বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আরবি মূল অক্ষর ওয়াও, সিন, লাম থেকে শব্দমূল তাওয়াচ্ছুল বা ওয়াছিলা শব্দদ্বয় গঠিত। তাওয়াচ্ছুল অর্থ কাউকে ওয়াছিলা নির্ধারণ করা, ওয়াছিলা বানানো। আরবি অভিধানে ওয়ছিলা শব্দের কয়েকটি অর্থ দেয়া আছে। যেমন- ক. ওয়াছিলা অর্থ সম্রাট বা শাসকের কাছে ব্যক্তির মান-মর্যাদা।
খ. ব্যক্তির স্তর বা মর্যদা; গ. ব্যক্তির নৈকট্যপ্রাপ্ত হওয়া, নৈকট্য লাভ করা। যেমন- বলা হয়, অমুক ব্যক্তি এমন আমল করেছে, যার দ্বারা সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছে; ঘ. আর আল ওয়াছিল অর্থ আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট ব্যক্তি, আল্লাহর নৈকট্য লাভে সচেষ্ট ব্যক্তি। (লিসানুল আরব : ১১/৮৬৬)। আম্বিয়ায়ে কেরাম, সিদ্দিকীন, শুহাদা ও পুণ্যবান ব্যক্তিদেরকে ওয়াছিলা বানানো বৈধ। মোট কথা, তাদের ওয়াছিলায় আল্লাহর কাছে দোয়া কামনা করা জায়েজ এবং সিদ্ধ ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে ইমাম সুবকি (রাহ.) বলেন, আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সমীপে দোয়াতে হুজুর (সা.)কে ওয়াছিলা বানানো সর্বোত্তম। পূর্ববর্তীকালীন ও পরবর্তীকালীন ওলামাদের কেউ ওয়াছিলা নির্ধারণকে অস্বীকার করেননি। একমাত্র ইবনে তাইমিয়াহ তাকে অবৈধ বলেছেন। সুতরাং সকল আলেমের বিরুদ্ধে একমাত্র তিনিই অবৈধতার মতের উদ্ভাবক। (রাদ্দুল মুহতার : ৫/৩৫০)।
যিনি নবী নন অথচ পুণ্যবান লোক, এমন লোকের মান-মর্যাদার ওয়াছিলা দেয়াতেও কোনো দোষ নেই। যদি আল্লাহপাকের কাছে তার মান-মর্যাদার বিষয়টি পরিজ্ঞাত হয়। যেমন- ওই ব্যক্তির নেককার হওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া অথবা ওলি হওয়া বিষয়টি সুপষ্ট ও দ্বিধা-সন্দেহমুক্ত হওয়া। (রুহুল মায়ানি : ৬/১২৮)।
মোদ্দা কথা হচ্ছে, এই যে নেককার ব্যক্তিদের জীবদ্দশাতে যেমন তাওয়াক্কুল জায়েজ, তেমনি তাদের ইন্তেকালের পরও তাওয়াক্কুল জায়েজ। এই নিরিখে; ক. হজরত আব্বাস (রা.)-এর ঘটনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নেককার এবং আহলে বাইতিন নবুওয়্যাতের ওয়াছিলা দিয়ে সুপারিশ কবুলের আবেদন করা মুস্তাহাব। (ফাতহুল বারী : ৩/১৫১); খ. নবী এবং সালেহ বান্দাদের মৃত্যুর পর আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে তাদের ওয়াছিলা দেয়া জায়েজ এবং বৈধ। (বারিকায়ে মাহমুদিয়্যাহ : ১/১৭০)। গ. বৃহৎ দল আমাদের এবং আমাদের মাশাইখদের মতে, আল্লাহপাকের কাছে দোয়া ও মুনাজাত করার সময় নবী, সালেহ, সিদ্দীক ও শহীদগণকে তাদের জীবিত অবস্থায় ও ইন্তেকালের পর ওয়াছিলা বানানো যায়। তা জায়েজ।
দোয়া ও মুনাজাতে তাওয়াচ্ছুলের পদ্ধতি হলো এই যে, দোয়ার সময় এভাবে আবেদন পেশ করবে, হে আল্লাহ, তোমার দরবারে আমার দোয়া কবুলের জন্য এবং আমার প্রয়োজন পূরণের জন্য অমুকের ওয়াছিলা ধরছি। অথবা এভাবে আরজি পেশ করবে, হে আল্লাহ, অমুকের মান-মর্যাদার ওয়াছিলায় তুমি আমার দোয়া কবুল করো, আমার প্রয়োজন পূরণ করে দাও। (আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ : ১২-১৩)।
মোট কথা, তাওয়াচ্ছুলের পদ্ধতি হলো এই যে, আল্লাহপাকের কাছে এভাবে দোয়া করবে, হে আল্লাহ, তুমি অমুক ওলির ওয়াছিলায় তোমার দরবারে আমার দোয়া কবুল হওয়ার আবেদন করছি। স্বীয় প্রয়োজন পূরণের আরজি পেশ করছি। অথবা অনুরূপ কোনো শব্দ বা বাক্যে আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করবে।
এ বিষয়ের প্রমাণ হাদিস শরিফে আছে। যেমন- ক. হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) হজরত আব্বাস (রা.)-এর ঘটনায় বলেন, (আমরা দোয়ার সময় বললাম) হে আল্লাহ, আমরা তোমার দরবারে আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর ওয়াছিলায় বৃষ্টির জন্য দোয়া করতাম, তুমি আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করতে। এখন আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর চাচার ওয়াছিলা ধরে প্রার্থনা করছি, তুমি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করো।
বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর তাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হলো। (সহিহ বুখারি : ১/১৩৮)। খ. হজরত ওমান বিন হানিফ (রা.) বর্ণনা করেন, জনৈক অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে আগমন করে আরজ করল, আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, তিনি যেন আমাকে সুস্থ করে দেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি যদি ইচ্ছা করো তবে ধৈর্য ধারণ করতে পারো, আর এটাই তোমার জন্য উত্তম। লোকটি আবার আরজ করল, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে ভালোভাবে অজু করে নিন্মরূপ দোয়া করতে নির্দেশ দিলেন, হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি- রহমতের নবী মোহাম্মাদ (সা.)-এর মাধ্যমে এবং তোমার পানে মুখ করছি। তার ওয়াছিলায় আমার রবের পানে মুখ করলাম আমার প্রয়োজনে। যাতে আমার পক্ষে ফায়সালা হয়। হে আল্লাহ, আমার ব্যাপারে তার সুপারিশ তুমি কবুল করো। (জামে তিরমিজি : ২/১৯৮)। গ. স্মর্তব্য, দোয়ার আদবসমূহের মধ্যে একটি হলো এই যে, দোয়ার আগে আল্লাহতায়ালার হামদ ও ছানা পাঠ করা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওয়াছিলা ধরা, যাতে ওই মকবুল হয়। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ : ২/৭৩)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।