তে ঢেউয়ের সৃষ্টি হলেই তা নর্তন-কুর্দনসহ আশপাশ তোলপাড় করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমনটি কোনো বিবেকবান মুসলমানের কাম্য হতে পারে না। আর পারে না বলেই কুফর এবং কাফিরের যথার্থ পরিচয় অবহিত হওয়া একান্ত দরকার।
বস্তুত যা ঈমান ও ইসলামের বিপরীত তা-ই হলো ‘কুফর’। কুফরের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ঢেকে রাখা। আচ্ছাদিত করা, গোপন করা, অস্বীকার করা, অকৃতজ্ঞতা জানানো। আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় কুফর হলো, জরুরিয়াতে দ্বীন তথা ইসলামের অত্যাবশ্যকীয়, সুস্পষ্ট, সর্বজনবিদিত বিষয়াবলিকে অস্বীকার করা অথবা তন্মধ্য থেকে কোনো একটি বিষয় অস্বীকার করা।
আর ঈমানের বিপরীত কুফর হলো, যে বিষয়ে ঈমান বা আন্তরিক বিশ্বাস থাকা আবশ্যক, সেখানে ঈমান না থাকা। (শরহুল মাকাসিদ : খন্ড ৩, পৃ. ৪৫৭)। আয়েম্মায়ে মুজতাহেদিন কুফরকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করে বিশ্লেষণ করেছেন। এতে করে কে প্রকৃতই কাফের তা শনাক্ত করা সহজতর হয়ে উঠেছে। আর এগুলো হচ্ছে প্রধান প্রধান কুফুরি। যথা:
ক. কুফরে ইনকার: যারা জরুরিয়াতে দ্বীনকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে না, মুখেও তার স্বীকৃতি দেয় না। যেমন ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে অদ্যাবধিকালের সাধারণ কাফের-মুশরিক যারা, তারা অন্তরেও বিশ্বাস করে না। মুখেও স্বীকার করে না। তারা প্রকৃতই কাফের।
এদের সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর কাফেররা ওইসব বিষয় হতে মুখ ফিরিয়ে রাখে, যেসব বিষয়ে তাদেরকে ভীতিপ্রদর্শন ও সতর্ক করা হয়েছে।’ (সূরা আহকাফ: আয়াত ৩)। মোট কথা, কুফরে ইনকার হলো, ঈমান ও ইসলামের বিষয়াবলি অন্তরে ও মুখে অস্বীকার করা, সত্য বলে বিশ্বাস না করা, সত্যের নিকটবর্তী না হওয়া। (ফয়জুল বারী: খন্ড ১, পৃ.৭১)।
খ. কুফরে জুহুদ: মনে মনে জরুরিয়াতে দ্বীনকে সত্য বলে অনুধাবন করা কিন্তু অন্তর থেকে তা গ্রহণ না করা এবং মুখেও স্বীকার না করা। যেমন রাসূলুল্লাহ সা:-এর যুগের ইহুদি, নাসারা ও শয়তান ইবলিশের কুফরি।
এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘আর যখন ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা করো, ইবলিশ সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানাল। অহঙ্কার করল। সে ছিল কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা বাকারাহ: আয়াত ৩৪)। মূলত অন্তর দিয়ে সত্য জানার পরও মুখে স্বীকার না করাকে কুফরে জুহুদ বলে। যেমন ইবলিশ কুফরি করেছিল। (ফয়জুল বারী: খন্ড ৯, পৃ. ৭১)।
গ. কুফরে ইনাদ: যারা জরুরিয়াতে দ্বীনকে অন্তর থেকে মেনে নেয় এবং মুখেও স্বীকার করে। তারপরও বাতিল, ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন দ্বীনের সাথে সম্পর্কহীনতার প্রকাশ্য ঘোষণা প্রদান করে না। তারাও কাফের শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। যেমন কতিপয় ব্যক্তি সত্য দ্বীন ইসলামকে গ্রহণ করার পর, এর সাথে বর্তমান বিকৃত ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ধর্মকে সঠিক ধর্ম বলে মনে করে।
তাদের সম্পর্কে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘তোমরা কি কিতাবের এক অংশের ওপর ঈমান আনো আর এক অংশের সাথে কুফরি করো?’ (সূরা বাকারাহ: আয়াত ৮৫)। মোট কথা, কুফরে ইনাদ হলো, অন্তরে সত্যটা বুঝতে পারা, মুখেও স্বীকার করা। তারপরও অন্তর থেকে বিশ্বাস ও মান্য না করা এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন না করা। যেমন আবু তালেবের কুফরি। (ফয়জুল বারী: খন্ড ১, পৃ. ৭১)।
ঘ. কুফরে নিফাক: যারা জরুরিয়াতে দ্বীনকে অন্তর থেকে অস্বীকার করে, কিন্তু পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে মৌখিকভাবে দ্বীনের সত্যতা স্বীকার করে, এ শ্রেণীর লোককে ব্যবহারিক ভাষায় মুনাফিক বলা হয়। কাফের অপেক্ষা মুনাফিক ইসলামের জন্য জঘন্য শত্রু, বেশি ক্ষতিকর।
এদের সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী, যখন মুনাফিকরা আপনার নিকট আসে, তখন তারা বলে, আমরা সাক্ষ্য দান করি যে, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসূল।’ (সূরা মুনাফিকুন : আয়াত ১)। বস্তুত কুফরে নিফাকের রূপ হলো, মুখে তো স্বীকার করে কিন্তু অন্তর থেকে অস্বীকার করে। (ফয়জুল বারী: খন্ড ১, পৃ. ৭১)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।