যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
মো: শামসুল আলম খান
বিদেশী গারো পাহাড়ের সবুজ উপত্যকা। দূর থেকে ঢেউ খেলানো অবারিত সৌন্দর্যের হাতছানি। গারো পাহাড়ের পাদদেশের নিভৃত একটি গ্রামের নাম কলসিন্দুর। গারো পাহাড় থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার উত্তরে নেতাই নদীর পাড়ের সমৃদ্ধ এক জনপদ কলসিন্দুর। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার এ গ্রাম নতুন প্রজন্মের নারী ফুটবলারদের প্রতিভাগুণে নতুন করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দলে খেলছেন এ গ্রামেরই ৮ জন ফুটবলার। প্রমিলা এ ফুটবলাররা গত বছর নেপালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ্ব-১৪ মহিলা ফুটবলের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জনের পর চলতি বছরই ধরে রেখেছে তাদের সাফল্যের ধারবাহিকতা। গারো পাহাড়ের কোলের কলসিন্দুর গ্রামের ৮ খুদে ফুটবল কন্যারা তাজিকিস্তান থেকে জয় করেছে একই শিরোপা।
মার্জিয়া, তহুরা, সাজেদা আক্তার, তাসলিমা আক্তার, শামসুন নাহার, মারিয়া মান্দা, মাহমুদা আক্তার ও নাজমা আক্তার। কৃতি এসব ফুটবলারদের বাড়ি দেশের নারী ফুটবলার তৈরির গ্রাম কলসিন্দুর। ভারতের সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দুর্গম প্রত্যন্ত পল্লীর এ মেয়ে ফুটবলাররাই দেশের ফুটবলে আশার আলো হয়ে উঠেছেন।
তাদের নজরকাড়া পারফরম্যান্সে বেজায় খুশি তাদের বাবা-মা। আনন্দে উদ্বেল স্থানীয় এলাকাবাসীও। নারী এসব ফুটবলাররা নিজেদের নিয়ে গেছেন অন্য রকম এক উচ্চতায়।
কলসিন্দুর গ্রামে নারী ফুটবলারদের উত্থান আশা-জাগানিয়া। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফুটবলে শুরু হয় তাদের পথচলা। এ গ্রামের নামেই প্রতিষ্ঠিত কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই সময়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রীদের নিয়ে ব্যতিক্রমী এক মিশন শুরু করেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মিনতি রাণী শীল।
এ শিক্ষিকার ব্যক্তিগত উৎসাহে আর সহকারী শিক্ষক মফিজ উদ্দিনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ফুটবলে পা ছুঁতে শুরু করেন কোমলমতি ওই ছাত্রীরা। সময়ের পরিক্রমায় তারা একেকজন হয়ে উঠেন দেশকাঁপানো ফুটবলার। পরবর্তীতে প্রতিভা আর ইচ্ছাশক্তির জোরে দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও তাদের কারো কারো সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। গত বছর নেপালের কাঠমুন্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ মধ্য এশিয়া অঞ্চলের এএফসি অনুর্ধ-১৪ চ্যাম্পিয়ানশীপে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) বাছাইকৃত দেশের ১৮ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে কলসিন্দুর গ্রামেরই ১০ জন স্থান পায়। চলতি বছর এ টুর্নামেন্টে খেলেছে এ গ্রামেরই ৮ জন। চারিদিকে হৈচৈ ফেলে দেয়া প্রমীলা এসব ফুটবলারদের নিয়ে গর্বের শেষ নেই স্থানীয় এলাকাবাসীর। কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কলসিন্দুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠ লগুয়া ফজলুল হকের দোকানে বসেই আলাপ হচ্ছিল স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দাদের সঙ্গে। নিজের এলাকার মেয়েদের এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত তারাও।
স্থানীয় কৃষক আব্দুর রশিদ হাসিমুখে বললেন, ‘আমগোর এলাকার মেয়েরা আমগর এলাকাডারে গোটা দেশেই চিনাইছে। ওরা যে এমন ভাল খেলবো তা আমরা চিন্তাও করতে পারি নাই। ওদের সাফল্যে আমরা আনন্দিত।’ কলসিন্দুর বাজার এলাকার ইউনুস আলী বলেন, ‘ওগোর লেই¹া সবাই আমগর গ্রামরে চিনে। আমি প্রতিদিন বিকেলে ওগোর অনুশীলন দেখি। ওরা আরো খুব ভালো করবো।’
নেপালের পর তাজিকিস্তান, দ্বিতীয়বার শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন, কেমন লাগছে জানতে চাইলে সাজেদা বলছিলেন এভাবে, ‘আমরা প্রতিটি ম্যাচেই খুব ভাল খেলছিলাম। তখনই ভেবেছিলাম চ্যাম্পিয়ন হবো। চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জিতে হেসেই আমরা মাঠ ছেড়েছি।’
একই রকম অনুভূতি জানতে চায় মারিয়া মান্দার কাছ থেকেও। গালভরা হাসিতে দ্যুতি ছড়িয়ে মারিয়া বললো, পরপর দু’বছর চ্যাম্পিয়ন আমরাই। খুবই ভাল লাগছে। আমাদের টার্গেট পূরণ হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো ভাল খেলতে হলে নিয়মিত প্র্যাকটিস চালিয়ে যাওয়া দরকার।’ ঠিক পাশ থেকেই মারিয়ার সঙ্গে যোগ করে নাজমা বলেন, ‘সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হলে আমরাই পারবো লাল-সবুজের পতাকা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে।’
তাজিকিস্তানে এবারের টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে ভারতকে ৩-১ গোলে হারানোর পর ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিল সেই ভারত। এবার আর গোল খাওয়া নয়। ৪-০ গোলে হারিয়ে দাপুটে এক জয় তুলে আবারো চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের এ মেয়েরা। তাজিকিস্তানের বিপক্ষে হ্যাট্রিকসহ টুর্নামেন্টে ৪ ম্যাচে ১০ গোল করে সেরার পুরস্কার পেয়েছেন স্থানীয়দের কাছে ‘মেসি’ খ্যাত এ দলের খেলোয়াড় তহুরা।
দেশের ফুটবলের এগিয়ে যাবার গল্পের প্রতীক এ খুদে মেয়ে ফুটবলাররাই। তাদের হাত ধরেই ফুটবল মানচিত্রে নতুন করে পরিচিতি পাচ্ছে বাংলাদেশ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে উচ্ছ্বসিত মেয়ে ফুটবলার মারিয়া মান্দা বলেন, আমরা চাই ঢাকায় মেয়েদের ফুটবল লীগ চালু হোক।
আমরা জাতীয় দলে খেলতে চাই। এজন্য দীর্ঘ মেয়াদী ভাল প্রশিক্ষণ দরকার। সব সময় ক্যাম্পে খেলতে পারলে, প্রশিক্ষণ নিতে পারলে ভবিষ্যতে আমরা আরো ভাল করতে পারবো।’
সাফল্যের কারিগর
বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৪ নারী ফুটবল দলের কিশোরী ফুটবলারদের এ পর্যায়ের উঠে আসার পেছনের কারিগরের নাম মিনতি রাণী শীল। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
কলসিন্দুরের মেয়েরা একদিন জাতীয় মহিলা ফুটবল টিমের হাল ধরবে মনে করেন খুদে ফুটবলার তৈরির মূল কারিগর এ শিক্ষিকা। তিনি বলেন, আমি মনে করি এ ১০ জনের মধ্যে কমপক্ষে ৭ জন ফুটবলার মেধা ও যোগ্যতা দিয়েই জাতীয় মহিলা ফুটবল টিমে জায়গা করে নিবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।