বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী ব্যতীত বাংলাদেশকে চিন্তাও করা যায় না। কারণ বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্যসম্পদ, যোগাযোগ এবং শিল্প কলকারখানা নদনদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। নদনদী বাংলাদেশের মানুষকে পরিশ্রমী করে তুলেছে। বাংলাদেশকে সৌন্দর্যম-িত করেছে। বাংলাদেশের নদনদী বাংলাদেশকে বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দান করে। মোঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যে সোনারগাঁর শাসনকর্তা ঈসা খান প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তা নদনদীর কারণেই সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের পেছনে নদনদীর অবদান ছিল অপরিমেয়। বাংলাদেশ যে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ তার মূল কারণ বাংলাদেশের নদনদীর পরিমাণ দেশের আয়তনের হিসেবে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অথচ এই নদনদী বাংলাদেশের বুক থেকে ক্রমাম্বয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। এটি ঘটছে কোনো প্রাকৃতিক কারণে নয়, উজানের দেশগুলোর পানি লুণ্ঠনের কারণে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই দেশের নদনদীর প্রবাহকে স্বাভাবিক দেখতে চায়। বর্তমানের সরকারও এটি মনে প্রাণে চায়। সরকার এটি চায় বলে সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে কোন চুক্তি না হলে তারা আন্তর্জাতিক আদালতে যাবেন।
মন্ত্রী তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। আসলে তিস্তাসহ অন্যান্য নদনদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে বাংলাদেশকে বহুপূর্বেই আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া উচিত ছিল। কারণ ভারত যে বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য পানি দিবে না এটি দিবালোকের মতো সত্য। বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র। আর ভারত এখন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি দ্বারা শাসিত দেশ। তারা সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মনে কষ্ট দিয়ে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে সখ্য গড়ে তুলেছে। নিজ দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের দাবিয়ে রাখতে ও তারা কোনো কাপর্ণ্যতা দেখাচ্ছে না। বাংলাদেশের পানি লুণ্ঠন করে নিজের দেশে তা ব্যবহার করা তাদের কাছে মহা আনন্দের বিষয় বৈকি? যদি বাংলাদেশের জনগণ ভারতকে সর্বতোভাবে সহায়তাও দান করে, তারপরও ভারতের কাছ থেকে পানির ন্যায্যহিস্যা পাওয়ার কোনো সুযোগ বাংলাদেশের নেই। কারণ বাংলাদেশের পানি বাংলাদেশকে পেতে হলে ভারতের দুই সরকারের অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় সরকারেরই সম্মতি আনতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে সমর্থন দিয়ে সম্মতি আদায় করলেও পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, মনিপুর, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্য সম্মতি দেবে কি-না সন্দেহ আছে। কারণ এসব রাজ্যের জনগণ সেই দলকে ভোট দেবে যে দল বাংলাদেশে থেকে নদনদীর পানি লুণ্ঠন করে তাদের জমিতে ঢেলে দেবে। ফলে বিবেকের যতই দংশন থাক না কেন ভোট পাওয়ার আশায় সবকটি রাজ্যের সরকার তিস্তার পানি চুক্তি না করার চেষ্টাই করবে। আর চুক্তি করলেও সেটি হবে প্রহসনের, চুক্তি থাকবে শুধুই কাগজে-কলমে। বাংলাদেশের নদনদী পানি শূন্যই থেকে যাবে। সুতরাং ভারতের দয়ার উপর তাকিয়ে না থেকে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া এবং নদীনদীর পানির অধিকার ফিরে পেতে আবেদন করা। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে সমুদ্রসীমা বণ্টনের ব্যাপারে সুবিচার পেয়েছে। বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র সীমানার প্রায় ১৯ হাজার বর্গ কিলোমটির সে লাভ করেছে। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের জায়গা বাংলাদেশের যে ভেতরে সেটি দাবি ও প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশ হয়তো আরও বেশি সমুদ্রসীমা লাভ করতে পারত। তাই নদনদীর পানির সঠিক বিভাজনের দাবি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার পূর্বে বাংলাদেশকে আঁটঘাট বেঁধে যেতে হবে এবং পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হবে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালত যে বাংলাদেশকে পানি দিতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা কেউ কি দিতে পারে? কারণ আন্তর্জাতিক আদালত এবং জাতিসংঘ বিশ্বের বহু সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। তারা ইসলাইলের আগ্রাসন রুখতে পারেনি। কাশ্মীরে গণভোট কার্যকর করতে পারেনি। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। সিরিয়া ও ইরাকের গৃহযুদ্ধ রুখতে পারেনি প্রভৃতি। তাই বাংলাদেশ ভারতের পানিগ্রাসী বাঁধগুলোর বিপরীতে ভারত ঘেঁষে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে পাল্টাবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। ভারত শুল্ক মৌসুমে বাংলাদেশের পানি আটকে দিলে বন্যার সময়ে বাংলাদেশ ভারতের বন্যার পানি বাংলাদেশের ঢুকতে দেবে না। ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি না পেলে বাংলাদেশ যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে বন্যার পানির হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়ে সে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রেও ভারত জোর-জবরদস্তির আশ্রয় নিতে পারে। সেজন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে জাতীয় ঐক্যবদ্ধতা। কেননা জাতীয় ঐক্যবদ্ধতাই প্রকৃত স্বাধীনতা, বিভক্তি নয়। কোন কোন গণতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় গিয়ে স্বৈরশাসন কায়েম করে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই তা করে যখন জনপ্রিয়তা কিছু কমে তখন সরকারি দল ভোট কারচুপি করে সীমিতাকারে। যখন জনপ্রিয়তায় ধস নামে তখনি স্থাপন করে একদলী শাসন। সুতরাং যেসব দেশ গণতন্ত্র থেকে একদলীয় শাসনে রূপান্তরিত হয় সেসব দেশের সরকার ও তাদের আদর্শ জনগণের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন করে না। কোন দেশের যদি আদর্শ না থাকে তবে সেই দেশের নীতি ও আদর্শের জন্য নতুন করে ভাবতে হয়। আদর্শ যত মজবুতই হোক, জনগণের সমর্থন ছাড়া তা তামাদি। তাই জনগণের ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর ঐক্যবদ্ধ জাতিই পারবে প্রকৃত পক্ষে নদনদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়সহ সকল ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের ভিত গড়তে।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।