বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
‘ওতলুবুুল ইলমা ওয়ালাও কানা বিস চীন’। কথাটি হাদিস বলে খ্যাত। যার অর্থ- তোমরা জ্ঞান লাভ করো, যদি তা চীন দেশেও থেকে থাকে। সাধারণত, এখানে চীন অর্থ দূরবর্তী স্থানকে বোঝানো হয়েছে। যেহেতু আরব দেশ থেকে পূর্ব দিগন্তে বহুদূরে অবস্থিত চীন দেশ, তাই জ্ঞানলাভের জন্য চীনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
তা ছাড়া এটাও সম্ভব যে, প্রসিদ্ধ ছিল যে, জাগতিক জ্ঞানবিজ্ঞানে সেকালে চীন খুবই বিখ্যাত ছিল। অনুমান করা হয়, এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্ব প্রথম চীন দেশের সম্রাটের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য একজন সাহাবীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ওই সাহাবীর নাম ছিল ওহাব ইবনে আবি কাবশা (রা.)। এটি ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের কথা। এরও বহু আগে ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে হাবশায় হিজরতকারী একটি সাহাবী দল ইসলাম প্রচার ও ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে চীন পর্যন্ত যান। তাদের নেতার নাম ছিল সাহাবী আবু ওক্কাস মালিক ইবনে ওহাইব (রা.) তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মামা ছিলেন। তিনি সা’দ বিন আবু ওক্কাসের পিতা আবু ওক্কাস।
বিষয়টি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। প্রথমেই আমরা ওহাব ইবনে আবি কাবশা সম্পর্কে ‘তারিখে এশায়াতে’ ইসলাম গ্রন্থের বর্ণনাটি তুলে ধরতে চাই। তাতে বলা হয়েছে- ‘রাসূলুল্লাহ (সা.) ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে ওহাব ইবনে আবি কাবশাকে ইসলামের পয়গাম পৌঁছানোর জন্য চীন সম্রাটের কাছে পাঠিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন দুনিয়ার বড় বড় সম্রাটদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র লিখেছিলেন। প্রেরিত সাহাবী যখন সামুদ্রিক জাহাজে চীনের ক্যান্টন বন্দরে পৌঁছান; তখন সেখানে তাকে বিপুল সম্বর্ধনা দেয়া হয় এবং সম্রাটের পক্ষ থেকে তাঁকে এবং তাঁর সব সফরসঙ্গীকে চীনে ইসলাম প্রচারের প্রকাশ্যে অনুমতি দেয়া হয়। তারা সেখানে চার বছর অবস্থান করেন এবং ইসলাম প্রচার করার পর মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু তারা যখন মদিনায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকাল (৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) হয়ে গিয়েছিল।’ এ বর্ণনায় ওহাব ইবনে আবি কাবশার অপর সফরসঙ্গীদের কারো নাম ও সংখ্যার উল্লেখ নেই।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের খবরে তাঁর মন ভেঙে যায় এবং কিছুদিন মদিনায় অবস্থানের পর তিনি আবার ক্যান্টনে চলে যেতে মনস্থ করেন। যাত্রাকালে তিনি কুরআনের একটি কপি সঙ্গে নিয়ে যান, যা হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) সঙ্কলন করেছিলেন। কিন্তু ক্যান্টনে পৌঁছার পর ওহাব ইবনে আবি কাবশা বেশি দিন জীবিত ছিলেন না। অসুস্থ হয়ে সেখানেই ইন্তেকাল করেন। সেখানে তাঁর মাজার এখনো চীনা মুসলমানদের জিয়ারতগাহ হিসেবে বিদ্যমান। ওহাব ইবনে আবি কাবশা মহানবী (সা.)-এর মামা ছিলেন বলে বিখ্যাত লেখক আর্লন্ড উল্লেখ করেছেন। চীনা লেখক চ্যংশন লং-ওই সাহাবীর নাম ইবনে হামজা উল্লেখ করেছেন। চীনা লেখক বদর উদ্দীন তাঁর গ্রন্থে সাদ ওক্কাল এবং মাওলানা হামেদ বদায়ুনী তার সফরনামায় লিখেছেন যে, মাজারের নামফলকে আবদুর রহমান ওক্কাস খুদিত আছে, তবে তাঁর গবেষণা অনুযায়ী নামটি আবদুর রহমান ওকাজ/ওক্কাজ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এ বর্ণনা থেকে গবেষণার আরো একটি পথ খুলে গেল যে, আবদুর রহমান ওক্কাস কে ছিলেন; কিংবা আবদুর রহমান ওকাজ কে ছিলেন। ওক্কাস এবং ওকাজ অভিন্ন ব্যক্তি নাকি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি তা নতুনভাবে গবেষণার বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। ‘তারিখে আকওয়ামে আলম’ গ্রন্থের লেখক কোনো বিশেষ ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে বলেন, আরবের পয়গম্বরের দূত একখানা তবলীগী পত্র নিয়ে আরব বণিকদের সঙ্গে ৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে চীনের সম্রাট তামি তাসুংয়ের দরবারে হাজির হন। সম্রাট দূতদের সাথে উত্তম আচরণ ও সম্মান প্রদর্শন করেন এবং তিনি আরব প্রতিনিধিদের ক্যান্টনে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেন। ক্যান্টনে এ মসজিদ এখনো বিদ্যমান।
চীনের পুরনো রেকর্ডপত্রে ওই সব আরবের অবস্থান জানা যায়, যারা আরব পয়গম্বরের পত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, সম্ভবত ওহাব ইবনে আবি কাবশাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) পাঠাননি, বরং তিনি নিজেই বণিক হিসেবে চীনে গমন করেছিলেন। ওহাব ইবনে আবু কাবশার নাম বিভ্রাটের কারণে চীনে মুসলমানদের প্রথম আগমনকারীদের বিষয়টি দারুণভাবে বিতর্কিত হয়ে পড়েছে। ১৪ শ’ বছর আগের এ ঘটনার সঠিক তথ্য উদ্ধার করা আধুনিক যুগে দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেননা, প্রায় একই ধরনের তথ্যাবলি বিভিন্ন সূত্রে আবু ওক্কাসের ক্ষেত্রেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত, আবু ওক্কাস বর্ণিত বিবরণের মধ্যে মওলানা হামেদ বদায়ুনীর বর্ণনা অনুযায়ী- ক্যান্টনে সমাহিত সাহাবীর নাম মাজারে খোদাই করা আছে আবদুর রহমান ওক্কাস। মাওলানা বদায়ুনী নকল করার সময় ভুলবশত ওক্কাসকে ওক্কাজ বা ওকাজ লিখতে পারেন। নামফলকটি সম্ভবত আরবিতে খোদাইকৃত হওয়ায় অনেক লেখকই তা গভীরভাবে লক্ষ করেননি এবং তারা বিখ্যাত সাহাবী হজরত আবু ওক্কাস (রা.)-এর নাম উল্লেখ করেছেন এবং পরবর্তীকালে লেখকদের ‘নকল দর নকল’ এর কবলে পতিত হয়ে আবদুর রহমান ওক্কাস পরিণত হয়ে গেছেন আবু ওক্কাস নামে।
ক্যান্টনে অবস্থিত সাহাবীর মাজারের নামফলকে যা খোদাই করা আছে বলে মাওলানা বদায়ুনী উল্লেখ করেছেন, তা অকাট্য প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা। আর যারা ওহাব ইবনে আবি কাবশা উল্লেখ করেছেন, তাও একই কারণে সঠিক হতে পারে না। মোট কথা, ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে পাঠানো সাহাবী পত্রবাহক সাহাবীদের অন্যতম। আর ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চীনে গমনকারী সাহাবী আবু ওক্কাস মালিক ইবনে ওহাইব ভিন্ন ব্যক্তি। যার পুত্র সা’দ ইবনে আবু ওক্কাস (রা.)।
অধিক প্রমাণিত সূত্রে ক্যান্টনে যে সাহাবীদের কবর পাওয়া যায়, তারা পত্রবাহক নন। কারণ পত্রবাহক সাহাবী নবীজীর ইন্তেকালের পর মদিনায় ফিরে গিয়েছিলেন। ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে আগত সাহাবীদলের কবরই ক্যান্টনে হয়ে থাকবে। যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের (৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) পূর্বে ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চীনে এসেছিলেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।