Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ইসলামী ধারার রাজনীতি কোন পথে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের মধ্যে হিজাব পরার প্রবণতা বেড়েছে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্ররাও ইসলামী দীক্ষার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছেন। ছেলেমেয়েরা ব্য

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

‘পথহারা পাখি’র মতো দেশের ইসলামী ধারার দলগুলো রাজনীতির আকাশে ওড়াউড়ি করছে। তাদের অবস্থা কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘পথহারা পাখি কেঁদে ফিরে একা/ আমার জীবনে শুধু আঁধারের লেখা’-এর মতোই। নির্বাচনের আগে গতি হারিয়ে ক্ষমতার লোভে দলগুলো এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করেছে। ভোটের পর এখন আঁধারেই হাতড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের চিন্তা-চেতনা, মসজিদ-কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং উচ্চশিক্ষিত তরুণ-যুবক ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ায় ইসলামী ধারার দলগুলোর ‘সম্ভাবনা’ সবচেয়ে বেশি; অথচ ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামী ধারার দলগুলো এখন কোন পথে? 

জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, ওলি আউলিয়ারা এদেশে ইসলাম প্রচার করায় মানুষ সুফিবাদে বিশ্বাসী; এতে ইসলামী ধারার দলগুলোর ভালো করার কথা। কিন্তু তারা নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম তৈরি না করেই অন্যের প্ল্যাটফর্মে রাজনীতি করতে অভ্যস্ত হওয়ায় ইসলামী দলগুলো সুবিধা করতে পারেনি। ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী বলেন, আলেমদের মধ্যে সঙ্কীর্ণতা, হিংসা-ফাসাদ ও লোভাতুর মানসিকতার জন্যই ইসলামী ধারার দলগুলো এগোতে পারছে না। নেতৃত্বের অভাবেই ইসলামী ধারার দলগুলো সুবিধা করতে পারছে না বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আবদুর রকিব অ্যাডভোকেট।
অটোমান সম্রাজ্য বিস্তারের কাহিনী; মুঘল শাসনামলসহ উপমহাদেশে মুসলিম শাসকদের কাহিনী ইতিহাসের পরতে পরতে ভাসছে। পৃথিবীতে মুসলিম শাসকদের ইতিহাস যখন গৌরবের; তখন বাংলাদেশে ইসলামী ধারার দলগুলোর ম্রয়িমান অবস্থা। এই দলগুলোর সুবিধাবাদিতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ব্যক্তির প্রত্যাশা-প্রাপ্তির লোলুপতা ইসলামী ধারার রাজনীতির ইমেজ তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী স্কলারদের মতে, দেশের ইসলামী দলগুলোর নেতা ও কিছু আলেমের নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত সুবিধাবাদিতার পথ অনুসরণ করায় এই দলগুলো জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রইকা নীতির কারণে যেমন দেশে বামধারার রাজনীতি বিধ্বস্ত; তেমনি ইসলামী জাগরণের উর্বর ভূমি বাংলাদেশে ইসলামী ধারার রাজনীতি বিপর্যয়ের মুখে নিপতিত। হাজার হাজার পীর-মশায়েখ, ওলি-আউলিয়া, লাখো ইসলামী স্কলারের দেশে ইসলামী ধারার রাজনীতি ক্রমেই শেকড়হীন হয়ে পড়ছে। আমজনতার মনন-প্রত্যাশা উপেক্ষা করে প্রায় শতাধিক ইসলামী ধারার দল নিজস্বতা সিকেয় তুলে রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মহাজোটে শরিক হয়। তৌহিদী জনতার প্রত্যাশা উপেক্ষা করে বামদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নৌকায় উঠলেও ভোটে কারোই ভাগ্য খোলেনি। এমপি-মন্ত্রী হতে না পারায় এখন রাজনীতির সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।
কয়েক দিন আগে ঢাকার মহাখালীস্থ মসজিদে গাউছুল আযম কমপ্লেক্সে একটি সংবর্ধনা সমাবেশ হলো। জমিয়াতুল মোদাররেছীনের উদ্যোগে আয়োজিত ওই সমাবেশে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সারা দেশের প্রায় ২০ হাজার আলেম-ওলামা-মাদরাসা শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। ফজরের নামাজের পর শুরু হয়ে জোহরের নামাজ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক মানুষ একসঙ্গে বসে সমাবেশের বক্তৃতা শোনেন; অথচ গোটা সময়জুড়ে পিনপতন নীরবতা। রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশে যেখানে ৫০০ থেকে হাজার হলেই বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি; হইচইয়ে কান ঝালাপালা হয়; সেখানে এত মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সুশৃঙ্খলভাবে বসে-দাঁড়িয়ে অন্যের বক্তৃতা শোনেন। এই যে শৃঙ্খলাবোধ এ থেকে তো ইসলামী ধারার নেতাদের শেখার রয়েছে অনেক কিছু। দেশের মানুষ তো ইসলামী আকিদা শিখতে চায়, ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে যাপিত জীবনের ইসলামীকরণ করতে চায়। সে জন্যই মসজিদের নামাজের সময় জায়গা পাওয়া যায় না; ইসলামী সমাবেশে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু ইসলামী দলগুলো সেটা কাজে লাগাচ্ছে না।
ডিজিটালের এই যুগে দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ঊর্ধ্বমুখী। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জোয়ারের চেয়েও সমাজের পরতে পরতে ইসলামী জাগরণের ঢেউ উঠেছে। ইসলামী সভা-সমাবেশ এবং ওয়াজ মাহফিল হলেই দেখা যায় সেখানে শিক্ষিত তরুণ-যুবকদের উপচে পড়া ভিড়। ইসলামী জলসা, তাফসিরুল কোরআন, তাফসির মাহফিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে ওলামা-মাশায়েখদের বক্তৃতা, তাফসির শোনেন। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশে প্রচুর অর্থ খরচ করে মানুষ আনতে হয়। শুক্রবার জুমার নামাজে মসজিদে মুসল্লিদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষণীয়। এর বেশির ভাগই শিক্ষিত তরুণ-যুবক। এমনকি অপসংস্কৃতি চর্চার লীলাভূমি রাজধানী ঢাকার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়–য়া অনেক ছাত্রছাত্রীর মধ্যে দ্বীন ও শরীয়ত মেনে চলাফেরা করার প্রবণতা বেড়েছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণরা এক দিকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন; অন্য দিকে ইসলামী সভা-সমাবেশ, জলসায় যাচ্ছেন জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে। উচ্চশিক্ষিত এবং ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ; ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা যখন ব্যাপক; তখন ইসলামী ধারার দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সার চেতনা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এবং কিছু ইসলামী স্কলাররের স্ববিরোধী প্রচার-প্রচারণায় ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বিরূপ ধারণা হচ্ছে। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত তরুণকে ইসলামী ধারার দলগুলো নিজেদের দলে টানতে পারছে না; চেষ্টাও করছে না। ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামী জাগরণ সৃষ্টির উদ্যোগ দূরের কথা, নিজেদের মধ্যে বিরোধ-বিবাদ করে দল ভেঙে ভেঙে অণু-পরমাণুতে পরিণত হচ্ছে। এমনকি বহু ইসলামী ধারার দল প্যাড-সর্বস্ব হয়ে গেছে। দু-চার শ’ টাকা খরচ করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
দেশে বর্তমানে ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কত তা নিরূপণ করা দুরূহ। নির্বাচন কমিশনে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯টি। এর মধ্যে ইসলামী ধারার দল ১০টি। কিছু ইসলামী দলের পাশাপাশি প্যাড-সর্বস্ব অসংখ্য ইসলামী দল গজিয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতিতে। এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের মাঠে ইসলামী দল ও সংগঠনের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেছে। এসব দলের অধিকাংশই আওয়ামী লীগ এবং এর বি-টিম জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই জোটের হুজুগে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির সঙ্গে ছিল ৫টি ইসলামী দল। নির্বাচনের আগে ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা গেছে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় শতাধিক ইসলামি ধারার দল ও সংগঠন। এর মধ্যে প্রায় ৭০টি দল ফ্রন্ট-দলের ব্যানারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ক্ষমতাসীনদের বি-টিম বর্তমানে জাতীয় সংসদে ‘অনুগত বিরোধী দল’ জাতীয় পার্টির সঙ্গে ছিল ৩২টি ইসলামী দল। এদের নিয়েই মূলত এরশাদ ৫৮ দলের সমন্বয়ে ঢাউস জোট গঠন করেন। এরা সবাই ভোটের মাঠে সরকারি দলের সহযোগী হিসেবে ছিল। ইসলামী চেতনার বদলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সব ন্যায়-অন্যায় কাজের সমর্থন দিয়ে অনুগত প্রকাশ করেছে অন্ধভক্তের মতোই। যুগের পর যুগ ধরে এই ইসলামী দলগুলো আওয়ামী লীগের বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিলেও এবার তারা ৯০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। উদ্দেশ্য মন্ত্রী-এমপি হয়ে ক্ষমতার ভাগ নেয়া। বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন (নজিবুল বশর) রয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে; তাদের নেতৃত্বের মহাজোটের শরিক ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ)। বাকি ৪টি দল ইসলামী ঐক্যজোট (২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে এসেছে), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মাওলানা হাবিবুর রহমান) ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান) ও আটরশি’র পীরের জাকের পার্টির (মোস্তফা আমীর ফয়সাল) সঙ্গে আওয়ামী লীগের হয় নির্বাচনী সমঝোতা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে রয়েছে খেলাফত মজলিস (ইসহাক) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ (আবদুল মোমেন)। এরা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ভোট করেছেন। দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় নিবন্ধিত বাকি দুটি ইসলামী দল ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন (আতাউল্লাহ)। এই ইসলামী দলগুলোর মধ্যে কয়েকটি দল আবার একাধিক জোট ও ফ্রন্টের শরিক হিসেবে নির্বাচনপূর্ব সময় মাঠে ছিল। ইসলামী ধারার দলগুলোর মধ্যে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই পীর) ও ইসলামী ঐক্যজোট (আমিনী) ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। মরহুম সায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক ও মুফতি আমিনীর গড়া ইসলামী ঐক্যজোটের এই অংশ বিএনপির সঙ্গে নেই। বছর দু’য়েক আগে আদর্শিক দ্ব›েদ্বর অজুহাতে ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায়। অতঃপর কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশায় হেফাজত রূপ ধারণ করে আওয়ামী লীগের সমর্থনে মাঠে নামে। জামায়াত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারিয়েছে এবং হাইকোর্টের রায়ে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক হারিয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক এ দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং ‘মওদূদীবাদী চেতনা’ ধারণ করায় জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। গত ১০ বছরে দলটির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সুনামি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ঝড় বয়ে যাওয়া এবং সিনিয়র নেতারা মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানোর পরও দলটি মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে পারেনি। দলটিকে নিয়ে এখনো ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট প্রশ্নের মুখোমুখি। ইসলামী আন্দোলন স্বতন্ত্র অবস্থানে নির্বাচন করেছে। দলটির সারা দেশে কর্মী বাহিনী রয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করে এবং ভোটও পায়। এবারের নির্বাচনে দলটি ব্যাপকভাবে মাঠে ছিল। বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে দেয়া হয়নি; তবে নৌকার প্রার্থী ও ‘হাতপাখা’ প্রার্থীদের সমানতালে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে। প্রতিটি আসনে ইসলামী আন্দোলনের ভোট থাকলেও নৌকাকে টেক্কা দিতে পারবে না এই ভেবে হয়তো নির্বাচনী প্রচারণায় হাতপাখার প্রার্থীদের বাধার মুখে পড়তে হয়নি।
নির্বাচনের আগে ইসলামী ধারার দলগুলোর হাঁকডাক ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুকম্পা পেতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ১৫টি দল নিয়ে গঠিত হয় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (আইডিএ)। এর চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, কো-চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল। দশম সংসদের লক্ষীপুর-১ আসনের এমপি আউয়াল নির্বাচনে ধরা খেয়েছেন; মনোনয়ন পাননি। তার আসনে তরিকত ফেডারেশন আনোয়ার হোসেনকে এমপি করে সংসদে এনেছে। আওয়ামী লীগপন্থী ইসলামী স্কলার হিসেবে পরিচিত শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদের বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা ও মুফতি রুহুল আমিনের খাদেমুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের অনুগত। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মরহুম মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর পুত্র মুফতি রুহুল আমিন ভোটের আগে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেন। তিনি একটি আসনের নৌকার প্রতীকের প্রার্থিতা নিশ্চিত করেই এই ‘উপাধি’ দেন। কিন্তু তাকে নৌকার প্রার্থী করা হয়নি। ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসনাত আমিনীকে মহাজোট থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ ও ৩ আসন, মাওলানা আলতাফ হোসাইন কুমিল্লা-১ আসন, ইসলামিক ফ্রন্টের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহকে চাঁদপুর-৫ ও নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে প্রার্থী করার কথা ছিল। এদের কাউকেই নৌকায় না তোলায় কেউ নিজ দলের প্রার্থী হয়ে ভোট করেন; কেউ নীরব থাকেন।
অতীতে ইসলামি দলগুলোর অধিকাংশই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে সক্রিয় দেখা যেত। এর ফল পেত বিএনপি। এবার ঘটনা ছিল উল্টো। এর মূলে রয়েছে হেফাজতের আমীর শাহ আহমদ শফীর সুবিধাবাদিতা। প্রায় শত বছর বয়স্ক এই ইসলামী চিন্তাবিদ ‘শাপলা চত্বর’ সমাবেশের কারণে লাইমলাইটে আসেন। সেটাকে পুঁজি করে পুত্র ও পারিবারিকভাবে লাভবান হওয়ায় মূল চেতনা থেকে ৯০ ডিগ্রি ঘুরে যান (যদিও মুখে এখনো ১৩ দফা দাবি করেন)। হেফাজত নেতার ‘সুবিধা’ অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর নেতাদেরও ‘লোভাতুর’ করে তোলে। এরশাদ যে ৫৮ দলের সমন্বয়ে ‘সম্মিলিত ইসলামী মহাজোট’ নামে জোট করেন। তাতে ইসলামী দল ছিল ৩৪টি। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (হাবিবুর রহমান) ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান) নিবন্ধিত দল; বাকিগুলো অপরিচিত ও নামসর্বস্ব।
৩০ জানুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে সবশেষে ৩ নভেম্বর ‘সম্মিলিত ইসলামী জোট’ আত্মপ্রকাশ করে। এই জোটের শরিক দল ৮টি। এই জোটের চেয়ারম্যান মাওলানা জাফরুল্লাহ খান দীর্ঘদিন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মরহুম মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব ছিলেন। তিনি খেলাফত আন্দোলনের একাংশ নিয়ে নতুন দল করে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সারাজীবন আওয়ামীবিরোধী রাজনীতি করে নির্বাচনের আগে ‘যদি কিছু মেলে’ প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেন, কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।
ইসলামী ধারার দলগুলোর এই বেহাল অবস্থার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ও ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রকিব অ্যাডভোকেট বলেন, নেতৃত্বের অভাবেই ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর এলোমেলো অবস্থা। ’৮০-এর দশক থেকে দেখেছি মাওলানা এম এ মান্নান ডাক দিলেই ইসলামী দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতো। এখন তেমন নেতৃত্ব এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব নেই। তবে দেশ যেদিকে যাক ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। ৯ ফেব্রুয়ারি বৈঠক ডেকেছি। দেশের রাজনীতিতে বাতিল শক্তির মোকাবেলায় সৎ নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, এদেশ ওলি-আউলিয়ার দেশ। এদেশে কখনোই ওয়াহাবিজম স্থান পাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় আগের চেয়ে এখন মেয়েদের মধ্যে হিজাব পরার প্রবণতা বেড়েছে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে ইসলামের প্রতি দুর্বলতা। ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইসলাম সম্পর্কে জানতে চায়। ব্যক্তিজীবনে ইসলামী জীবন অনুসরণ করছে ছেলেমেয়েরা। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সেটা হচ্ছে না। এর মূলে রয়েছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ না করা। ওলি-আউলিয়ারা যেভাবে ইসলাম প্রচার করেছেন; এখন ইসলামী দলগুলো সেটার চর্চা করলেই কিছুটা হলেও সফল হতে পারবেন।



 

Show all comments
  • আব্দুস সালাম ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪০ এএম says : 0
    ইসলামী রাজনীতিকে তার আদর্শিক ও ঐতিহ্যগত ধারায় ফিরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই
    Total Reply(0) Reply
  • ইমরান ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪১ এএম says : 0
    ইসলামী দলগুলো শাসকদের নতুন কৌশলের ধরাশায়ী অংশের সহযাত্রী হিসাবে নিজেরাও সমান ক্ষতিগ্রস্থ। স্বতন্ত্র আদর্শিক অবস্থান ও সম্ভাব্য বৃহৎ ঐক্যের দিশা না পেয়ে দুই মেরুতে চলে যাওয়া প্রচলিত ইসলামী রাজনীতি এখন চরম ধ্বসের মুখে।
    Total Reply(0) Reply
  • Humaira Tabassum Himi ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪২ এএম says : 0
    বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে ইসলামি দলগুলোর সর্বোচ্চ সাফল্য ১৯৯১-এর নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ১৮টি আসন পাওয়া। তারও আগে, ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুরের দ্বিতীয় স্থান লাভও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হাফেজ্জী হুজুর এখন আর বেঁচে নেই। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীও এখন আর নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Kawser Ahammed ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪২ এএম says : 0
    ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপন করা মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সংঘবদ্ধভাবে জীবন পরিচালনা করা ইসলামের নির্দেশনা। এ সর্ম্পকে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমারা আল্লাহর রজ্জুকে (ইসলাম) আঁকড়ে ধর (ঐক্যবদ্ধ হও) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ -সূরা আল ইমরান: ১০৩
    Total Reply(0) Reply
  • জাহিদ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪২ এএম says : 0
    বিভিন্ন ইসলামী সম্প্রদায় ও গ্রুপের মধ্যে সাযুজ্যপূর্ণ ও সাধারণ বিষয়গুলো মনে রেখে ভাবতে হবে যে,সকল মুসলমানের স্রষ্টা আল্লাহ এক,তাদের নবী এক,তাদের কুরআন এক। ইজতিহাদ ও স্বাধীন চিন্তার স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা ও রীতিনীতি মুসলমানদেরকে মানসিক দিন দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেবে- এটা ঠিক নয়।
    Total Reply(0) Reply
  • গোলাম কিবরিয়া ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪৪ এএম says : 0
    ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। ইহকালীন-পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তির জন্য যা প্রয়োজন তার সবটুকুই ইসলাম বিশ্বের মানুষকে উপহার দিয়েছে। প্রতিটি মানুষই সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার বাইরে কোন মুসলমানেরই থাকার সুযোগ নেই। তাই ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সুন্নাহভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শ বিশ্বাস না করে মুসলমান হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সুন্নাহভিত্তিক রাজনীতি ছাড়া অন্যকোন রাজনৈতিক আদর্শই ইসলামী রাজনীতি নয়।
    Total Reply(0) Reply
  • পারভেজ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪৫ এএম says : 0
    কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী সকল ক্ষমতার উৎস হলো আল্লাহ। তাই কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক একমাত্র রাজনৈতিক আদর্শ হলো খেলাফত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতেই কেবল ইসলামে পূর্ণাঙ্গণ সফলতা আসবে।
    Total Reply(0) Reply
  • নজরুল ইসলাম ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪৬ এএম says : 0
    বাংলাদেশে হাজার বছরের উলামা মাশায়েখ ও ইসলামী আন্দোলনকারীদের কাজের উদ্দেশ্য যেমন ছিল মানুষ তৈরি ও সমাজগঠন। পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও নীতিচ্যুত লোভী রাজনীতিকদের কারণে আজ আদর্শের রাজনীতিও প্রায় সমান কলুষিত।
    Total Reply(0) Reply
  • খালেদ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৪:৪৮ এএম says : 0
    সেটা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই ভালো জানেন।
    Total Reply(0) Reply
  • সাইফ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৯:৫৯ এএম says : 0
    স্যার, সবছেয়ে সত্য কথা হল, যারা ইসলামী রাজনীতি করছেন বাম দল গুলোর মত এদের মাঝেও কিচু অপ্রিয় বাস্তব মিল আছে, যেমন, ক্ষমতার লোভ। আর যে বিষয়টা সবছেয়ে বেশি ক্ষতির কারন, তাহল উম্মতের মাঝে বিভক্তির সৃষ্টি করা, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট দেখুন, যত দল তত মত আর যত মত তত বিরোধ, মতের প্রার্থক্যের কারনে ইম্মতের মাঝে যখন মতবিরোধের সৃষ্টি হচ্ছে, তখনই উম্মত রাজনৈতিক ভাবে (দেশিয় কিংবা আন্তর্জাতিক ভাবে) দুর্বল ও জুলুমের শিকার হচ্ছে। আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, বাম দল গুলো যত তাড়াতাডি একটা আপোষের মঝে আশতে পারে ইসলামী রাজনীতি কারিরা তা পারেনা। আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের সকলকে হিদায়েত নসিব করুন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ