Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বর্তমান সমস্যায় শতবর্ষের পুরনো ভুলের প্রতিফলন

ইউরোপে ইসলাম

দি ইকনোমিস্ট | প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

প্রতিবারই ইউরোপের কোনো শহর যখন ব্যাপক সহিংসতায় প্রকম্পিত হয়, সে সময় মহাদেশের হেভিওয়েট সংবাদপত্রগুলোর আয়োজকরা কী ভুল হল তা নিয়ে যন্ত্রণাদায়ক বিতর্কে লিপ্ত হন। বিশেষ করে, বিতর্কে যে প্রশ্নটি ওঠে তা হচ্ছে ইউরোপীয় দেশগুলো কী তাদের বিশাল, অসন্তুষ্ট মুসলিম সংখ্যালঘুদের সাথে সাংস্কৃতিক ব্যবধানকে আরো উদারতার সাথে গ্রহণ করে বা (যেমনটি কিছু লোক বলে থাকেন) তা দমন করার মাধ্যমে তাদের উত্থানকে পৃথক ভাবে মোকাবেলা করা উচিত ছিল? তবে বিষয়টি যখন পরিষ্কার হয়ে যায় যে ইসলাম আদতে কোনো বিষয় নয় ( যেমনটি দেখা গেছে গত সপ্তাহে মিউনিখে এক কান্ডজ্ঞানহীন তরুণের হত্যাকান্ডের ঘটনায়) , তারপরও এ বিতর্ক চলতে থাকে।
ইউরোপীয় ইসলাম বিষয়ে আমেরিকার এক শীর্ষ লেখক এ বিতর্কে অনেকটা সূ² ও অস্বাভাবিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ‘ফ্রাংকফুর্টার আলজেমেইন জাইতুং’ পত্রিকায় এক কলামের জবাবে ‘সন্ত্রাস বিষয়ে ইসলামের অনেক কিছু করার আছে’ -এর উপর জোর দিয়ে জনাথন লরেন্স যুক্তি দিয়েছেন যে ইউরোপীয় ইসলামের বর্তমান প্যাথোলজি হচ্ছে এক ধরনের শতাব্দী প্রাচীন ভূমিকম্প পরবর্তী কম্পন। অথবা এক অদূরদর্শী নীতি যা ১শ’ বছর আগে উচ্চমাত্রায় উপনীত হয়েছিল। ১৯১৬ সালের গ্রীষ্মে ব্রিটিশ সরকার ও তার মিত্ররা অটোম্যান (ওসমানীয়) রাজনৈতিক ও সর্বোপরি আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহ ফেনায়িত করতে শুরু করে। এর পরিণতিতে ব্রিটিশ নেতৃত্বে জেরুজালেম অধিকৃত হয় এবং লেভান্ট ও আরবের ধর্মীয় পবিত্র স্থানগুলোতে অটোম্যান কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। আরবদের উপর অটোম্যান শাসনের বিকল্প হিসেবে ব্রিটিশরা হাশেমি শাসনের পৃষ্ঠপোষকতা করে যারা আজো জর্দান শাসন করছে। তবে চ‚ড়ান্তভাবে লাভবান হয় সউদী রাজ পরিবার। তারা ১৯২৪ সালে মক্কা ও মদিনার দখল নেয়।
বোস্টন কলেজের প্রফেসর লরেন্স-এর মতে, এর ফলে কয়েক শতক ধরে বিশ^ব্যাপী ইসলামের উপর খিলাফতের যে সার্বিক বিনম্র প্রভাব ছিল, তার ইতি ঘটে (১৯২২ সাল পর্যন্ত তুরস্কের অটোম্যান শাসকরা ছিলেন মুসলিম বিশ্বের সুলতান)। খিলাফত শুধু অটোম্যান নিয়ন্ত্রিত বলয়ে নয়, তার বাইরের বিশে^ও শিক্ষক, ধর্মপ্রচারক ও বিচারকদের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরী করেছিল। অটোম্যান ঐতিহাসিক হানিল হিনালচুক দেখিয়েছেন সময়ের ব্যবধানে সুলতান-খলিফাদের ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি হত। কেউ কেউ উলেমা বা ধর্মীয় পন্ডিতদের নিয়ন্ত্রণ মুঠোয় রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন, অন্যরা তা করেননি। কিন্তু উনিশ শতক ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে খিলাফতের ধর্মীয় ভ‚মিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ শাসনে (দক্ষিণ এশিয়ায়) ও ওলন্দাজ শাসনাধীনে (আধুনিক ইন্দোনেশিয়ায়) ১০ কোটিরও বেশী মুসলমান বাস করতেন। তুর্কি ধর্মীয় লেখক মুস্তফা আকিয়ল উল্লেখ করেছেন যে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় মুসলমানদের উপর খলিফার প্রভাবের ফল ছিল ব্যাপক। সর্বশেষ দীর্ঘদিন শাসনকারী সুলতান আবদুল হামিদ দ্বিতীয় (শাসনকাল ১৮৭৬-১৯০৯) ফিলিপাইনের মুসলিমদের তাদের দ্বীপপুঞ্জের উপর মার্কিন প্রভাব মেনে নিতে প্রভাবিত করেছিলেন। তবে তার ব্যাপারে চরম বেদনাদায়ক স্মৃতিও কারো আছে, যেমন আর্মেনীয়রা। আর্মেনীয়রা ১৮৯৫ সালে তাদের হাজার হাজার মানুষকে হত্যার জন্য তাকে দায়ী করে।
কিছু ক্ষেত্রে অটোম্যান খলিফাদের কিছু বিষয় ছিল প্রশংসনীয়। ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের গণ্য করতে চাইত না। তাই ১৮৭০ সাল থেকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বিশ্ব মুসলমানদের মনোযোগের কেন্দ্র তুরস্ক থেকে আরবে সরিয়ে নেয়ার ক‚টনীতি শুরু করে। ওলন্দাজরা তাদের মুসলিম প্রজাদের নামাজের খোতবায় খলিফার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ বন্ধ করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে ফরাসিরা বেশী সফল হয়। তারা তাদের দখল করা আলজেরিয়া ও মরক্কোয় বিকল্প ধর্মীয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। লিবিয়াতে যতদিন অটোম্যান শাসন ছিল (১৯১২ সাল পর্যন্ত) ততদিন উত্তর আফ্রিকায় খলিফার কিছু প্রভাব বজায় ছিল। কিন্তু তুরস্কের নব্য ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদীরা ১৯২৪ সালে খিলাফতের চ‚ড়ান্ত অবসান ঘটায়। ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বহু দশক ধরে মুসলিম জগতের মান্যবর খলিফাকে অপসারণের চেষ্টা তাদের কাজকে সহজ করে দেয়।
লরেন্স যেমনটি বলেছেন, পুরনো খিলাফত বিলুপ্তির ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা পরবর্তী শতকে অধিকতর বিপজ্জনক শক্তির দ্বারা পূর্ণ হয়। তাদের মধ্যে নয়া ইসলামী খিলাফত ঘোষণাকারী আবু বকর আল বাগদাদি একজন। তিনি ইসলামিক স্টেটের নেতা। যেখানে পাশ্চাত্য শিল্প ও সঙ্গীতের সমঝদার অটোম্যানরা পাশ্চাত্য-বিরোধী সহিংসতায় ইন্ধন যোগানো পর্যন্ত পৌঁছেননি, সেখানে তারা ধর্মীয় মৌলবাদ ও অতিনৈতিকতার বৈশি^ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে, যেমন সউদী আরব ও পাকিস্তানে ধর্মপ্রচারকদের সম্পৃক্তকরণপূর্বক তুলনামূলকভাবে অটোম্যানদের সহিষ্ণুতার স্বরকে অপসারণ করেছে।
এটা কী ইতিহাসের বিভ্রন্তিকর বিশদের চেয়েও বেশী কিছু? হ্যাঁ, লরেন্সের বলা বিপজ্জনক বিকল্পদের চেয়েও বেশী। এটা বোঝা সহজ যে আজকের ইউরোপীয় ইসলামকে ইসলাম প্রধান দেশগুলোর কাছে রুদ্ধ করে রাখা যায়। তবে একভাবে না একভাবে ইউরোপের মুসলিমরা তাদের মূল দেশের ভাবনা ও রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে যেখানে তাদের ধর্মের লোকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আজকের ইউরোপীয় সরকারগুলোর এ আধুনিক উপলব্ধি প্রয়োজন যে মুসলিমদের উপর এ প্রভাব কীভাবে কাজ করে এবং সর্বোপরি অবাঞ্ছিত পরিণতির ঝুঁকি বুঝতে হবে। সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় প্রভাবের ধারা রুদ্ধ করে তারা হয়ত আরো খারাপ কিছুরই পথ খুলে দিতে পারেন।



 

Show all comments
  • MD Mosharraf Hossain ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ২:১৮ এএম says : 0
    জার্মান ইসলামকে নিষিদ্ধ করবে আর পুরো পৃথিবী জার্মানকে মানচিএ থেকে মুছে ফেলবে। ইসলাম শান্তির ধর্ম মানবতার মুক্তির ধর্ম ইসলামকে ধংস করা এতো সহজ নয়। কুরআন ও ইসলামকে দুনিয়াতে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব মানুষের যখন মানুষ তা রক্ষা করতে অপারগ হবে তখন আল্লাহ তার কুদরতি হাতে হেফাজত করবে ইনশাল্লাহ।
    Total Reply(0) Reply
  • AL Faruk ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ২:১৮ এএম says : 0
    জংগী বল, আইএস বল আর তালেবান বল সব পশ্চিমাদের সাজানো। সব কিছুই ইসলাম কে ধংশ করার জন্য।
    Total Reply(0) Reply
  • Sakil Sazzed ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ২:১৮ এএম says : 0
    হাদিসে ইহুদিদের ভবিষ্যতে মুসলমান দ্বারা মার খাওয়ার ইঙ্গিত আছে তাই এখন ওরাতো মুসলমানদের মারবেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Helal Ahmed ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ২:১৯ এএম says : 0
    ইসলাম মানবতার ধর্ম, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবন বিধান। ইসলামের বিরাধিতাকারী নমরূদ, ফেরাউনরা আল্লাহর ইচ্ছায় ধ্বংশ হয়ে গেছে। এইসব থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ নব্য কুচক্রীদেরকেও তাদের পুর্বসুরীদের ভাগ্য বরন করতে হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর এক ইশারাই এদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য যথেষ্ট।
    Total Reply(0) Reply
  • আমি বাংলার বাঘ ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ২:১৯ এএম says : 0
    ইসলাম কখন ও ধ্বংস হবে না* আল্লাহ্ সব সময় হেফাজত করবেন* বরং ধবংস হবে ইসলামের চক্রান্ত কারীরা*
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ