যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
ইমামুল হাবীব বাপ্পি
লেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব লীগ শিরোপা জিতবে কি-না এমন প্রশ্নে বাজির দর ছিল ৫০০০-১! অর্থাৎ আপনি যদি লেস্টারের পক্ষে ১ পাউন্ড বাজি ধরেন এবং আপনি জিতে যান, তাহলে ফেরত পাবেন ৫ হাজার পাউন্ড! অবনমনের সাথে লড়তে থাকা একটা দলের বাজির দর এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ফুটবল বোদ্ধাদের সকল হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে সেই লেস্টারই ইতিহাস গড়ে হয়েছে প্রিমিয়ার লীগ চ্যাম্পিয়ন। ফুটবলের ইতিহাসে যা ঠাঁই করে নিয়েছে বিষ্ময়কর এক অর্জন হিসেবে। ফুটবল বিশ্ব তাই এখন মাতোয়ারা লেস্টার জ্বরে। তবে শুধু লেস্টারই যে এমন রূপকথার জন্ম দিয়েছে তা নয়। হালের অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ সাধারণ মানের সব খেলোয়াড় নিয়ে যে চমক দেখাচ্ছে সেটাও কি কম বিষ্ময়ের। তবে এসব দলকে সম্ভবত পথ দেখিয়েছে নটিংহাম ফরেস্ট। তাদের প্রত্যবর্তনের গল্পটা আরো রোমাঞ্চকর।
১৯৭৫ সাল। ১৩ নম্বরে থেকে ধুঁকছে একটা ক্লাব, তাও আবার ইংলিশ লিগের দ্বিতীয় বিভাগে। অখ্যত সেই দলের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় কোচ হিসেবে আসলেন সাবেক ইংলিশ ফুটবলার ব্রায়ান ক্লফ। শুরু হয় নটিংহাম ফরেস্ট নামের দলটির নতুনভাবে পথচলা। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পরের মৌসুমেই জায়গা করে নিলেন প্রথম বিভাগে। পরের মৌসুমে অর্থাৎ ১৯৭৭-৭৮ মৌসুমে রুপকথার জন্ম দিয়ে জেতেন প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। তাও আবার দ্বিতীয় স্থানে থাকা লিভারপুলের চেয়ে পরিষ্কার ৭ পয়েন্টে এগিয়ে থেকে। যদি ভাবেন নটিংহাম রুপকথার এখানেই পরিসমাপ্তি তাহলে ভুল করবেন। এই শিরোপা তো ছিল পরের মৌসুমে ইউরোপিয়ান ফুটবলে জায়গা নিশ্চিত করার উপলক্ষ। ফুটবল বিশ্বকে চমকে দিয়ে সেবার ইউরোপ সেরা খেতাব জিতেছিল নটিংহাম ফরেস্ট।
এই ক্লফ কিন্তু তাঁর জাদু দেখিয়েছিলেন এর আগেই। ৮৮ বছরের মধ্যে প্রথম ডার্বি কাউন্টিকে দিয়েছিলেন শিরোপার স্বাদ। তবে নটিংহামকে নিয়ে যেটা করেছেন, সেটা ছাড়িয়ে গেছে সবকিছুকেই। ১৯৭৯ সালে প্রথমবার ইউরোপিয়ান কাপের (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগের) ফাইনালে গিয়েই জিতেছিলেন শিরোপা। সেবার মালমোকে হারিয়েছিল নটিংহাম। পরের বছর আবারও সবাইকে স্তম্ভিত করে নটিংহাম চলে যায় ফাইনালে, এবার হামবুর্গকে হারিয়ে আবার শিরোপা জয়। এমন রুপকথার জন্ম দেওয়া দলটি এখন খেলে ইংলিশ লিগের দ্বিতীয় বিভাগে।
শুধু ইংল্যান্ড কেন, আরও কতবার ফুটবলে এমন বিষ্ময় লেখা হয়েছে। ইতালিয়ান সেরি আ’তে তেমনি এক বিষ্ময় উপহার দিয়েছিল হেলাস ভেরোনা। চলতি মৌসুমে আবারো দ্বিতীয় বিভাগে অবনমন নিশ্চিত হয়েছে তাদের। কথা হচ্ছে আশির দশকের। সেরি আ’র তখন রমরমা অবস্থা। জুভেন্টাস, এসি মিলান, ইন্টার মিলান, নাপোলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন ফুটবলের সব তারকারা। ১৯৮৪ সালে পয়েন্ট তালিকার ৬ নম্বরে উঠে এসে লীগ শেষ করেই সবাইকে চমকে দিয়েছিল ভেরোনা। পরেরবার তো ইতিহাসই গড়ে ফেলল তারা, নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবার জিতল লিগ শিরোপা। এখন পর্যন্ত সেটিই ভেরোনার একমাত্র সিরি আ জয়।
ফ্রান্সে এমন চমকের গল্পটা অবশ্য খুব বেশি দিন আগের নয়। বছর ছয় আগে যখন দ্বিতীয় বিভাগ থেকে মঁপেলিয়ে ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ানে উঠল, অবনমন এড়িয়ে লিগে টিকে থাকাই তখন ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। ২০১১-১২ মৌসুমে সবাইকে অবাক করে সেই মঁপেলিয়ে জিতল শিরোপা। এর আগের মৌসুম ঠিক লেস্টারের মত ১৪ নম্বওে থেকে কোনমতে অবনমন এড়িয়েছিল তারা। পিএসজি তখন মাত্রই কাঁড়ি কাঁড়ি পেট্রোডলার ঢালতে শুরু করেছে। আর মোনাকো, লিও, মার্শেই, লিলের মতো প্রতিষ্ঠিতরা তো ছিলই। কিন্তু মঁপেলিয়ে রেকর্ড ৮২ পয়েন্ট নিয়ে প্রথমবারের মতো জিতেছিল লিগ ওয়ান শিরোপা। দলের মালিক লুইস নিকোলিন কথা দিয়েছিলেন, দল জিতলে নিজের চুলের রংটা ক্লাবের কমলা-নীলে রাঙাবেন। কথা রেখেছিলেন রসিক ভদ্রলোক।
স্পেনে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের কীর্তির স্মৃতি এখনো টাটকাই থাকার কথা। তবে এটাকে অবশ্য ঠিক রূপকথা বলার উপায় নেই। লা লিগার শিরোপা-দৌড়ে না থাক, অ্যাটলেটিকো শুরুর দিকেই থাকত। কিন্তু বার্সা-রিয়ালের দুই ঘোড়ার দৌড়ে আরেকটি ঘোড়া এসে হুট করে বাজিমাত করে দেবে, সেটা আসলে কেউই ভাবেনি। ডিয়েগো সিমিওনের দল মৌসুম শেষের নাটকীয়তায় সেই কীর্তিই করে ফেলল। ২০০৪ সালে ভ্যালেন্সিয়ার পর ২০১৪ সালে রিয়াল-বার্সার বাইরে কেউ লিগ জিতল। উঠে গেল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। কিন্তু ফাইনালে নগর প্রতিদ্বন্দ্বির কাছে হেরে পরিসমাপ্তিটা রুপকথার মত হল না। তবে দুইবারের ইউরোপা লিগ শিরোপা জয়ের পর এবারো ফাইনালে পা রেখে বিষ্ময়ের জন্ম দেওয়ার অপেক্ষায় আছে তারা।
ডাচ ক্লাব এজেড আলকমারের কীর্তিটাও খুব বেশি বেশি দিনের পুরোনো নয়। ১৯৮১ সালে সর্বশেষ লিগ জিতেছিল ডাচ ক্লাবটি। এরপর থেকেই ডাচ লিগের শিরোপা ভাগাভাগি করে নিয়েছে আয়াক্স, পিএসভি আইন্দহোফেন ও ফেইনুর্ড। ২০০৮ সালে ১১তম হয়ে লিগ শেষ করেছিল আলকমার। পরের মৌসুমে তাদের স্বাভাবিকভাবেই গোনায় ধরেনি কেউ। লুই ফন গাল তখন ছিলেন ক্লাবের কোচ, কিন্তু তিনি তো আর একা কিছু করতে পারবেন না। ২০০৯ সালে সবাইকে চমকে লিগ জিতল ফন গালের আলকমার।
তবে স্টুয়া বুখারেস্টের কীর্তিটা বিষ্ময়কে ছাপিয়ে রূপকথাই ঠাই করে নিতে বাধ্য। একবার ভাবুন তো, রোমানিয়ার কোনো ক্লাব এসে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য বললেও আসলে কম বলা হবে। রোমানিয়া থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগেই তো নিয়মিত খেলার সুযোগ হয় না কারও। অথচ সেই ১৯৮৬ সালে রোমানিয়ারই স্টুয়া বুখারেস্ট তখনকার ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিল। ফাইনালে বার্সেলোনাকে হারিয়ে লিখেছিল রোমানিয়ান রূপকথা।
এ তো গেল ক্লাব ফুটবলের গল্প। জাতীয় দলগুলোতেও আছে এমন সব বিস্ময় মাখা গল্প। সবার আগে দুটি ইউরোর কথাই মনে আসবে ১৯৯২ ও ২০০৪! ইউরো ১৯৯২। এক মাস আগেও যুগোস্লাভিয়াতে চলছে গৃহযুদ্ধ। বাছাইপর্বে সফল হওয়া এই দলটির ইউরোতে অংশ নেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না, তাই ডেকে নেওয়া হলো বাছাইপর্বে যুগোস্লাভিয়ার গ্রুপে দ্বিতীয় হওয়া ডেনমার্ককে। মাত্র এক মাসের প্রস্তুতি, তাতেই কিস্তিমাত! দেশটির ফুটবল ইতিহাসের এখনো একমাত্র বড় শিরোপা এটিই। এ তো রূপকথাকেও হার মানায়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও সুইডেনের মত গ্রুপ থেকে নকআউট পর্বে যাওয়া, এরপর শিরোপা জেতার পথে আগের বারের ইউরো চ্যাম্পিয়ন হল্যান্ড ও ফাইনালে তখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে হারানোর যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে তবেই শিরোপা জিতেছিল ডেনিশরা। টুর্নামেন্টের পর ডেনমার্কের নায়ক কিম ভিলফোর্টের কথাটাই হয়তো ফুটবলের চিরকালীন মন্ত্র, ‘আমাদের দল হয়তো সেরা খেলোয়াড় দিয়ে ভর্তি ছিল না, তবে দলটাকে আমরা সেরা বানিয়ে নিয়েছিলাম।’
ভিলফোর্টের মন্ত্রতে দিক্ষিত হয়েই সম্ভবত ২০০৪ সালের ইউরো জিতেছিল গ্রিস। যদিও অতিরক্ষণাত্মক খেলার কারণে বেশ সমালোচনাও হয় দলটির। তাতে কী? নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ীই তো কৌশল সাজাবেন তারা। কোচ ছিলেন ওটো রেহাগেল। বড় টুর্নামেন্ট জয় তো পরের কথা এর আগে কোনো ম্যাচই জিততে পারেনি তারা। তারাই কিনা ফ্রান্স, চেক প্রজাতন্ত্র ও পর্তুগালকে (২ বার) হারিয়ে দিল! ফাইনালের ৫৮ মিনিটে অ্যাঞ্জেলস চ্যারিস্টিয়াস যখন বল পর্তুগালের জালে ঠেলে দিলেন, তখন হয়তো লেখা হয়ে গিয়েছিল শুধু প্রতিভা বিচ্ছুরিত সৌন্দর্যই নয়, ফুটবল মাঝেমধ্যে শ্রমসাধ্য চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞারও ফল।
ফুটবলের মত এমন রোমাঞ্চকর বিষ্ময়গাঁথা ঘটনা আছে ক্রিঢ়া জগতের অন্য খেলাতেও। এমন অনেক কিছুই ঘটেছে, যা আগে কেউ কখোনো ভাবতেই পারেনি। আবার এমন অনেক কিছুই হয়তো সামনে ঘটবে, যা এখন কেউ কল্পনাও করবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।