যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
দেখতে দেখতে ইউরোপিয়ান ফুটবলে শেষ হতে চলেছে আরো একটি মৌসুম। ইউরোপের শীর্ষ লিগ ধরা হয় সাধারণত ৫টা লিগকেÑ লা লিগা (স্পেন), প্রিমিয়ার লিগ (ইংল্যান্ড), বুন্দেসলিগা (জার্মান), সেরি আ’লিগ (ইতালি) ও লিগ ওয়ান (ফ্রান্স)। সব লিগেই মাত্র এক রাউন্ড করে খেলা বাকী। এদের মধ্যে স্প্যানিশ লা লিগা বাদে বাকী চার লিগই ইতোমধ্যে খুঁজে পেয়েছে চ্যাম্পিয়ন দলকে। আর লা লিগায় শেষ ম্যাচে এসেও ধরে রেখেছে রোমাঞ্চ। আবার কোন কোন লিগে মৌসুম জুড়েই চলেছে একক আধিপত্যে। ফলে তারা শিরোপা নিশ্চিত করেছে ক’য়েক ম্যাচ হাতে রেখেই। ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান-এর কথাই ধরুন। ৮ ম্যাচ হাতে রেখে সেখানে শিরোপা নিশ্চিত করে রাজধানীর ক্লাব প্যারিস সেন্ট জার্মেই (পিএসজি)। লিগ ওয়ানের ইতিহাসে যা কম ম্যাচ খেলে শিরোপা জয়ের রেকর্ড। ওদিকে তিন ম্যাচ হাতে রেখে ইতালিয়ান সেরি আ’ শিরোপা জেতে জুভেন্টাস। তারাও গড়েছে অনন্য এক রেকর্ড। এটি ছিল ‘ওল্ড লেডি’দের টানা পঞ্চম শিরোপা। এর অগেও টানা ৫ বার শিরোপা জিতেছে তারা। এর আগে কোন দল ২ বার টানা ৫ বার করে শিরোপা জেতেনি। ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে তাই ঘরোয়া লিগে দ্বিতীয়বারের মত টানা ৫ বার শিরোপা জয়ের রেকর্ড গড়েছে ‘জেব্রা’রা। এছাড়া জার্মান বুন্দেসলিগা ও ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগও চ্যাম্পিয়নদেও বেছে নিয়েছে। বুন্দেসলিগায় টানা ৪ ও লিগের ইতিহাসে ২৬ বারের মত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বায়ার্ন মিউনিখ। আর প্রিমিয়ার লিগ? সে তো এক রুপকথা! অবনমন এড়ানোর লক্ষ্যে লিগ শুরু করা একটা দল ধারাবাহিক সাফল্যেও পুরষ্কার স্বরুপ জিতে নিয়েছে শিরোপা -ইমামুল হাবীব বাপ্পি
‘দ্যা ফক্সেস’ (লেস্টার)
লেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব লিগ শিরোপা জিতবে কি-না এমন প্রশ্নে বাজির দর ছিল ৫০০০-১! অর্থাৎ আপনি যদি লেস্টারের পক্ষে ১ পাউন্ড বাজি ধরেন এবং আপনি জিতে যান, তাহলে ফেরত পাবেন ৫ হাজার পাউন্ড! অবনমনের সাথে লড়তে থাকা একটা দলের বাজির দর এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ফুটবল বোদ্ধাদের সকল হিসান-নিকাশ পাল্টে দিয়ে সেই লেস্টারই ইতিহাস গড়ে হয়েছে প্রিমিয়ার লিগ চ্যাম্পিয়ন। ফুটবলের ইতিহাসে যা ঠাই করে নিয়েছে বিষ্ময়কর এক অর্জন হিসেবে। ফুটবল বিশ্ব তাই এখন মাতোয়ারা লেস্টার জ্বরে। লেস্টার শিরোপা জিতবে এমন স্বপ্ন দেখার সাহস স্বয়ং ক্লাবের মালিকও কখনো করেননি। এর প্রমাণ মিলবে গত বছরের ঘটনায়, যেবার একটুর জন্য অবনমন এড়াল লেস্টার সিটি। লেস্টারের স্বত্বাধীকারি তাতেই মহা খুশি। দারুণ এই ‘সাফল্যে’র জন্য ক্লাবটির থাই মালিক গোটা দলকে নেমন্তন্য করেছিলেন থাইল্যান্ডে। ব্যাংককের সেই শুভেচ্ছা সফরে গিয়ে লেস্টারের কয়েকজন খেলোয়াড় যে কা- করেছিলেন তাতে লজ্জায় মুখ লুকোনোই দায় ছিল ক্লাব কর্তাদের। আর সেই ব্যাংকক-কলঙ্ক সামাল দিতে দলে যেসব পরিবর্তন আনা হলো, তারই ফলাফলে লেস্টার হয়ে গেল চমকে দেওয়া এক চ্যাম্পিয়ন দল!
তাদের এই স্বীকৃতি ধারাবাহিক সাফল্যেরই ফল। পুরো মৌসুমে তারা হেরেছে মাত্র ৩টি ম্যাচ। হারিয়েছে ম্যানচেস্টার সিটির মত তারকাবহুল দলকে। আসলে লিগে একটা দলকে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে সকল দিক দিয়েই নৈপূণ্য দেখাতে হয় একটা দলকে। লেস্টার সেটাই দেখিয়েছে। ১৩২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মত শিরোপা জেতে দলটি। তাদেও এই সাফল্যেও নেপথ্যে কাজ করেছেন একজন রেনিয়েরি। ক্লাদিও রেনিয়েরি। ইতালিয়ান এই কোচের জাদুর স্পর্শ লেস্টারের স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেয়।
‘দ্যা ওল্ড লেডি’ (জুভেন্টাস)
জিনেদিন জিদান, রবার্তো বেজিও, ফ্যাবিও ক্যানভারো, মিশেল প্লাতিনি, থিয়েরি হেনরির মত ফুটবল তারকাদের ক্লাব হল জুভেন্টাস। ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ লিগ ইতিালিয়ান সেরি আ’তে এবারো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা, তাও আবার তিন ম্যাচ হাতে রেখেই। ২০১১-১২ থেকে চলতি ২০১৫-১৬ মৌসুম টানা পাঁচ বার ইতালির সেরা দল নির্বাচিত হল ‘দ্যা ওল্ড লেডি’ খ্যাত দলটি। ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে ঘরোয়া লিগে এ নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত টানা পাঁচ বার শিরোপা জয়ের রেকর্ড গড়েছে তুরিনের দলটি। সব মিলে এটি তাদের ৩২তম লিগ শিরোপা।
অথচ ঘরোয়া লিগে মৌসুমের শুরুটা কি বাজে ভাবেই না হয়েছিল জুভেন্টাসের। প্রথম তিন ম্যাচে কোন জয় নেই, হার দু’টিতেই। ১০ ম্যাচ শেষে সেই হিসাবটা তো আরো নাজুক। আগের মৌসুমে পুরো ৩৮ ম্যাচে যে দলের নামের পাশে হার মাত্র তিনটি, সেই দলকে ৪ বার পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয়েছে মৌসুমের প্রথম ১০ ম্যাচেই। জয় মাত্র তিনটি! জুভদের হঠাৎ ঐ ছন্দ পতনের উল্লেখযোগ্য কারনও ছিল। ক্লাবের হয়ে দুর্দান্ত দুই মৌসুম কাটানোর পর হঠাৎই নিজ দেশের ক্লাব বোকা জুনিয়ার্সে ফিরে যান আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার কার্লোস তেভেজ। তেভেজের মত এমন একজন তারকা ফরোয়ার্ডের শূন্যতা পূরন করা সহজ নয়। একই মৌসুম শেষে ক্লাবের জার্সি খুলে রাখেন দলের প্রানভোমরা আন্দ্রেয়া পিরলো। দলের শুন্যতার তালিকা আরো দীর্ঘ হয় আরেক তারকা আরতুরো ভিদালের বিদায়ে। ইতালি ছেড়ে এখন জার্মানির দল বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন এই চিলিয়ান মিডফিল্ডার। কিন্তু জুভেন্টাসের মত দলের এই বিশাল শুন্যতা পুরনের দায়ীত্ব নেবেন কে? আরো ভালো করে বললে কে কে? ঠিক এমন পরিস্থিতিতে পিরলোর ২১ নম্বর জার্সিটা পারানো হয় ২২ বছর বয়সি এক তরুন খেলোয়াড়ের গায়ে। পালের্মো থেকে চলতি মৌসুমেই ৩২ মিলিয়ন ইউরোতে দলে ভেড়ানো হয় এই তরুনকে। এসময় দলের সেরা একাদশে থেকে প্রত্যাশার চাপ সামাল দেওয়াটাও চাট্টিখানি কথা নয়। অথচ সেই প্রত্যাশার চাপকে কি নিপুনভাবেই না সামাল দিলেন এই তরুন স্ট্রাইকার। দলও ফিরে পেতে থাকল হারানো ছন্দ। সেই তরুন হলেন এক আর্জেন্টাইন, নাম পাওলো দিবালা। এখন পর্যন্ত লিগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (১৬) গোল করে রেখেছেন দলের শিরোপা জয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। যেকারনে ১০ ম্যাচ পরের গল্পটা সম্পূর্ণ উল্টো। ২৫ ম্যাচের ২৪টিতেই জয়, বাকিটা ড্র! ১০ ম্যাচ শেষে পয়েন্ট তালিকায় ১২ নম্বরে থাকা দলটিই তিন ম্যাচ হতে রেখেই শিরোপ নিশ্চিত করল। এর আগে ১৯৩০-৩১ থেকে ১৯৩৪-৩৫ পর্যন্ত টানা ৫ বার শিরোপা জিতেছিল জুভেন্টাস।
‘দ্যা রেড এন্ড ব্লু’ (পিএসজি)
ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ানে পিএসজির শিরোপা জয়ের অতীত রেকর্ডও ছিল। ১৯৮৫-৮৬ মৌসুমের শিরোপা জয়ের পর দ্বিতীয় শিরোপর জন্য অপেক্ষা করতে হয় ৮ বছর। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমের পর আবারো দীর্ঘ দিনের বিরতীতে যায় ‘লাল-নীল’ খ্যাত দলটি। এসময় দলের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য স্বত্বাধিকার কিনে নেন কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট। এরপর একেবারে ঢেলে সাজানো হয় দলটিকে। ইউরোপের নামজাদা সব দল থেকে উড়িয়ে প্যারিসে নিয়ে আসা হয় জøাতান ইব্রাহিমোভিচ, এডিনসন কাভানি, ডেভিড সিলভা, লুকাসের মত খেলোয়াড়। চলতি মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে নতুনভাবে যোগ দিয়েছেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা রাইট উইঙ্গার এঞ্জেল ডি মারিয়া। প্রায় দেড় যুগ পর নতুন জৌলুস নিয়ে আবারো ঘুরে দাঁড়ায় দলটি। ফিরেই এ নিয়ে টানা চার মৌসুম জিতল লিগ শিরোপা। ২০০৬-০৭ মৌসুমে ৩৩ ম্যাচ পর শিরোপা নিশ্চিত করেছিল অলিম্পিক লিঁও। তাদের চেয়ে ৩ ম্যাচ কম খেলে এবার শিরোপা জিতেছে পিএসজি। এক ম্যাচ হাতে রেখেই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বির চেয়ে ২৮ পয়েন্টে এগিয়ে তারা! তবে ঘরের মাঠে এমন একক আধিপত্য দেখালেও ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় এখনো অনভিজ্ঞ তারা। মানসম্পন্য সব খেলোয়াড় নিয়েও বার বার এক জায়গায় গিয়ে ছন্দ হারিয়ে ফেলছে দলটি। শেষ তিন মৌসুম কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। দলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট নাসের আল-খেলাইফিও অবশ্য আশাবাদি ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় তার দলের ভাগ্য ফেরাতে। আরব ধনকুবেরের হাতে যথন দলের ভার ততক্ষন দলের ভাগ্য পরিবর্তন হতে আর কতক্ষণ।
‘দ্যা রেডস’ (বায়ার্ন মিউনিখ)
ইতিহাস আর ঐতিহ্য কম নেই জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখের। ক্লাবটির ১১৬ বছরের ইতিহাসে রেকর্ড ২৬টি লিগ শিরোপা তাদের নামে। চলতি মৌসুমেও আধিপত্য বজায় রেখেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে দলটি। এ নিয়ে টনা ৪ মৌসুম বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতল দলটি। লিগটির ইতিহাসে টানা চার বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নজির নেই অন্য কোনো দলের। মৌসুমে মাত্র একটি ম্যাচ বাকি। ৩৩ ম্যাচে তাদের হার মাত্র ২টি, ড্র ৪টি। এমন অধিপত্যের সাথেই তারা লিগ শেষ করতে যাচ্ছে। বায়ার্নের এই সাফল্যেও নেপথ্যে আছেন একজন পেপ গার্দিওলা। আছেন রবার্ট লেয়ানোদোস্কি, টমাস মুলার, আরিয়েন রোবেন, ম্যানুয়েল নয়্যারের মত বিশ্ব বিখ্যত খেলোয়াড়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।