পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
পাহাড়ী খর স্রোতা বহতা নদী কর্ণফুলী এবার কল কল রবে বয়ে যাবে বঙ্গোপসাগরে। প্রকৃতির বিশাল দান হাজার বছরের চট্টগ্রাম বন্দরের ধারক কর্ণফুলী নদী বাঁচাতে অবশেষে গতকাল সোমবার থেকে শুরু হয়েছে সাঁড়াশী উচ্ছেদ অভিযান। বাড়িঘর, সুরম্য ভবন, দোকান-পাট, আড়ত, তথাকথিত সংগঠন-সমিতির অফিস, অপরাধীদের আখড়াসহ আড়াই হাজার চিহ্নিত অবৈধ স্থাপনা সমূলে উচ্ছেদ করা হবে চলমান অভিযানে। গতকাল প্রথম দিনের অভিযানে স্কেভেটর, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় ছোট-বড় মিলিয়ে অর্ধ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রায় চার একর জমি দখলমুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে নদী দখলবাজ এমনকি সরকার দলীয় পরিচয়ধারী প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনাও এখন ভূমিস্যাৎ হয়ে গেছে। উচ্ছেদের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অবৈধ দখলবাজরা শত অপকৌশলে বেদখল টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা চালায়। তবে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের কঠোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দৃঢ়তায় ‘অসাধ্য’ সাধন সম্ভব হলো। দেরীতে হলেও সরকারের এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপ চট্টগ্রামবাসীর ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছে। শুধু তাই নয় গত ৩১ জানুয়ারি হাইকোর্টের ঐতিহাসিক আদেশ ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সমগ্র দেশের ‘আক্রান্ত’ সাড়ে চারশ’ নদ-নদী পুনরুদ্ধারের পথে অনুসরণীয় এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো কর্ণফুলী নদীর বেদখলবাজদের উচ্ছেদের মধ্যদিয়ে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন সাফ জানিয়ে দেন, কোনো হুমকি-ধমকিতে অভিযান থামবে না।
কর্ণফুলী নদী ও তীরভূমি অবৈধ দখলবাজদের কব্জামুক্ত করার পর বিস্তীর্ণ সেই জায়গায় দেশী-বিদেশী পর্যটক আকর্ষণের জন্য সৌন্দর্যবর্ধন, চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্যতা সুরক্ষাসহ দলিলমূলে সীমানা পিলার স্থাপন করে জমি সুরক্ষা করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এটি হবে কক্সবাজারের পর পর্যটনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। কেননা কর্ণফুলী হয়ে সমুদ্র পর্যন্ত বেড়ানোর আনন্দই হবে আলাদা। তাছাড়া নির্মাণাধীন টানেলের সুবাদে কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরে শহর গড়ে ওঠা তথা হংকংয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ প্রসারের পথ হয়েছে এখন সুগম। কর্ণফুলী নদী অবৈধ দখলমুক্ত করতে হাইকোর্টের একটি রিট পিটিশনের (নং ৬৩০৬/২০১০) বিগত ২০১৬ সালের ১৬ আগস্টের আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অবশেষে গতকাল প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলো। দুই জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সকাল থেকে অভিযান চলে দিনভর। আজ (মঙ্গলবার) সকাল ৯টা থেকে ফের অভিযান শুরু হবে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে আড়াই হাজার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে ২ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা মূল্যের ১৫৮ একর জমি দখলমুক্ত করবে জেলা প্রশাসন। ব্লক ভাগ করে প্রতিদিন সুর্যান্তের পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করা হবে।
প্রথম দফায় নগরীর সদরঘাট থেকে শুরু হয়ে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত অংশে চলছে অভিযান। এ অংশে প্রায় দুই শতাধিক স্থাপনা রয়েছে। অভিযানের একপর্যায়ে সেখানে পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন। এ সময় তিনি উচ্ছেদ শুরুর পরও হুমকি-ধমকির কথা জানিয়ে বলেন, এসব হুমকির আমরা পরোয়া করি না। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে।
সকাল সোয়া ১০টায় শুরু হয় এ অভিযান। জেলা প্রশাসনের নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান ও তৌহিদুর রহমানের নেতৃত্বে এ অভিযানে শরিক হন বিপুল সংখ্যক র্যাব-পুলিশসহ ১০টি সংস্থার প্রতিনিধিরা। শতাধিক শ্রমিক বুলডোজার, স্কেভেটর, হাতুড়ি, শাবল নিয়ে অভিযানে শরিক হয়। নগরীর সদরঘাটের লাইটারেজ জেটি এলাকায় অভিযানের শুরুতে ভাঙ্গা হয় কর্ণফুলী সাম্পান মাঝি মালিক সমিতির অফিস। এরপর সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিসির অবৈধ একটি দেয়াল ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। কাঁচা, সেমিপাকা, বিভিন্ন স্থাপনার পাশাপাশি কর্ণফুলী ডক ইয়ার্ডের কিছু স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। সদরঘাট-মাঝিরঘাট থেকে অভিযান এগিয়ে যায় বারিক বিল্ডিংয়ের দিকে।
অভিযানে সাধারণ মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে দেখা গেছে। অবৈধ স্থাপনা যারা গড়ে তুলেছিলেন তাদের অনেকে নিজ উদ্যোগে স্থাপনার মালামাল সরিয়ে নিচ্ছিলেন। স্থানীয়রা অভিযানকে স্বাগত জানান। পুলিশের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক র্যাব সদস্য পুরো এলাকায় মোতায়েন করা হয়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও উচ্ছেদ অভিযানে শরিক হয়েছেন। উচ্ছেদ অভিযানে যোগ দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিআইডব্লিউটিএ, কর্ণফুলী গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিনিধিরা।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, কর্ণফুলী নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে তিন ধাপে। প্রথম দফায় সদরঘাট, মাঝির ঘাট হয়ে বারিকবিল্ডিং এলাকা পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। এই এলাকায় প্রায় দুই শতাধিক স্থাপনা রয়েছে। প্রথম ধাপে উচ্ছেদ শেষ হলে মোট ১০ একর জায়গা দখলমুক্ত করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয় দফায় বারিক বিল্ডিং থেকে পতেঙ্গায় কর্ণফুলীর মোহনা পর্যন্ত এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চলবে। তৃতীয় ধাপে নগরীর চাক্তাই থেকে শুরু করে মোহরা পর্যন্ত চলবে উচ্ছেদ অভিযান।
প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনাও উচ্ছেদ
আরএস রেকর্ড মূলে কর্ণফুলী নদীর বাকলিয়া ও পূর্ব পতেঙ্গা মৌজায় মোট ২১১২ জন অবৈধ দখলদার এবং বিএস রেকর্ড মূলে বাকলিয়া, মাদারবাড়ী, গোসাইলডাঙ্গা, মনোহরখালী, ফিরিঙ্গি বাজার মৌজায় ৬০ জন অবৈধ দখলদার আছেন। এর বেশিরভাগই প্রভাবশালী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। চলমান অভিযানে কর্ণফুলীর উভয় তীরে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রভাবশালী এমনকি সরকার দলীয় পরিচয়ধারী হোমরা-চোমরাদের অবৈধ স্থাপনাগুলোও উচ্ছেদ করা শুরু হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে সরকার দলীয় নামধারী ভূমিহীন সমিতি, বাস্তুহারা সমবায় সমিতি, সদরঘাট সাম্পান চালক সমবায় সমিতি, সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডবিøউটিএ) অবৈধ লোহার স্থাপনা, লাইটার জাহাজ ও নৌকায় শ্রমিক সরবরাহকারী মালেকসহ বিভিন্ন ‘মাঝি’র (সর্দার) অবৈধ স্থাপনা, বহুল আলোচিত-সমালোচিত সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার মোঃ রশীদের মালিকানাধীন ‘কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সে’র নামে দখলকৃত অবৈধ স্থাপনা। এরমধ্যে অনেকগুলো অবৈধ স্থাপনা টিকিয়ে রাখার অসদুদ্দেশ্যে আয়ের বখরা পুলিশ, ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে কতিপয় ‘সাংবাদিক’ নামধারী চাঁদাবাজদের পকেটে পর্যন্ত যাচ্ছিল দীর্ঘদিন যাবৎ। মাঝিরঘাট এলাকায় বেসরকারি কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের বেদখলে থাকা জায়গা উদ্ধারের সময় সেখানে পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন।
তিনি জানান, হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী উচ্ছেদ শুরু হয়েছে। অভিযান চলতে থাকবে। আরএস দলিল অনুযায়ী যতটুকু ভাঙ্গা দরকার সবটুকুই ভেঙ্গে দেওয়া হবে। কাউকে কোন ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। উচ্ছেদের পর প্রথমে এ জমি দখলে নেয়া হবে এবং এরপর দৃষ্টিনন্দনের কাজ শুরু হবে।
গত বৃহস্পতিবার কর্ণফুলীকে দখলমুক্ত করতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয় জেলা প্রশাসন। এরপর শনিবার কর্ণফুলী এলাকা পরিদর্শনে যান ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তিনি দখলদারদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, তারা সরকারের চেয়ে প্রভাবশালী নন। কর্ণফুলী রক্ষায় সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার ঘোষণা দেন তিনি। এরআগে তিনি গত ১২ জানুয়ারি ভূমিমন্ত্রী হিসেবে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ঘোষণা করেন, যে যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, কর্ণফুলী নদী সুরক্ষায় শিগগিরই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হবে। সহসা কথা রাখলেন চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ভূমিমন্ত্রী।
এদিকে অবৈধ দখলবাজদের কবল থেকে কর্ণফুলী সুরক্ষায় হাইকোর্টের পূর্ববর্তী আদেশ ছাড়াও এরইমধ্যে গত ৩১ জানুয়ারি নদ-নদী দখল ও উচ্ছেদ নিয়ে ‘কানামাছি খেলা’ হচ্ছে মন্তব্য করে হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, এ খেলা বন্ধ হওয়া উচিৎ। তুরাগ নদীর অবৈধ স্থাপনা দখলমুক্ত করার নির্দেশনা চেয়ে করা একটি রিট মামলার রায় ঘোষণাকালে গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে এমনটি পর্যবেক্ষণ আসে। উচ্চ আদালত অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করতে তুরাগ নদীকে ‘লিগ্যাল পারসন’ ঘোষণা করেন। ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে মানুষ যেভাবে সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করে উচ্চ আদালতের এই আদেশের মধ্যদিয়ে নদ-নদীর ক্ষেত্রেও তেমনটি মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হলো। এ আদেশের সুবাদে দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদীসহ দেশের ‘আক্রান্ত’ সাড়ে ৪শ’ নদ-নদীও লাভ করলো মানুষের মতোই বাঁচার আইনি অধিকার।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।