Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কের দানব ‘ট্রাক’

চলতি মাসে ট্রাক, লরি, পিকআপের তলায় পিষ্ট সোয়া দুইশ

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম | আপডেট : ১২:১২ এএম, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯

শত চেষ্টায়ও সড়ক-মাহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যখন হিমশিম খাচ্ছে তখন হঠাৎ করে ‘ট্রাক’ ফিরেছে দানবের চেহারায়। প্রতিদিনই ট্রাক, লরি, পিকআপ ও ভ্যানের চাকায় পিষ্ট হয়ে কেউ না কেউ প্রাণ হারাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে ট্রাক দুর্ঘটনায় ১০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। নানা উদ্যোগ নিয়েও কোনভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না বেপরোয়া চালকদের।

সড়ক বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংশ্লিষ্টররা বলছেন, দুর্ঘটনা ও হত্যার পরেও বেপরোয়া চালকদের দ্রুততর সময়ে বিচার ও যথাযথ শাস্তি না হওয়ায় এসব ঘটনা বেড়েই চলছে। বিচারহীনতার কারণে মাদকাসক্ত চালকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি তাদের বেপরোয়া আচরণও মহামারী আকাড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নতুন বছর শুরুর পর গত ২৯ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত সোয়া দু’শো মানুষ। এর মধ্যে ট্রাক, লরি ও পিকআপ ভ্যানের চাপায় মারা গেছে প্রায় ৯৫ জন। এই সংখ্যা বেড়ে চলছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গত শুক্রবার প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর সড়কে ৫ হাজার ৫১৪টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। তাদের কাছে ট্রাক-পিকআপ-লরির চাপায় নিহতের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা না থাকলেও এ সংখ্যা এক তৃতীয়াংশেরও বেশি হবে বলে সংগঠনটি জানায়।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৪৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ট্রাকের চাপায় মারা গেছেন ১২৮ জন। এছাড়া বাসের চাপায় ১২২ জন, অটোরিকশার ধাক্কায় ১৮ জন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪৪ জন, প্রাইভেটকার দুর্ঘটনায় ২৪ জন এবং সড়কের অন্য দুর্ঘটনায় আরও ৯ জন নিহত হয়।
গতকাল ট্রাক দুর্ঘটনায় ১১ জনসহ সারাদেশে সড়কে অন্তত ১২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে সাভারের আশুলিয়ায় ইটবোঝাই ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তুরাগ নদে পড়ে গিয়ে চারজনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও তিনজন। সোমবার রাতে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের দেওয়ানহাট এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় এক কলেজ ছাত্রসহ দুই বন্ধুর মৃত্যু হয়। এছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ে দু’জন, নড়াইলে একজন, চাপাইনবাবগঞ্জে একজন ও কুষ্টিয়ায় দু’জনের প্রাণহানি ঘটে। এর বাইরে গত সোমবার ট্রাকের চাপায় কেরানীগঞ্জে আপন দুই ভাই-বোন ও বিমানবন্দরের শ্যালক দুলাভাইসহ সারাদেশের সড়কে অন্তত ১২ জনের জনের মৃত্যু ঘটে।
চলতি মাসের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২ জানুয়ারি পাবনায় ট্রাকের ধাক্কায় এক নির্মাণ শ্রমিক, ৪ জানুয়ারি সাভারে ট্রাকচাপায় দুই পথচারী, সোনারগাঁওয়ে এক নারী, ৫ জানুয়ারি রাঙামাটিতে ট্রাক উল্টে এক চালক, ৮ জানুয়ারি চট্টগ্রামে লরিচাপায় দুই পথচারী, টাঙ্গাইলের কালিহাতিতে এক ট্রাকের ধাক্কায় অপর ট্রাকের চালক, চাঁপাই নবাবগঞ্জে ট্রাকচাপায় এক মোটরসাইকেল আরোহী, কুমিল্লায় পিকআপ দুর্ঘটনায় দুজন, ১০ জানুয়ারি মানিকগঞ্জে ট্রাকচাপায় এক পথচারী, ১২ জানুয়ারি হবিগঞ্জে ট্রাকের ধাক্কায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী, ১৩ জানুয়ারি সাতক্ষীরায় ইঞ্জিন ভ্যান উল্টে এক চালক, ১৮ জানুয়ারি একই জেলায় ট্রাকচাপায় একজন, ১৯ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জে বাস-ট্রাক মুখোমুখী সংঘর্ষে এক স্কুলছাত্র, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাস-ট্রাক সংঘর্ষে দুই যাত্রী, লালমনিরহাটে ট্রাকের ধাক্কায় পথচারী, লক্ষীপুরে পিকআপ-লেগুনা সংঘর্ষে এক যাত্রী, ২১ জানুয়ারি মাগুরায় ট্রাকচাপায় এক মোটরসাইকেল আরোহী, ২২ জানুয়ারি বাগেরহাটে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে তিন যাত্রী, টাঙ্গাইলে ট্রাক-লরির সংঘর্ষের পর ট্রেনের ধাক্কায় এক যাত্রী, ২৩ জানুয়ারি লক্ষীপুরে ট্রাকচাপায় সিএনজি চালিত অটোরিকশার ৭ যাত্রী, মৌলভীবাজারের বড়লেখায় ট্রাক্টরের ধাক্কায় এক পথচারী, ময়মনসিংহে ট্রাকচাপায়া স্কুল শিক্ষক, ২৪ জানুয়ারি সাতক্ষীরায় ইঞ্জিনভ্যানের চাপায় পথচারী, লক্ষীপুর পিকআপ চাপায় শিক্ষক ও ২৫ জানুয়ারি চৌদ্দগ্রামে ট্রাকের চাপায় ইটভাটার ঘুমন্ত ১৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে মালবাহী ট্রাক, লরি ও পিকআপ ভ্যান চলাচলের সময় নির্ধারণ করা থাকলেও এ নিয়ম মানা হয় না। রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে এসব ভারী যানবাহন তদরকি করার কেউ নেই। এছাড়া বেশিরভাগ দুর্ঘটনার পর চালক ও হেলপার পালিয়ে যাওয়ায় কাউকে শাস্তি পেতে হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারহনীনতার কারণে মাদকাসক্ত ও বেপরোয়া চালকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তারা গাড়ি চালানোর সময় কাউকে পরোয়া করে না। এছাড়া চালক ও মালিকদের সংগঠনগুলো বরাবরই উদাসীন থাকায় অপরাধীরা আরও সুযোগ পাচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়কের সার্বিক অব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। তিনি বলেন, চালক-পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকেও আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে জরিমানার হার বর্তমানের চেয়ে বাড়াতে হবে। এছাড়া অপরাধী চালক ও উদাসীন মালিকদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ