Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

বুড়িগঙ্গা-কর্ণফুলীতে অভিযান

ঢাকায় ৫ দিনে ৮৯৫ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

রাজধানীসহ দেশের প্রধান নদী ও নদী তীর দখলমুক্ত করা এবং নদী খেকোদের উচ্ছেদে বারবার অভিযান চালানো হলেও কার্যত কোন সুফল মেলেনি। অভিযানের পর পরই আবার দখল করে নিতো নদীখেকোরা। পরিবেশবাদী ও নদী দখলমুক্তকরণে আন্দোলনকারী সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্থানীয় ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে নদী দখল করে আসছে। এসব চক্র উচ্চ আদালতের রায়কেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আসছিল। তবে হঠাৎ করে আবারও নদী দখলমুক্তকরণে অভিযান শুরু হলে তারা নড়েচড়ে বসে।
এদিকে চলমান অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিশিষ্ট নাগরিক ও পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন পর হলেও সরকার এবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দখলমুক্ত করতে শক্ত অভিযান পরিচালিত হওয়ায় দখলকারী চক্রগুলো নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্কটে পরেছে। সরকারের চলমান উচ্ছেদ অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে একে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলছেন স্থানীয়দের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ। গত ২৯ জানুয়ারি সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নদী ও নদীতীর দখলমুক্তকরণ অভিযান শুরু করে। অভিযান শুরুর পর গতকাল পর্যন্ত ৫দিনে ছোট বড় ভবনসহ ৮৯৫টি অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে পানগাঁও পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীরের প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশ ১৭৫ জন প্রভাবশারী দখলদার রয়েছে। এসব প্রভাবশালী নদী ও নদী তীরের ৪০ একরের বেশি জায়গা দখল করে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে ৩৩টি ডকইয়ার্ড (নৌযান নির্মাণ ও মেরামত কারখানা) রয়েছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদার ছাড়াও দখলদারদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির দু’জন সংসদ সদস্য রয়েছেন।
বিআইডব্লিউটিএর তথ্য অনুযায়ী কামরাঙ্গীরচরে নদী দখলের তালিকায় ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিমের মালিকানাধীন মদীনা ট্রেডিংয়ের নাম রয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি মদীনা ট্রেডিংয়ের বিক্রয়কেন্দ্র, গুদাম ও মদীনা স’ মিল ভেঙে দেওয়া হয়।
বিআইডব্লিউটিএর তালিকা অনুযায়ী নদীর জায়গা দখল করে ৩৩টি ডকইয়ার্ড রয়েছে। এর বেশির ভাগ সদরঘাট নৌ টার্মিনালের বিপরীতে মিরেরবাগ ও চরমিরেরবাগ এলাকায়। ডকইয়ার্ড রয়েছে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া, কার্গো লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হোসেন এবং ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের (দক্ষিণ) সভাপতি আবুল হাসনাতের। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, কোনো ডকইয়ার্ডেরই অনুমোদন নেই।
স্থানীয়রা বলেন, ডকইয়ার্ডে মেরামতের অপেক্ষায় থাকা লঞ্চের জন্য নদীর জায়গা কমে গেছে। নদীর এই অংশের পানি কালো ও তৈলাক্ত। লঞ্চ মেরামতের সময় নদীতে পোড়া তেল ফেলায় নদীর অবস্থা আরও বেহলা হয়ে গেছে।
মিরেরবাগে রয়েছে জাতীয় পার্টির নেতা বরিশাল-৩ আসনের সাংসদ গোলাম কিবরিয়ার ডকইয়ার্ড। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নদীর জায়গা দখল করে ডকইয়ার্ড তৈরির প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর দাবি, সাবেক একজন মন্ত্রীর ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তাঁর ডকইয়ার্ডের নাম দখল তালিকায় উঠেছে।
কার্গো লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেনের মালিকানাধীন বিসমিল্লাহ ডকইয়ার্ড নদীতীরের চরমিরেরবাগে। বিআইডব্লিউটিএর দাবি, এই ডকইয়ার্ড নদীর প্রায় ১৯ শতাংশ জায়গা দখল করেছে।
এছাড়া মিরেরবাগের বায়োজিদ ডকইয়ার্ডের মালিক আওয়ামী লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবুল হাসনাত। তাঁর দাবি, জায়গার মালিকানার কাগজপত্র তার কাছে রয়েছে। তবে বিআইডিব্লটিএ বলছে, নদীর ২৪ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে ডকইয়ার্ড করা হয়েছে।
একই সূত্র জানায়, অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত ৫ দিনে কামরাঙ্গীরচর, নবাবচর ও খোলামোড়া, ইসলামবাগসহ আশপাশের এলাকায় ছোট-বড় প্রায় ৮৯৫টি অবৈধ শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্যে বহুতল ভবন রয়েছে ৫৬টি। এসব ভবনের বেশির ভাগ নদী ও তীরের জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়েছিল।
গতকাল সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ১০টার দিকে পৃর্ব ইসলামবাগ থেকে কামরাঙ্গীচরের কয়লাঘাট পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান চলে। এর মধ্যে প্রায় ৫টি বহুতল ভবন এবং দোকান ও ফ্যাক্টরি রয়েছে। বহুতল ভবনগুলোর আংশিক ভাঙ্গা হলেও পুরোপুরি উচ্ছেদ করা হয়েছে টিনসেডের বাসা, দোকন ও ফ্যাক্টরিগুলো। এছাড়া ভারি স্থাপনাও ভেঙে ফেলা হয়েছে বুলডোজার দিয়ে। অভিযানের সময় সব ধারনের যানচলাচল বন্ধ ছিলো।
এদিকে, ইসলামবাগ এলাকায় ১ মাস আগে নোটিস দেয়া বিআইডব্লিউটিএর অভিযানের খবর জানতো বলে জানিয়েছে ভাড়াটিয়ারা। এতে অভিযানকলে তাদের ঘরে থাকা খাট, ফ্রিজ, ফ্যানসহ অনেক কিছুই গুড়িয়ে দেওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। এলাকাবাসী জানায়, বিআইডব্লিউটিএর অভিযানে আমরা খুশি হয়েছে। এত দিন দখলবাজরা এসব জমি দখল করে রেখেছিলো। জমি উদ্ধার হলে রাস্তা আর বড় হবে। এছাড়া নদীর মূল এলাকা অনেক বাড়বে। এটা আমাদের চলাচল করতে সহজ হবে।
ইসলামবাগের টেম্পুর পার্টস দোকানদার আবুল হোসেন বলেন, দোকান উচ্ছেদের খবর জানলে মালামাল সরানো যেত। হঠাৎ অভিযান চালানোতে মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। একইভাবে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্তরা এ কথা বলেন।
বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক আরিফ উদ্দিন জানান, ঢাকার নদীবন্দরের আওতাধীন এলাকায় ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ উচ্ছেদ অভিযান চলবে। ১১ দিনের উচ্ছেদ অভিযানের প্রথম দফায় গত ২৯, ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি ৪৪৫টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। দ্বিতীয় দফায় গত মঙ্গলবার কামরাঙ্গীরচরের নবাবচর এলাকায় দু’শতাধিক পাকা ও আধাপাকা স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এছাড়া গতকাল ইসলামবাগে ৫তলা ভবনসহ আড়াই শতাধিক বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তিনি জানান, আমরা প্রাথমিকভাবে ৬০০ স্থাপনা উচ্ছেদের পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু অভিযানে এসে বাস্তবে দেখি এ সংখ্যা আরও বেশি হবে। যে কারণে এ অভিযান প্রয়োজনে বর্ধিত হতে পারে।
তিনি বলেন, নদীর ঢাল থেকে ১৫০ ফুট অংশ নদীর। যেসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে, সেগুলোর মালামাল নিলামে তোলা হবে। নদীর সব জায়গা উদ্ধারের পর সীমানাখুঁটি বসানো হবে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও ধলেশ্বরী নদ-নদীতীরের উদ্ধার করা জায়গায় ৫০ কিলোমিটার হাঁটার পথ (ওয়াকওয়ে) ও সবুজ চত্বর তৈরি করা হবে। বুড়িগঙ্গার পর পর্যায়ক্রমে অন্য নদীগুলোতে অভিযান চলবে।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমোডর এম. মোজাম্মেল হক বলেন, চারটি নদীর তীর উচ্ছেদ করে এখানে বনায়নসহ ওয়াকওয়ে, ইকোপার্ক ও সীমান পিলার স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে দুই বছরের মধ্যে এসব স্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এরমধ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। এছাড়া তিনটি ইকোপার্ক, ১০ হাজার নদী রক্ষা পিলার ও ২০টি জেটি নির্মাণ হবে করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে নদীর তীর রক্ষায় অনির্দিষ্টিকালীন উচ্ছেদ অভিযান চলবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী

২৬ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ