বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলাম প্রচারধর্মী জীবনবিধান। এজন্য যাদেরকে মুবাল্লেগ নিয়োগ হত তাদেরকে সর্বপ্রথম কোরআনুল কারীমের সূরাসমূহ মুখস্ত করানো হত, একই সাথে লেখাপড়াও শিক্ষা দেয়া হত। রাসূলুল্লাহ সা. রাত এবং দিনের ইরশাদসমূহ শ্রবণ করার সুযোগ এবং সৌভাগ্যও তারা লাভ করতেন। কিন্তু সব কিছুর মূলে কোরআন শিক্ষার বিষয়টিই দরসে তাবলীগের সর্বপ্রধান অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত ছিল।
এমনিভাবে কোরআনুল কারীমের বিভিন্ন জ্ঞান ও মহাত্ম্য সম্পর্কে মানুষ জানা ও বোঝার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করে। এই ঐশীগ্রন্থের মাঝে ইসলাম ধর্মের জীবন-জিজ্ঞাসার যাবতীয় উৎস স্থান লাভ করেছে। ইহাই সর্বশেষ কিতাবে ইলাহী। খোদ রাসূলুল্লাহ সা. এবং অন্যান্য মুবাল্লেগ সাহাবীগণও দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে শুধুমাত্র কোরআনুল কারীমের সূরাসমূহ পাঠ করে শোনাতেন এবং যেখানেই তারা তা তিলাওয়াত করার সুযোগ লাভ করতেন সেখানেই তার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে কাজ আঞ্জাম দিতেন।
এক্ষেত্রে দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব স্বয়ং কোরআনুল কারীমের মাধ্যমেই পরিসাধিত হত। এর তাবলীগের জন্য জিহাদের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু এই জিহাদের হাতিয়ার লৌহ নির্মিত তরবারী ছিল না, বরং তা ছিল কোরআনুল কারীমের নিজস্ব তরবারী যার আঘাত প্রতিহত করা ঢাল ও বর্মের সাহায্যে মোটেই সম্ভব ছিল না। আল্লাহপাক স্বীয় পয়গাম্বরদের এই তরবারী দ্বারই জিহাদের হুকুম প্রদান করেছিলেন।
ইরশাদ হচ্ছে, ‘সুতরাং হে রাসূল, কাফিরদের কথার অনুসরণ করবেন না এবং তাদের সাথে পূর্ণ বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করুন।’ (সূরা ফুরকান: রুকু ৫)। এই পয়গামে ইলাহীর পৃথিবীতে অবতরণের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তা আল্লাহর বিস্মৃত বান্দাদের তার অঙ্গীকার স্মরণ করিয়ে দেবে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘সুতরাং কোরআনের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে নসীহত করুন, যে আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করে।’ (সূরা কাফ: রুকু ৩)।
আল কোরআন রাসূলুল্লাহ সা.-এর আম বা সাধারণ পয়গাম এবং এটাই তার অবতীর্ণের উদ্দেশ্য ও পরিণতি। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে, ‘বরকতময় সেই আল্লাহ যিনি স্বীয় বান্দার ওপর ফুরকান নাজিল করেছেন, তা সারা বিশ্বের জন্য ভয় ও সচেতনতার পথ উন্মুক্ত করে।’ (সূরা ফুরকান: রুকু ১)।
এই কোরআন ইসলামের শক্তি এবং মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর আসল হাতিয়ার ছিল। যার আঘাত কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। তৎকালীন দুনিয়ার আরবে তিনটি গোত্র বা বংশ ছিল। যাদের ইসলাম গ্রহণ করা মূলত গোটা জাজিরাতুল আরবের ইসলামগ্রহণ করার সমতুল্য ছিল। অর্থাৎ মুশরিকীন, ইহুদী ও নাসারা। আরব মুশরিকীনদের মূল কেন্দ্র ছিল কা’বা শরীফ। তাদের ধর্মগুরু ছিল কুরাইশরা। ইহুদীদের রাজধানী ছিল মদীনা ও খায়বরে। নাসারা এবং অগ্নি পূজারীরা সিরিয়া এবং ইয়েমেনের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
এ কারণে যা সন্নিকটে তারই অগ্রাধিকার প্রথার ভিত্তিতে ইসলাম প্রচারের ঐশী তরতীব এই ছিল যে, প্রথমে কুরাইশ এবং কাফির সম্প্রদায়কে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হবে। তারপর ইহুদীদের শ্রেণীবদ্ধভাবে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসা হবে এবং তারপর নাসারা ও অগ্নি পূজারীদের আহ্বান জানানো হবে।
সুতরাং রাসূলুল্লাহ সা. এই তরতীবের সাথেই ইসলাম প্রচার করেছেন এবং এই নীতির কারণেই কোরআনুল কারীমের দাওয়াতের তরীকা বিভিন্ন বলে পরিদৃষ্ট হয়। মক্কায় যে সকল সূরা অবতীর্ণ হয়েছিল, সেগুলোর উপলক্ষ ছিল মক্কার কাফির সম্প্রদায়। এ কারণে তাদের মূর্তিপূজার অসারতা, তাওহীদের উৎসাহ, কুদরতের আশ্চর্যধর্মী বিকাশ, আল্লাহর শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন এবং বিরুদ্ধবাদী কুরাইশ সম্প্রদায়ের বিরোধীতার প্রত্যুত্তর ছাড়া এগুলোতে অন্য কিছুর অবতারণা করা হয়নি।
রাসূলুল্লাহ সা. যখন মক্কা হতে মদীনা গমন করলেন, তখন ইহুদীদের সাথে মোকাবেলা করতে হয়। তারপর কোরআনুল আরীমের উপলক্ষের পরিবর্তন হয়ে যায়। সুতরাং মদীনায় অবতীর্ণ প্রাথমিক সূরাগুলোতে বেশিরভাগ ইহুদীদের ধর্মীয় ঐতিহ্য, তাদের ধর্ম বিকৃত করা, তাদের নৈতিক দুর্বলতাসমূহ এবং বনী ইসরাঈলের কাহিনীসমূহ বিবৃত হয়েছে। সর্বশেষে আসে নাসারাদের পালা।
মক্কা বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন গোত্রগুলোর অস্তিত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে নাজরানের খ্রিষ্টানদের এক প্রতিনিধি দল আগমন করে। এই সময় সূরা আল ইমরান নাজিল হয়, যেখানে নাসারাদের কথা উল্লেখ আছে। আরবে অগ্নিপূজারীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। বাহরাইন এবং ইয়েমেনে বিক্ষিপ্তভাবে তাদের বসতি ছিল।
কিন্তু তারা ছিল ইরানী বংশোদ্ভুত এবং তারা খাঁটি আরব ছিল না। এ কারণে কোরআনুল কারীমের কোনো সূরায় নির্দিষ্টভাবে তাদের কথা উল্লেখ করা হয়নি, বরং বিভিন্নস্থানে প্রয়োজন অনুপাতে তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের বিশ্বাসের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। তাদেরকে দু’ উপাস্যের পরিবর্তে তাওহীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।