বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
এই বিশ্বের সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানকার প্রতিটি জাতি-গোষ্ঠীর ওপর যে সকল বস্তু শক্তভাবে আসন গেড়ে বসে, তা হলো- পুরাতন স্বভাব, আচার-অনুষ্ঠান ও খেয়াল এবং ধারণাসমূহ, বর্তমানে ইউরোপ মহাদেশটি জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণায় সেই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সকল অবাস্তব ও আশ্চর্যকর আচার-পদ্ধতি পূর্বে সেখানে কায়েম ছিল, তা আজো বহাল তবিয়তে কায়েম আছে। শুধু কায়েম আছে বললে কম বলা হবে। বরং তা তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। নানা পরিবর্তন ও বিবর্তনশীল অবস্থার কারণে তাদের গলদ ও ত্রুটিগুলো নজরে পড়ছে ঠিকই, তবে স্বভাব-চরিত্রের প্রাধান্যের মোকাবেলায় ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রিয়তার প্রবল ধারণা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে তাদের সেই ত্রুটিগুলো ঢাকা পড়ে গেছে অথবা সেগুলো নিরর্থক ও নিষ্ফল হয়ে পড়েছে।
অপর দিকে, অন্ধকার যুগে আরবে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও গোত্রীয় স্বভাব-চরিত্র ছিল, সেগুলো তাদের অস্তিত্বের উপাদানে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ইসলাম এর প্রত্যেকটিকে দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এগুলোর মূলোৎপাটন করেছে। আরবদের উদ্দীপনার সবচেয়ে বড় বিকাশস্থল ছিল রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করা। ইসলাম এগুলোকে সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দিয়েছে। গোত্রীয় ফখর বা অহঙ্কার তাদের বংশগত জিন্দেগির প্রাণশক্তি ছিল। এটাকেও ইসলাম নির্মূল করে দিয়েছে।
আরব সর্দার আবু সুফিয়ানকেও হজরত বেলাল (রা.)-এর মতো হাবশি গোলামের সাথে বসতে হয়েছিল। কুলীন কুরাইশরা মদিনার আনসারদের বিরুদ্ধে তরবারি ধারণ করতেও নারাজ ছিল। বদর যুদ্ধের প্রারম্ভে ওতবা, শায়বাদের জবান থেকে এমন বাক্যই উচ্চারিত হয়েছিল। ইসলামের রঙে বিরঞ্জিত হয়ে মর্যাদাশীল কুরাইশ দুহিতারা মুসলিম দাসদের গৃহিণীর আসনও অলঙ্কৃত করেছিল।
হজরত যায়েদ (রা.) ও হজরত সালেম (রা.)-এর পারিবারিক জীবন এই সত্যের পতাকাই উড্ডীন করে রেখেছে। ওকাজ এবং অন্যান্য মেলা অনুষ্ঠানে যেখানে আরবরা সারা বছর একত্রিত হয়ে নিজেদের অহঙ্কার, গরিমা ও আত্মম্ভরিতার কাহিনী শোনাত, শান্তিময় ইসলামের জোয়ার ধারায় তাও চিরতরে নিষ্প্রভ ও মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল।
ইসলাম একদিকে আরবদের যাবতীয় গর্হিত অহঙ্কারকে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। অপর দিকে, ইসলামে খাহেশাতে নফসানির পায়রবি করা এবং গর্হিত পন্থায় বিত্তবানদের কোনো উপায়-উপকরণই অবশিষ্ট ছিল না। ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা মুসলমানদের গলার হার হয়ে পড়েছিল। যা অবিন্যস্ত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত লোকদের জন্য খুবই ভারী মনে হচ্ছিল।
এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘অবশ্যই নামাজ বিনীতদের ছাড়া অন্যান্যদের ওপর খুবই ভারী।’ (সূরা বাকারাহ : রুকু ৫)। রোজা, অর্থাৎ ৩০ দিন যাবত ক্রমাগত দিনে পানাহার বিবর্জিত জীবন যাপন করা কোনো সহজ কাজ ছিল না। তা ছাড়া জাকাত ছিল একটি কঠিন ট্যাক্স। শুধু কেবল তা আদায় করা নিয়েই হজরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে বিদ্রোহ প্রকাশ পেয়েছিল। শুধুমাত্র হজই ছিল এমন একটি ফরজ, যাতে প্রাণচাঞ্চল্যের উপকরণাদি বিদ্যমান ছিল।
কিন্তু তবুও ইসলাম অনুমোদিত হজ ইবাদত অন্ধকার যুগের তথাকথিত হজ প্রথা ছিল না। উলঙ্গ অবস্থায় কাবা শরিফ প্রদক্ষিণের অনুমতি ইসলাম চিরতরে রহিত করে দেয়। আরবদের প্রাণপ্রিয় বস্তু ছিল মূর্তি ও প্রতিমা। এগুলোও একত্রিত করে হেরেম শরিফ থেকে বের করে দূরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মীনা প্রান্তরে গোত্রীয় ঘটনাবলির ওপর বীরত্বব্যঞ্জক কবিতা পাঠের যে আসর যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল, তা-ও চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এই ছিল ফরায়েজ ও অপরিহার্য কর্মকান্ড পালনের নির্দেশাবলির অবস্থা। এর সাথে ছিল মুহাররামাত এবং নিষিদ্ধ কার্যাবলির বিশ্বময় মূলোৎপাটনের পালা, যার একান্ত আবেদন ছিল এই- আরবদের অন্ধকারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণাপ্রসূত জীবন ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত জীবন বলেই পরিগণিত হয়নি। বরং তা ছিল জীবনের জিন্দানখানা মাত্র।
ইসলামে যিনা, ব্যভিচার হারাম করা হয়েছে। অনুরূপভাবে শরাব, জুয়া, পাশা খেলা, বাজি রাখা, হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। পুরুষদের জন্য সোনা-রূপার অলঙ্কার ব্যবহার ও রেশমী পোশাক পরিধান হারাম করা হয়েছে। এমন কি শরাব তৈরির কাঠের তৈজসপত্রও হারাম করা হয়েছে। বাদ্যযন্ত্র, মূর্তি ও প্রাণীদের চিত্র নির্মাণ হারাম করা হয়েছে। এত কিছুর পর নির্মল প্রাণবস্তু জীবনের এবং পবিত্র জীবনের আস্বাদ উপভোগের ক্ষতিকর কোনো দিকই অবশিষ্ট রইল না।
ইসলাম এই পবিত্রময় জীবনের পথকেই বিশ্ব নবীর সামনে খোলাসা করে তুলেছে। অপর দিকে, অন্যান্য ধর্মগুলোতে আনন্দ-উপকরণের ব্যাপক সমাহার দেখা যায়। দুনিয়া জোড়া খ্রিষ্টানরা গান গেয়ে তাদের মনগড়া নামাজ আদায় করে। পার্শিয়ানরা ঢাক-ঢোল পিঠিয়ে তাদরে আরাধনা সম্পন্ন করে। হিন্দুরাও প্রার্থনার সময় ভজন-কীর্তন গায় এবং তাদের সামনে স্থাপিত থাকে বিগ্রহ মূর্তি।
কিন্তু ইসলামী ইবাদতের ক্ষেত্রে এ সকল ভ্রান্ত, নিরর্থক, মনোমুগ্ধকর ও প্রাণস্পর্শী বহিরাবরণের এবং চিত্ত-বিনোদনের কোনো সংযোগ নেই। সুতরাং আল্লাহপাকের পছন্দনীয় জীবন ব্যবস্থায়ই মুক্তি ও নিষ্কৃতির পরিচায়ক। এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।