বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ভারতের প্রাণকেন্দ্র দিল্লি-আজমীরে রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বপ্রথম যিনি ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করেন নাম সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরী। হিন্দু রাজা পৃথ্বীরাজ তার তিন লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী ও বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেও সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরীর বারো হাজার সৈন্যের ক্ষুদ্র বাহিনীর নিকট শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। পৃথ্বীরাজের সাথে তিনহাজার জঙ্গি হাতি ছাড়াও দেড়শ’-দু’শ’ দেশীয় রাজা ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিল।
সুলতান শাহাবুদ্দীন মোহাম্মদ ঘোরী প্রথম ভারতবর্ষ বিজয়ী মুসলিম শাসক। তিনি এখানে মুসলিম শাসনের ভিত্তিস্থাপন করেন। তিনি বর্ণবাদ প্রথার বদলে এখানে ইসলামী আদর্শের সাম্য ও মৈত্রির ভিত্তিতে একটি শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম করেন। ভারতবর্ষের সব রাজ্য মিলেমিশে তাদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুলতান ঘোরীর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয় কিন্তু যেসব রাজাদের সকল চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। এই চক্রান্ত মোকাবিলার সংগ্রামে বহু মুসলমান রক্ত ঢেলে দেয় এই মাটিতে। তাদের রক্তে ভারতবর্ষে রচিত হয়েছে মুক্তি ও সংগ্রামের নতুন ইতিহাস।
মোহাম্মদ ইবনে কাসেম প্রথম মুসলিম সিপাহসালার যিনি হিন্দুস্থানে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন। কিন্তু এই রাষ্ট্র বিশাল ভারতের কেবলমাত্র একটি এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। মাহমুদ গজনবী তীব্র বায়ুবেগে এসে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ঘুরে দেখেন, কিন্তু পাঞ্জাব ব্যতীত অন্য কোনো এলাকা তার সাম্রাজ্যের অন্তভূক্ত করেননি। আরও যে বীর সেনানী হিন্দুস্তানের মূল ভূখন্ডে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেন এবং সমগ্র মহাদেশে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন তিনি ছিলেন শাহাবুদ্দীন মুহম্মদ ঘোরী।
ঘোরের পার্বত্য রাজ্যটি হিরাতের দক্ষিণ-পূর্বে এবং গজনীর উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। রাজ্যটি সুলতান মাহমুদ জয় করে তার সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করেন। গজনী শাসকদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ায় গিয়াসুদ্দীন মোহাম্মদ ঘোরের শাসনকর্তা হয়ে যান। তখন ফিরুজকুহ ছিল ঘোরের সদর। ১১৬৫ খ্রিষ্টাব্দে খসরু শাহাকে গজনী থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং ১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসুদ্দীন মোহাম্মদ ঘোরী তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শাহাবুদ্দীনকে গজনীর শাসনভার অর্পণ করেন। গিয়াসুদ্দিন মোহাম্মদ তাঁর ভ্রাতাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। শাহাবুদ্দীনও সারাজীবন তার বড় ভাইয়ের ভক্ত-অনুগত ছিলেন। গিয়াসুদ্দীনের পর ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সুলতান হন। ইনিই ভারতে ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করেন।
এ সময় দিল্লি ও আজমীরে হিন্দুরাজ্যগুলো একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী সম্মিলিত রাষ্টে পরিণত হয়েছিল। তাঁর শাসনকর্তা পৃথ্বিরাজ গজনী সাম্রাজ্যের কতিপয় সীমান্ত এলাকা অধিকার করে নিয়েছিলেন। শাহাবুদ্দীন মোহাম্মদ ঘোরী ঐসব দখলীকৃত এলাকা ফেরত দেয়ার দাবি জানালে পৃথ্বীরাজের সাথে যুদ্ধের সূচনা হয়।
ইতিপূর্বেই অর্থাৎ ১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দে শাহাবুদ্দীন মুহম্মদ ঘোরী পাঞ্জাবের সর্বশেষ গজনী শাসনকর্তা খসরু মালিকের কাছ থেকে পেশোয়ার অধিকার করেন। লাহোরে খসরু মালিক তাঁর অনুগত্য স্বীকার করেন। অত:পর শাহাবুদ্দীন ঘোরী শিয়ালকোটে চলে যান সেখানের দুর্গ পুন:নির্মাণ করেন এবং তথাকার একজন অফিসারকে সেনাপতি নিযুক্ত করে তিনি গজনীয় প্রত্যাবর্তন করেন। এই সুযোগে খসরু মালিক তাঁর হারানো সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সচেষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
শাহাবুদ্দীন ঘোরী ১১৮২ খ্রিষ্টাব্দে সিন্ধুর প্রসিদ্ধ বন্দরগাহ ডাবিল অধিকার করেন। একই সাথে তিনি উপক‚লবর্তী বহু এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। অত:পর তিনি পুনরায় পাঞ্জাবে আগমন করেন এবং লাহোর অধিকার করেন। খসরু মালিক কে গ্রেফতার করত: ফিরুজকুহে প্রেরণ করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল গজনী সাম্রাজের অন্তভূক্ত সারহিন্দ ও থানেশ্বর রাজপুতদের থেকে মুক্ত করা।
লাহোর বিজয়ের মধ্যে দিয়ে সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরী ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের যে সূচনা করে তার পরবর্তী বিজয় অভিযানগুলো এই ধারাকে আরও বিস্তুৃত করেছিল। তাই সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরীর লাহের বিজয় এই উপমহাদেশে ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায় রূপে গণ্য হয়ে থাকে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।