Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লন্ডনের মেয়র নির্বাচন এবং বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংকট

প্রকাশের সময় : ১১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
পশ্চিমা দুনিয়ার রাজধানী হিসাবে গণ্য লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে এই প্রথমবারের মতো একজন মুসলমান মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। ৫ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক আমান খান ৪৪ ভাগের বেশি ভোট পেয়ে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যাক গোল্ডস্মিথ পেয়েছেন ৩৫ শতাংশ ভোট। প্রায় সাড়ে ৮ মিলিয়ন ভোটারের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সাদিক খানের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সম্ভবত তিনি ব্রিটেনের ইতিহাসে সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। ইসলামোফোবিয়া এবং মুসলমানবিদ্বেষী প্রচারণাকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার প্রধান কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিল কনজারভেটিভ পার্টির মেয়র প্রার্থী জ্যাক গোল্ডস্মিথ। আর লেবার পার্টির প্রার্থী সাদিক খান গ্রহণ করেছিলেন উদারনৈতিক সহাবস্থানের নীতিগত কৌশল। পশ্চিমা দুনিয়ায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল হিসেবে ইসলামবিরোধী অবস্থান ও প্রচারণা বুমেরাং হয়ে ওঠার সাম্প্রতিক সময়ে এটি দ্বিতীয় উদাহরণ। গত বছর অক্টোবরে অনুষ্ঠিত কানাডার সাধারণ নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল হিসেবে ইসলামবিদ্বেষী অবস্থান গ্রহণ করে চরমভাবে ব্যর্থ হন। জাস্টিন থ্রুডোর নেতৃত্বাধীন  লিবারেল পার্টির আগের পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে ৩৬ আসন থেকে একলাফে ১৮৪টি পেয়ে ক্ষমতার আসনে বসার কৃতিত্ব রীতিমতো অভাবনীয়। এখানেও ইসলামবিদ্বেষী ভূমিকার বদলে লিবারেলদের উদারনৈতিক সহাবস্থানের নীতিরই বিজয় হয়েছে। কানাডার নির্বাচনে স্টিফেন হার্পারের ইসলামবিদ্বেষী অবস্থানকে সেখানকার ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করার পর লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে  জ্যাক গোল্ডস্মিথের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণারই যে পরাজয় ঘটেছে শুধু তাই নয়, কনজারভেটিভ দলের ইনকামবেন্ট মেয়র বরিস জনসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে জ্যাক গোল্ডস্মিথের বিপরীতে একজন মুসলমান সাদিক খানকে মেয়র নির্বাচিত করেছেন লন্ডনের ভোটাররা। তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দুনিয়ার সাধারণ নাগরিক সমাজের এই অবস্থান পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের ভ্রমাত্মক নীতি পরিবর্তনে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখে তা এখন দেখার বিষয়। এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে চরম মুসলিমবিদ্বেষী অবস্থান গ্রহণ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প   রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থিতার দৌড়ে এগিয়ে গেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের ১৭ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে মের প্রথম সপ্তায় ইন্ডিয়ানায় প্রাইমারিতে হেরে টেড ক্রুজ এবং জন ক্যাসিচ বিদায় নেয়ার পর রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিশ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে ডেমোক্রেট দলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি সেন্ডার্সও বিদায় নেয়ার পথে। অর্থাৎ আগামী ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথমবারের মতো একজন ঘোষিত ইসলামবিদ্বেষী এবং অভিবাসনবিরোধী রিপাবলিকান প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশগ্রহন করতে যাচ্ছেন। কানাডা এবং লন্ডনের পথ ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা উদারনৈতিক মাল্টি কালচারালিজমের পক্ষে ভোট দেন, নাকি ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রায় দেন, সেই পরীক্ষার ফলাফলের জন্য আমাদেরকে আরো অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। মার্কিন জনগণের চূড়ান্ত রায়ের ফলাফল যাই হোক, সার্বিক বিচারে এবারের মার্কিন নির্বাচন বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছে।
দুই.
২০০৮ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলীয় প্রার্র্থী হিসেবে একজন আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ বারাক হোসেন ওবামার মনোনয়ন লাভ ও বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক স্থাপন করেছে প্রথমত ডেমোক্রেট দলের ইলেক্টোরাল কলেজ এবং দ্বিতীয়ত মার্কিন জনগণ। ইতিমধ্যে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরে অনেক পানি গড়িয়েছে, বিশ্বমঞ্চে অনেক নাটকীয় রক্তাক্ত ইতিহাস রচিত হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে বিশ্বের মুসলমান দেশগুলোকে ডে-স্টেবিলাইজ করার ভয়াবহ নীলনকশা এখন ওপেন সিক্রেট। নিউইয়র্কে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার অভিযোগের পর লন্ডন, প্যারিস, ব্রাসেলসসহ ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী বোমা হামলার সাথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী মুসলমানদের অভিযুক্ত করে একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতার মধ্যেই মেয়র নির্বাচনে প্রথমবারের মতো একজন মুসলমানকে মেয়র নির্বাচিত করল লন্ডনাররা।
পাকিস্তান থেকে অভিবাসী সাদিক খানের পিতা ছিলেন একজন বাস ড্রাইভার। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান থেকে লন্ডনে পা রেখেছিল আমানুল্লাহ খান ও সেহেরুন খান দম্পতির পরিবার। লন্ডনে অভিবাসী হওয়ার  কিছুদিনের মধ্যেই সাদিক খানের জন্ম হয়েছিল। দক্ষিণ লন্ডনের দরিদ্র এলাকায় সরকারি কাউন্সিল ফ্ল্যাটে বেড়ে ওঠা সাদিক খানের চিন্তার জগৎ ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। আইনে বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি লাভের পর আইন পেশায় প্রবেশের মধ্য দিয়ে দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করে এক নতুন সম্ভাবনার পথে পা রাখেন তিনি। পারিবারিক মূল্যবোধ ও পিতা-মাতার কাছ থেকেই সাদিক খান ইসলামী শিক্ষা ও ধর্মবিশ্বাসকে নিজের মধ্যে লালন করেছেন। তিনি তার আত্মজবানিতে বলেছেন, কোথাও কোনো অন্যায় দেখলে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা তার কর্তব্য, তার পিতা তাকে এই শিক্ষা দিয়েছেন। সাদিক খান লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হলে এখানে ধর্মান্ধতা এবং ইসলামাইজেশনের শিকার হতে পারে বলেও প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যাক গোল্ডস্মিথ নির্বাচনী প্রচারণায় ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেছিলেন।
গত শনিবার লন্ডনের মেয়র হিসেবে শপথ নেয়ার পর সাদিক খান যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সাথে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, আমার নাম সাদিক খান, আমি লন্ডনের মেয়র। এই শহর তাকে লন্ডনের মেয়র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার এবং নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে, এই সুযোগ তিনি লন্ডনের প্রতিটি সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চান। সাদিক খান লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনো দেশের রাজধানী শহরের প্রথম মুসলমান মেয়র হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন। সাদিক খানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে লেবার পার্টির নেতা এডোয়ার্ড মিলিব্যান্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে লেবার পার্টির এমপি ডেভিড ল্যামি বলেন, আমরা যদি কখনো অশ্বেতাঙ্গ প্রধানমন্ত্রী পাই, সেটা কেবল সম্ভব হবে সাদিক খান যা অর্জন করেছেন তার জন্য। অর্থাৎ লন্ডনের মেয়রের পদ ধরে ভবিষ্যতে একজন অশ্বেতাঙ্গ মুসলমান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর জন্য এখন প্রস্তুতি চলছে। কেনেথ লিভিংস্টোন এবং বরিস জনসনের পর গ্রেটার লন্ডনের তৃতীয় মেয়র হিসেবে শনিবার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের পর সাদিক খান মেয়র হিসেবে তার প্রথম কর্মসূচি হিসেবে রবিবার বিকালে লন্ডনের ইহুদি সম্প্রদায়ের আয়োজনে একটি হলোকষ্ট মেমোরিয়াল সিরিমনিতে অংশগ্রহণ করেছেন। কনজারভেটিভ পার্টির মেয়র প্রার্র্থী জ্যাক গোল্ডস্মিথ ইহুদি বংশোদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও ইহুদি অধ্যুষিত উত্তর লন্ডনের ভোটাররা ত্রুটিপূর্ণ ভোটার লিস্টের কারণে ব্যাপক হারে ভোট বর্জন করেছেন বলে জানা যায়। সাদিক খান এবং লেবার পার্টির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে এন্টি-সেমিটিজমের যেসব অভিযোগ উঠেছিল, মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রথম দিনেই হলোকষ্ট মেমোরিয়ালের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তার একটি সুস্পষ্ট জবাব বা বার্তা পৌঁছে দিলেন সাদিক আমান খান। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এবং কনজারভেটিভ দলের পক্ষ থেকে সাদিক খানের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্লেবুক স্টাইলে আক্রমণের শিকার হওয়ার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের বর্ণবাদী আক্রমণের পুনরাবৃত্তি হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন।  
তিন.
এবার ঢাকার মেয়র নির্বাচন এবং নির্বাচিত মেয়রদের কর্মকা- এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক। নজিরবিহীন ভোট কারচুপি, ভোটকেন্দ্র দখল এবং বিরোধী দলের প্রার্র্থীদের ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের পর এক বছর পেরিয়ে গেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ব্যতিক্রমী সংসদ নির্বাচনের প্রসঙ্গটি বাদ দিলে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক নির্বাচনের মাইলফলক  হয়ে থাকবে। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সিটি মেয়ররা এখন দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এখন সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে একতরফা নির্বাচনী তামাশা চলছে। তবে এখন বাড়তি  আকর্ষণ হিসেবে নৌকা, ধানের শীষসহ দলীয় প্রতীক এবং তৃণমূলে নির্বাচনী মনোনয়ন বাণিজ্য প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতায় উপনীত হয়েছে। সেই সাথে নির্বাচনী সহিংসতা, অস্ত্র, অর্থ ও পেশিশক্তির মাধ্যমে ভোটযুদ্ধকে কার্যত ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত করা হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতা ও পেশিশক্তির প্রদর্শনী সব সময়ই ছিল। এবার ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ জনপদের জনসম্পৃক্ত ও গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানটির গায়ে ঘৃণ্য রাজনৈতিক মোড়ক জুড়ে দেয়া হলো। অতীতে আর কখনো এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমন একতরফা, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার নজির নেই। সারাদেশে শত শত ইউনিয়ন পরিষদে বিরোধী দল বিএনপির প্রার্র্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি। আরো শত শত ইউনিয়ন পরিষদে বিএনপির জনপ্রিয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলার ভয় দেখিয়ে অথবা ভিন্নভাবে ম্যানেজ করে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। যেসব স্থানে প্রি-ইলেকশন ম্যাকানিজম সফল হয়নি, সেখানেই সরকারি দলের প্রার্থীরা প্রকাশ্য অস্ত্রের মহড়া দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং ভোটারদের সন্ত্রস্ত করে ভোটের দিনটিকে নিজেদের অনুকূলে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে বেশ ভালোভাবেই সফল হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ১০ জন নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে গত শনিবার  চতুর্থ দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দিনটি অতিবাহিত হয়েছে। এই দফায়ও যথারীতি আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। চতুর্থ দফায় সারাদেশে ৭০৩টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে প্রাপ্ত ফলাফলে ৪ শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। অবশিষ্ট আসনগুলো থেকে আওয়ামী লীগ জোটের সহযোগী, বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছে দেড় শতাধিক আসনে। আর বিএনপি জিতেছে ৬৭টি ইউনিয়ন পরিষদে। এভাবেই চলছে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচনী সার্কাস। শত শত ইউনিয়ন পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পর ভোটের দিন ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও কেন্দ্র দখলের লড়াইয়ে শত শত মানুষ হতাহত হওয়ার মধ্য দিয়ে সরকারি দলের পক্ষে অস্বাভাবিক একতরফা ফলাফল নিশ্চিত হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলছেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে’। আর এই ফলাফলের প্রতি ইঙ্গিত করে সরকারি দলের নেতারা তাদের পক্ষে শতকরা ৮০ ভাগ জনগণের সমর্থনের দাবি করছেন। তাদের এই দাবির মধ্য দিয়েই দলীয় ব্যানারে ও প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আসল উদ্দেশ্য বোঝা গেল। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান সরকার যে আন্তর্জাতিকভাবে এক প্রকার লিগ্যাসির সংকটে রয়েছে তা অস্বীকার করা যায় না। দলীয় প্রতীকে বিএনপির অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের ফলাফল তুলে ধরে। এখন বলা যাচ্ছে, দেখ, আমাদের প্রতি দেশের ৮০ ভাগ মানুষের আস্থা রয়েছে।
চার.
মার্কিন গণতন্ত্র ও মাল্টিকালচারালিজমের সাথে ব্রিটিশ রয়েল পলিটিক্সের অবশ্যই কিছু পার্থক্য আছে। এই পার্থক্যের মধ্যেও একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক ভাবধারা সমুন্নত থাকায় সেখানকার বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত ও অশ্বেতাঙ্গ নাগরিকরা রাজনীতির মূল ধারায় গুরুত্বপূর্ণ আসন অলঙ্কৃত করতে সক্ষম হচ্ছে। সেখানেও রাজনীতিতে  কাদা ছোড়াছুড়ি, বর্ণবাদী আক্রমণ, অপপ্রচার এবং সা¤্রাজ্যবাদী হেজিমনির প্রভাব রয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক সরকারি কর্মকর্তা বা ইলেকশন কমিশনের কর্মকর্তারা কখনো কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক অবস্থান নিয়ে কাউকে জিতিয়ে দেয়া বা দখলবাজির নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেননি। তা না হলে কনজারভেটিভ টোরি দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে ডেভিড ক্যামেরনের নেতৃত্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার পরও লেবার দলের পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত একজন মুসলমান নাগরিক লন্ডনের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হতে পারতেন না। বিরোধী রাজনৈতিক পরিবেশের কথা বাদ দিলেও লন্ডনের অতি শক্তিশালী জুইশ কমিউনিটি, ৫৯ শতাংশ খ্রিস্টান এবং ২৫ শতাংশ ধর্মীয় পরিচয়হীন ভোটারের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ মুসলিম ভোটার নিয়ে সাদিক খানের পক্ষে লন্ডনের মেয়র হওয়ার গৌরব অর্জন করা একটি অস্বাভাবিক বাস্তবতা।
কানাডা ও লন্ডনের নির্বাচনে ইসলামবিরোধী প্রচারণা কনজারভেটিভদের জন্য বুমেরাং হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যও সম্ভবত একই ধরনের পরিনত অপেক্ষা করছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন পর্যবেক্ষণে উল্লেখযোগ্য কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক টিম আসেনি। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের বৃহত্তম স্থানীয় সরকার নির্বাচন হিসেবে অনুষ্ঠিত সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য নয়। এভাবেই বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রথমে দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের এবং দ্বিতীয়ত সাধারণ ভোটার তথা দেশবাসীর আগ্রহ ও আস্থা হারাচ্ছে। যে দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন করতে গিয়ে একটি রক্তাক্ত সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্র ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তাই ছিল যে স্বাধীনতার চেতনার মূলমন্ত্র, সেই স্বাধীন দেশের ভোটাররা এখন দুর্বৃত্তায়িত শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামোফোবিক অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রায় দিচ্ছে সেখানকার জনগণ। আমাদের দেশে জনগণের সেই অধিকার কালো টাকা, অস্ত্র এবং শাসন ক্ষমতার অপপ্রয়োগের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমরা যতই সরকার এবং সরকারি দলের ওপর দোষ চাপাই না কেন দেশের গণতন্ত্র এবং জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা একটি সম্মিলিত ইস্যু। সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও সমর্থকদের এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ নিতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে সে ধরনের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন একেবারেই অনুপস্থিত। ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে শুরু করে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা শেষ প্রান্তে পথে নিয়ে যাচ্ছে। পুরো জাতি এখন তাদের শুভবুদ্ধির উদয় অথবা রাজনৈতিক পতনের অপেক্ষায়।
[email protected] 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: লন্ডনের মেয়র নির্বাচন এবং বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংকট
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ