Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উত্তরে খরার প্রতিধ্বনি শুকিয়ে যাচ্ছে নদী

কুড়িগ্রামে ১৬টি নদ-নদীতে পানি নেই : যমুনার বুকে , শুধুই ধু ধু বালুচর : বিপাকে চরাঞ্চলের কৃষকরা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০২ এএম

শুকিয়ে যাচ্ছে দেশের নদনদী। আবার কোথাও কোথাও অসময়ে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। দেশের উত্তরাঞ্চলে কুড়িগ্রামের প্রায় ১৬টি নদ-নদী এখন পানিশূণ্য। অন্যদিকে সিরাজগঞ্জের যমুনা ও এর শাখা নদীগুলোতেও পানি নেই। অসময়ে নদীতে পানি না থাকায় কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুস্ক মৌসুম আসার আগেই এভাবে নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় সামনে ভয়াবহ খরার শঙ্কা রয়েছে। তাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি কষিনির্ভর মানুষের দুর্দশা চরমে পর্যায়ে পৌঁছার আশঙ্কাও করছেন তারা। ইতোমধ্যে পানির অভাবে চরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে হাহাকার দেখা দিয়েছে।
দেশের উত্তরাঞ্চলে সর্ববৃহৎ নদ-নদীময় জেলা কুড়িগ্রাম। দেশের বৃহৎ নদ ব্রহ্মপুত্রসহ, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদী রয়েছে এ জেলায়। আর এসব নদ-নদীর ৩১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পথে সাড়ে চার শতাধিক ছোট বড় চর-দ্বীপ জেগে উঠেছে। এসব চরাঞ্চলে ৪/৫ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। মূলত কৃষির উপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকতে হয় এই জনপদের মানুষদের।
কিন্তু গত বছর উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং নদনদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে চরাঞ্চলের কৃষককে পড়তে হয়েছে আগাম খরার মুখে। মাটির রস শুকিয়ে যাওয়ায় আবাদকৃত ফসলের ফলন নিয়ে শঙ্কিত চরের কৃষকরা। বন্যা মানেই অভিশাপ হলেও এ জেলার জন্য বন্যা আশির্বাদস্বরূপ বলেই এখন মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, কুড়িগ্রামে এবার সামনের শুষ্ক মৌসুমে বড় ধরনের খরার কবলে পড়তে পারে কৃষকরা। ইতোমধ্যে আগাম খরার কবলে পড়তে হয়েছে চরাঞ্চলের কৃষকদের। নদনদী শুকিয়ে নতুন নতুন চর জেগে ওঠার সাথে সাথে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। রোদে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে জমির মাটি। বিশেষজ্ঞরাও এ অঞ্চলে জলবায়ুর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদী খরার কবলে পড়ার আশঙ্কা করছেন।
কুড়িগ্রাম জেলার মোট আবাদী জমি ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৩ হেক্টরের মধ্যে চরাঞ্চল জমি রয়েছে ৫৫ হাজার ৪০৮ হেক্টর। আর আবাদ হয় ৩৪ হাজার ৯০১ হেক্টর জমিতে। কৃষকরা ধান, বাদাম, কাউন, সরিষা, তিল, তিশি, মাসকালাই, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া, আলু ও বাঙ্গিসহ হরেক রকম ফসল উৎপাদন করেন এসব চরাঞ্চলের জমিতে।
সদর উপজেলার চর যাত্রাপুরের কৃষক আব্দুল লতিফ (৬০) চরের তিন বিঘা জমিতে ধান, বাদাম, মাসকালাই আবাদ করেছেন। চলতি শুষ্ক মৌসুমে মাটি শুকনা থাকায় খরচ বেশি পড়েছে বলে জানান তিনি। ফলনও তেমন একটা হয়নি।
একই এলাকার বক্কর (৬৫) ও সোবহান আলী (৫৫) জানান, এবার যে তাপমাত্রা তাতে চরাঞ্চলে আবাদ করা নিয়েই সংশয়ে আছি। মাঘ মাসেই নদ-নদীর পানি কমে গেছে, বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসের দিকে যে কী অবস্থা হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়াম্যান আব্দুর রহিম রিপন জানান, এ বছর নদ-নদীর পানি কমে যাওয়ায় মাটিতে রস নেই। ফলে সেচ দিয়ে আবাদ করতে গিয়ে কৃষককে বাড়তি খরচ গুণতে হচ্ছে। তাপমাত্রা বেশি থাকায় চরের ফলনও কমে এসেছে। ফলে ধার দেনা করে আবাদ করলেও লোকসানের মুখে পড়েছেন এখানকার কৃষকরা।
জেলা আবহাওয়া অফিসের আবহওয়া পরিদর্শক এএইচএম মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, চলতি শুষ্ক মৌসুম জুন মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। তাপমাত্রা এবার ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ারও পূর্বাভাস দেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান জানান, দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় কুড়িগ্রামের আবাদী জমিতে পানি ধরে রাখার ধারণক্ষমতা কম।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে নদ-নদীসহ জীববৈচিত্রে এর প্রভাব পড়ছে। জেলাকে বড় ধরনের খরার হাত থেকে রক্ষা করতে সরকার ইতোমধ্যে নদ-নদী খনন কাজের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে পানির সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন খরার কথা স্বীকার করে জানান, জেলার নদ-নদীতে পানি না থাকায় চরাঞ্চলের কৃষকসহ অনেক কৃষকই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিশেষ প্রণোদনাসহ চরাঞ্চলের কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন তিনি।
এদিকে, কালো পানির যমুনা এবং এর শাখা নদীগুলো পানিশূন্য হয়ে এখন মৃতপ্রায়। এতে ফসল নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন সিরাজগঞ্জ জেলার কৃষকরা। নদীগুলোর বুকজুড়ে এখন শুধুই ধূ ধূ বালুচর। নদীর বুকেই কোথাও হচ্ছে চাষাবাদ, কোথাও দূরন্ত কিশোররা ক্রিকেট বা ফুটবল খেলছে।
বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ওপর দাঁড়ালেই শাখা নদীগুলোর অবস্থা আঁচ করা যায়। সেতুর দক্ষিণ দিকের ৫ নম্বর পিলার থেকে ২৩ নম্বর পিলার পর্যন্ত এবং উত্তর দিকের ৬ নম্বর পিলার থেকে ১৭ নম্বর পিলার পর্যন্ত প্রকান্ড চর জেগে উঠেছে যমুনার বুকে। সেখানেই অনেকে করছেন চাষাবাদ। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, চরাঞ্চলের প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে পলি ও দো-আঁশ মাটিতে গম, বাদাম, মিষ্টি আলু, সবজিসহ বিভিন্ন জাতের ফসল আবাদ হচ্ছে। তবে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে নদীর মাঝখানে বিশাল চর জেগে ওঠায় দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, এক সময় বাহিরকোলা নৌবন্দর, যমুনা নদীর ভূয়াপুর-জগন্নাথগঞ্জ ঘাট, সিরাজগঞ্জ পুরাতন জেলখানা ঘাট, কাজীপুর ঘাটে বড় বড় স্টিমার-লঞ্চ আসত। সেটা এখন শুধুই গল্প। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই এখন নাব্যতা সংকটে পড়ে এই জেলার অধিকাংশ নদী। নদী ঘেঁষে থাকা কৃষি জমিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বেড়েছে সেচ খরচ। সিরাজগঞ্জ সদর, কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর চরাঞ্চলের কৃষকরা ধানের সেচ নিয়ে এখন থেকেই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং ও নদী থেকে বালু উত্তোলনের কারণে এই বিপত্তি।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থসংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ডা. জহুরুল হক রাজা জানান, সিরাজগঞ্জ জেলার উন্নয়ন করতে কৃষিখাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, নদী খনন, সার-বীজ সেচ ব্যবস্থা সহজ লভ্য করতে হবে। যমুনার শাখা নদীগুলো দীর্ঘদিন যাবৎ খনন করা হয় না, এসব নদী খননের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেওয়ার পরও নদীর জমি অবৈধ দখলদার থেকে উদ্ধার করতে উদ্যোগ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদনদী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ