Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মকথা

প্র ধা ন র চ না

মো হা ম্ম দ আ ব দু ল গ ফু র | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৫ এএম

১৯৪৭ সালে তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় সর্বসম্মত দাবি এবং হিন্দু নেতৃবৃন্দের সম্মতির ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। এই লাহোর প্রস্তাব ছিল হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত এ উপমহাদেশের শত শত বৎসরের বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধির ফসল। লাহোর প্রস্তাবের দুটি দিক ছিল : এক, উপমহাদেশকে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চলের ভিত্তিতে বিভক্ত করা, দুই. উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মুসলিম এলাকাসমূহের সমন্বয়ে একাধিক পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন। লাহোর প্রস্তাবের কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দ ছিল না। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যে অধিবেশনে ওই প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে হিন্দু সংবাদপত্রগুলোই প্রথম এটাকে ‘পাকিস্তান’ প্রস্তাব বলে উল্লেখ করে এবং মুসলিম লীগও পরবর্তীকালে এ নামকরণ মেনে নেয়। ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ লেজিসলেটার্স কনভেনশনে লাহোর প্রস্তাব আংশিক সংশোধনের মারফৎ উপমহাদেশের দুই প্রান্তের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহের সমবায়ে একাধিক রাষ্ট্রের স্থানে একটি মাত্র পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গৃহীত হয়। সেদিন উপমহাদেশের মুসলমানদের দাবি-দাওয়ার বিরুদ্ধে হিন্দু-ব্রিটিশ অশুভ আঁতাতের মোকাবেলায় বৃহত্তর মুসলিম সংহতির প্রয়োজনে এই সংশোধনের প্রয়োজন অনুভ‚ত হয়েছিল, এরূপ ধারণা করার যথেষ্ট সঙ্গত কারণ আছে।

লাহোর প্রস্তাবে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চলের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত করার কথা বলা হলেও এ প্রস্তাবের কোথায়ও সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র ছিল না। এ প্রস্তাব বরং ছিল সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার একটি বাস্তব প্রচেষ্টা মাত্র। লাহোর প্রস্তাবের যাঁরা প্রবক্তা, শেরেবাংলা, কায়েদে আজম প্রমুখ, তাঁরা সবাই জীবনভর হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস পান। কিন্তু তাঁদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বাস্তব ও তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলেই মুসলিম নেতৃবৃন্দ শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে দেশ বিভাগ দাবি করতে বাধ্য হন। এই দাবি হিন্দু নেতৃবৃন্দ মুখে স্বীকার করলেও পরবর্র্তীকালে অবশ্য প্রমাণিত হয়- তাঁরা কখনো এ দাবি অন্তর থেকে স্বীকার করেনি।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত এই চব্বিশ বৎসর নানা কারণেই জাতির ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিম শাসনের অবসানের পর উনিশশো সাতচল্লিশ পর্যন্ত ছিল দেশি-বিদেশি অমুসলিম শক্তির মোকাবেলায় স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার সংগ্রাম, শেষ পর্যায়ে এ সংগ্রাম মুসলিম নবজাগরণের আন্দোলনে উন্নীত হয়েছিল। এক হিসাবে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত ছিল যেন এই রেনেসাঁ থেকে পশ্চাদপসরণের পালা। একটা দুভাগ্যজনক ভুল বোঝাবুঝি, আত্ম-বিস্মৃতি, অবিবেচনা ও বিদ্বেষ হলাহলের পরিণতিতে একটি রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের মাধ্যমে উন্নয়নশীল মুসলিম রাষ্ট্রের দ্বিধাবিভক্তি। চিত্রের এ হচ্ছে একটি দিক। চিত্রের আরেক দিকে এ হচ্ছে- বৈষম্য, অবিচার, অত্যাচারের অবসানে স্বাধীনতার এক নব উদ্বোধন-পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নবতর স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের সংযোজন। উপমহাদেশের পরিস্থিতির বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বিরাট ঝুঁকি নিয়ে হলেও একটি স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠীর নবতর পদচারণা। শতাব্দীর ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় দোদুল্যমান মনে হলেও দুঃসাহসিকতার অভিধায় উচ্চকিত এক নব অভিযাত্রা।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলার ভ‚মিকা ছিল যে কোনো বিচারে গৌরবদীপ্ত। বাংলাদেশ শুধু পাকিস্তান আন্দোলনকারী রাজনৈকিত প্রতিষ্ঠান নিখিল ভারত মুসলিম লীগেই জন্ম দেয়নি, পাকিস্তান প্রস্তাবের উত্থাপকও ছিলেন বাংলার কৃতী সন্তান শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। ব্রিটিশ-ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলায় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন বাংলার মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভাই সেই চরম দিনগুলোতে পাকিস্তান আন্দোলন কায়েদে আজমের হাতকে সর্বাধিক শক্তিশালী করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন দেখা গেল এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বাংলার স্থান হয়ে গেল অত্যন্ত সঙ্কুচিত। প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ব্যবসায়-বাণিজ্য সর্বত্রই তাদের এই দুর্বল অবস্থান বাঙালিদের কারো কারো মনে যদি অভিমান সৃষ্টি করে থাকে, তবে তাকে অস্বাভাবিক বা অসঙ্গত বলা যাবে না।
পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলার বিশিষ্ট ভূমিকার একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম স্বাধীনতা সূর্য অস্ত যায়- পরাধীনতার অভিশাপ বাংলাকেই সবচাইতে অধিক সহ্য করতে হয়। আর যেহেতু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার পূর্বে এ দেশের শাসনকর্তা (নবাব) ছিলেন মুসলমান, তাই ইংরেজ রাজত্বে বাংলার মুসলমানদেরই সর্বাধিক বৈষম্য-বঞ্চনা ও শোষণ-নিপীড়নের শিকার হতে হয়। ইংরেজদের এসব শোষণ-নিপীড়নে সহযোগী শক্তি হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা দেয় এক শ্রেণীর হিন্দু। তাই ব্রিটিশ-হিন্দু যৌথ শোষণ-নিপীড়নের যন্ত্রণা বাংলার মুসলমান যতটা সহ্য করেছে, ততটা অন্যেরা করেনি। বাংলাদেশে পাকিস্তান আন্দোলন বিশেষ জনপ্রিয় হওয়ার এটা ছিল বড় কারণ। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার এই প্রেক্ষাপটেই পাকিস্তান থেকে বাংলার মুসলমানদের পাওয়ার আশা ছিল বিরাট। কিন্তু তুলনামূলকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে তারা পেয়েছে যথেষ্ট কম।
এই কম পাওয়ার অবশ্য অন্য কারণও ছিল। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা প্রদেশ) হিসেবে যে অঞ্চল চিহ্নিত হয়, তা ইংরেজদের চক্রান্তে বিভাগপূর্বে আমলে ছিল একটি চরমভাবে অবহেলিত অনুন্নত অঞ্চল। মুসলিম শাসনামলে যে বাংলায় ছিল গোয়াল ভরা গরু, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, মাঠ ভরা সবুজের সমারোহ, যে বাংলার মসলিন সমেত গোটা বস্ত্রশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রয় হতো- সেই বাংলার বস্ত্রশিল্প একেবারে ধ্বংস করে দেয়া হলো। দুনিয়ার সেরা পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পূর্ববঙ্গ বিখ্যাত হওয়া সত্তে¡ও পাটকল সব পরিকল্পিতভাবে স্থাপন করা হলো ভাগিরথী নদীর পশ্চিম তীরে। পূর্ববঙ্গকে পরিণত করা হলো কলিকাতাসহ হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিম বঙ্গের হিন্টারল্যান্ড।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় দেখা গেল, নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনসংখ্যার মেজরিটি অংশ পূর্ববঙ্গের হলেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থান অনেক পেছনে। ব্রিটিশ শাসনকালেই পাঞ্জাবে গড়ে উঠেছিল একটি অতি উন্নত সেচ ব্যবস্থা, যার ফলে সুফল পড়েছিল সেখানকার কৃষির ওপরে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৩টি বস্ত্রকলের এবং ১১টি চিনিকলের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই ছিল দেশের পশ্চিমাঞ্চলে। এ ছাড়া সরকারি প্রশাসনযন্ত্রে অবাঙালি মুসলমানদের অবস্থা বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা থেকে পূর্ব থেকেই উন্নত ছিল। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় প্রশাসনে প্রথম দিকে তাদের প্রভাব ছিল প্রবল। সেনাবাহিনীতেও একই অবস্থা। উপমহাদেশের বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশ থেকে মোহাজের হিসেবে আগত-মুসলমানদের অনেকেই শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কারিগরি ক্ষেত্রে অগ্রসর থাকলে এসব ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব গোড়া থেকেই অধিক অনুভূত হলো। পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে এই বৈষম্য নিয়েই পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হয়। এ সবের ফলে উভয় অঞ্চলের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি গোড়া থেকেই সৃষ্টি হওয়ার ছিল প্রায় অবশ্যম্ভাবী।
পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের মাতৃভাষার পার্থক্য পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের পার্থক্যকে বাড়িয়ে তুলতে সর্বাধিক সাহায্য করে- সেটা হলো উভয় অঞ্চলের মধ্যেকার বিরাট ভৌগোলিক ব্যবধান। প্রায় পনের শত বাইশ মাইল শত্রুভাবাপন্ন দেশের দ্বারা বিছিন্ন দুটি পৃথক ভূখন্ডের সমবায়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের নজির ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাসে ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। একাজ এমনিতেই ছিল দুরূহ এবং প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। ভূখন্ড, ভাষা, আবহাওয়া প্রভৃতি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পার্থক্য সত্তে¡ও দু’অঞ্চলের মধ্যে যে বস্তুটি বন্ধন অটুট রাখতে পারত, তা হলো ইসলাম। অর্থাৎ, ইসলামের বাস্তব অনুসরণ। দুঃখের বিষয় পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ইসলামের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারে যতটা উৎসাহী ছিলেন, ইসলামের সাম্যভ্রাতৃত্ব ও সুবিচারের নীতি প্রতিষ্ঠায় ততটা উৎসাহ কখনো বোধ করেননি। অথচ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পাকিস্তানে ইসলামের ন্যায়নীতি কায়েম করা হবে বলে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুটি দেয়া হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা এমনিতেই যথেষ্ট সুকঠিন কাজ। তদুপরি পাকিস্তানের মতো দুটি বিচ্ছিন্ন ভূখন্ড ভিত্তিক রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার জন্যও প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান ও ত্যাগী নেতৃত্বের, পাকিস্তানে যার অভাব ছিল অত্যন্ত বেশি। পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পৃথক ভূখন্ড নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন সে সম্পর্কে সস্তা গলাবাজি যত করেছেন, উপমহাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ ঐতিহাসিক পদক্ষেপ টিকিয়ে রাখার জন্য একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তার তুলনায় যথেষ্ট কম। একাত্তর-পূর্ববর্তী (অবিভক্ত) পাকিস্তানের মতো চ্যালেঞ্জিং রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখা তো দূরের কথা, একটি সাধারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পচিালনার যোগ্যতার প্রমাণও তাঁরা দিতে পারেননি- এ এক ঐতিহাসিক সত্য। ফলে কায়েদে আজমের মতো বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের তিরোধানের পর থেকেই পাকিস্তানে যে নেতৃত্ব সঙ্কট শুরু হয়, তা থেকে জাতি কখনো মুক্ত হতে পারেনি।
এগুলো ছিল যেখানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সেখানে পাকিস্তানের বৈদেশিক সমস্যা ছিল গোড়া থেকেই কঠিনতর এবং এক হিসাবে জটিলতর। অবতীর্ণ ধর্মাদর্শের যে সর্বশেষ ও আধুনিকতম রূপ ইসলাম নামে পরিচিত, তা আধুনিকতম হওয়ার সুবাদে পূর্ববর্তী ধর্ম সম্প্রদায়সমূহের কোপ দৃষ্টিতে পতিত হয়েছে স্বাভাবিক কারণেই। ইসলামের প্রসার ঘটেছে ঐসব ধর্মাদর্শের ব্যর্থতার পটভ‚মিতে। তাই তাদের ইসলামবিরোধী ক্ষোভ, বিদ্বেষ ও মর্মবেদনার যৌথ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ইতিহাসের বহু ঘটনাতেই। যেহেতু পাকিস্তান রাষ্ট্র ছিল আধুনিক বিশ্বের অন্যতম মুসলিম নবজাগরণ আন্দোলনের ফলশ্রুতি, তাই ক্রুসেডের উত্তরসূরী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্তরসূরী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক অলিখিত আঁতাতে আবদ্ধ হয় গোড়া থেকেই। উনিশশো সাতচল্লিশের নেহেরু-মাউন্টব্যানের মাখামাখি আদপেই ছিল দুটি কায়েমি স্বার্থের আঁতাত, শুধু দুজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব মাত্র নয়। এ আঁতাতের প্রথম ফলশ্রুতিতে কায়েদে আজমের আশীর্বাদপুষ্ট বসু-সোহরাওয়ার্দীর সার্বভৌম বাংলার পরিকল্পনাকে গান্ধীর এই অন্যায় প্রস্তাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে শরৎচন্দ্র বসু এক পত্রে তাঁকে লেখেন : ‘যে কংগ্রেস একদা মহান জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল, তা দ্রুত একটি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠানের পরিণত হতে চলেছে দেখে আমি মর্মাহত’ (In Retrospection, Abul Hashim. P. 161)।
১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা যে বিট্রিশ সমর্থনও লাভ করেছিল, সে খবর হয়তো অনেকেই রাখেন না। এ বিষয়ে কমরুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ঔ, ‘Jinnah, however, soon found out that the idea of partitioning Panjab and Bengla was engineered by Lord Mountbatten and it was futile to convince the leaders of Congress or sikhs regarding the danger of partitioning the provinces. Mountbatten later on admitted his part in his address to Royal Empire Soitry in London on 6th October 1948’ (Vide- A Socity-Political Hisory of Bengla and the Birth of Bangladesh’- Kamruddin Ahmad, 4th edition, 1975. P. 83).
এই বিষয়ে পন্ডিত নেহেরুর ভূমিকা ছিল আরো তাৎপর্যপূর্ণ। তদানীন্তন কংগ্রেস নেতা কুমিল্লার আশরাফদ্দিন চৌধুরীর এক পত্রের জবাবে ১৯৪৭ সালের মে মাসে নেহেরু তাঁকে যে চিঠি লেখেন, তাতে তিনি বলেন : ‘অখন্ড ভারতের নীতিকে আমরা জলাঞ্জলি দিয়েছে, এ কথা সত্য নয়। তবে আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। ভারত বিভাগ মেনে নেবো আমরা একটি শর্তে যে, বাংলা ও পাঞ্জাবকে বিভক্ত করতে হবে। কারণ একমাত্র এ পথেই অখন্ড ভারত পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে।’ (‘রাজবিরোধী আশরাফউদ্দিন আহমদ চৌধুরী’ -জামালুদ্দিন আহমদ চৌধুরী)।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি ব্রিটিশ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের এই দৃষ্টিভঙ্গির ভয়াবহ প্রতিফলন ঘটেছিল কুখ্যাত র‌্যাডক্লিফ রোয়েদাদে, যার মাধ্যমে বেশ কতকগুলো মুসলিম সংখ্যগুরু জেলা অন্যায়ভাবে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়। মোটের উপর পাকিস্তান যাতে আঁতুড় ঘরেই ধ্বংস হয়ে যায় তার জন্য ব্রিটিশ ও কংগ্রেস কারোরই চেষ্টার কোনো ক্রটি ছিল না। এই যেখানে বাস্তব আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, সেখানে পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের যে প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি ও সাবধানতার পরিচয় দানের প্রয়োজন ছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে তা তাঁরা দিতে পারেননি এবং তাঁরা এ ব্যর্থতার পরিচয় দেন বলতে গেলে গোড়া থেকেই।
সর্বপ্রথম যে ক্ষেত্রে পাকিস্তানি শাসকবর্গের এই ব্যর্থতার প্রমাণ প্রকটভাবে ধরা পড়ে, তা হলো রাষ্ট্রভাষা। যে কোনো জনগোষ্ঠীর উন্নতি ও বিকাশের জন্য মাতৃভাষাই যে শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম, এ স্বাভাবিক সত্যের স্বীকৃতি রয়েছে পবিত্র কুরআনও। পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলার দাবিকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানি শাসকবর্গ চাইলেন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে। উর্দু ভাষায় বিকাশে মুলসমানদের অবদান ঐতিহাসিক এবং ইসলামী উপাদানেও উর্দু ভাষা যথেষ্ট সমৃদ্ধ। সেই সুবাদে বাংলার বহু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বই ছিলেন উর্দুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই শ্রদ্ধাশীলতার সুযোগ নিয়ে মুদ্রা, মানিঅর্ডার, ফর্ম, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় দলিলপত্রে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দু ব্যবহারের প্রচেষ্টা হলো। পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিসে কমিশনের ইংরেজ সচিব মি. গুডইন স্বাক্ষরিত একটি সার্কুলার সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরিত হয়। তাতে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষার যে বিষয়সূচি ছিল, তার মধ্যে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, উর্দু, হিন্দি, এমন কি সংস্কৃত ও ল্যাটিনের মতো মৃত ভাষাও অন্তর্ভুক্ত ছিল- কিন্তু ছিল না পাকিস্তানের মেজরিটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা। বাংলার প্রতি এ ধরনের অবহেলার প্রতিবাদে সাতচল্লিশের সেপ্টেম্বরেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ক্রমেই এ আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। প্রথম প্রথম কর্তৃপক্ষ এ আন্দোলনকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের কারসাজি বলে বুঝতে চেষ্টা করেন, কিন্তু আন্দোলন জোরদার হলে তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ছিল বাংলাকে উর্দুর সঙ্গে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদি ও শিক্ষার মাধ্যম করতে হবে বাংলা ভাষা। ১৯৪৮ সালের মার্চ পাকিস্তানের অফিসাদি ও শিক্ষার মাধ্যম এসে একটি জনসভায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কনভোকেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উপরে বক্তৃতা দেন। পরবর্তীতে তিনি ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকেও তাদের দাবির বিরোধিতা করেন। নেতৃবৃন্দ কিন্তু তাঁদের বক্তব্যে অটল থাকেন। ঢাকা ত্যাগের পর থেকে ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বরে তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কায়েদে আজম আর কোনো কথা বলেছেন বলে জানা যায়নি। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের লিখিত ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ গ্রন্থ পাঠে জানা যায়- কায়েদে আজম পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে তাঁর ভুল বোঝতে পেরেছিলেন। তবে কায়েদে আজম তাঁর ভুল বুঝতেও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রধান মন্ত্রিত্বের আমলে পুনরায় বাংলা ভাষায় বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এ সময় বুকের তাজা রক্ত ঢেলে বাংলার তরুণ ছেলেরা ১৯৫২ সালে ভাষায় দাবি প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রসর হয়।
ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বসূরী বলে অভিহিত করা হয়। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই পরবর্তীকালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, যা ১৯৭০ সালে স্বাধিকার আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং আরো পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের কালো রাতে টিক্কা শাহীর বর্বর হামলার পরিণতিতে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে।
ভাষা আন্দোলনের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, এর মাধ্যমেই লাহোর প্রস্তাবের কঠোর বাস্তবতা সকলের সামনে নতুন করে ধরা পড়ে। ১৯৪৭ সালের তদানীন্তন অবস্থান প্রয়োজনে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূবাঞ্চল মিলে এক পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন থাকলেও লাহোর প্রস্তাবের মর্মকথা যদি স্মরণ রাখা হতো, তা হলে পরবর্তীকালের অনেক দুর্ঘটনা, অনেক রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হতো। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে যেমন এই বাস্তবতার কথা প্রথম প্রথম বিবেচনায়ই আনা হয়নি, তেমনি হয়নি আরো অনেক প্রশ্নে।
শাসনতন্ত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টাও ছিল এমনি এক প্রশ্ন। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫০ সালে গণপরিষদে যে শাসনতান্ত্রিক মূলনীতির খসড়া পেশ করেন, তাতে পূর্ব পাকিস্তানকে সিন্ধু, সীমান্ত প্রভৃতির ন্যায় মাত্র একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচনার চেষ্টা করা হয়, যা ছিল লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণীর সম্পূর্ণ বিরোধী। এর প্রতিবাদে ঢাকায় একটি গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানকে একটি অঞ্চল হিসেবে গণ্য করে ফেডারেল শাসনতান্ত্রিক মূলনীতির বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা দাবির ভিত্তিতে যে ঐতিহাসিক ব্যালটযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং তাতেও লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়। নির্বাচন যুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়, কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কল্যাণে গণতন্ত্রের ধারা প্রতিহত হয়। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রথমে সিভিল ব্যুরোক্র্যাসি, পরে মিলিটারি ব্যুরোক্র্যাসির প্রভাব প্রকট হতে থাকে। এই সুবাসে প্রথমে গোলাম মোহাম্মদ, পরে ইস্কান্দার মীর্জা এবং সর্বশেষ প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইউব খান দেশের সর্বময় ক্ষমতা কব্জা করেন। পাকিস্তান আমলে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা সূচিত হয় প্রথম দশকে। দ্বিতীয় দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ চরমভাবে ক্ষু্ন্ন হয়। এমনিতে কেন্দ্রীয় রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকার ফলে উন্নয়নের সুযোগ-সুবিধা প্রধানত পশ্চিমাঞ্চলের জন্য উন্মুক্ত হয়, তদুপরি পশ্চিমা-অধ্যুষিত সেনাবাহিনী ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে তারা বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশে মেজরিটির সুবাদে কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও সরকারে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের প্রভাব প্রবলতর হওয়ার কথা, অথচ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে উভয় অঞ্চলের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বদলে প্যারিটির নীতি গৃহীত হয়। আরো পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে পশ্চিমা প্রভাবিত সশস্ত্রবাহিনীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলে অবস্থা আরো নাজুক হতে থাকে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ হতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অন্তর্ধানের ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এডভেনচারিস্টদের উপদ্রব বেড়ে যায় বহুগুণে। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা কখনো পূরণ হয়নি। ফলে আইউব খান কর্তৃক প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়া এবং ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কৃতিত্ব প্রদর্শনের পর মাত্র দু’বছরের মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়ে যায়। একই প্রশ্নে ইতোমধ্যে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে একইভাবে প্রবল গণ-আন্দোলন সৃষ্টি হওয়ায় এবং পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে একই সঙ্গে সমগ্র পাকিস্তানের বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান পাকিস্তানের তেইশ বৎসরের ইতিহাসে সেই ছিল প্রথম। সে হিসাবে সাধারণ বিচারে এর ফলাফল অবিভক্ত পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য ভালো হওয়ারই কথা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা হয়নি। কারণ এই আন্দোলন ও আন্দোলন-পরবর্তী নির্বাচন দেশের দুই অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র ও আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী নেতৃত্বের জন্ম দেয়- যার একটি পূবাঞ্চল, আরকটি পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিনিধিরূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে।
এই দুই নেতৃত্বের মধ্যমণি মরহুম শেখ মুুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো সম্পর্কে শেষ কথা বলার মূহূর্তে হয়তো এখনো আসেনি। কারণ তাঁদের সম্পর্কে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্যের অভাবই এ ব্যাপারে বড় বাধা। শেখ সাহেব নিজে পাকিস্তান আন্দোলনে বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ করেছিলেন, এ এক ঐতিহাসিক সত্য। তিনি পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান দাবি-দাওয়া নিয়ে আগাগোড়া লড়েছেন, তবে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত কখনো পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়তে চান, এ সব কথা প্রাকাশ্যে বলেননি। বরং ছয় দফা আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি জোর দিয়ে বলতেন, ছয় দফা পাকিস্তানকে জোরদার করার লক্ষ্যে প্রণীত। এমন কি সত্তরের নির্বাচন জয়লাভের পরও একাধিক সমাবেশে তিনি তাঁর বক্তৃতা সমাপ্ত করেছেন ‘জয় বাংলা’ ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। অথচ সেই শেখ সাহেবই বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি ঢাকা প্রত্যাবর্তন করে ঘোষণা করলেন যে, তিনি সাতচল্লিশ সাল থেকেই এ দিনটির স্বপ্ন দেখছিলেন। আবার আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা চলাকালীন সময়ে বলা হতো, তিনি কখনো গোপনে ভারতে যাননি এবং এ মামলা ছিল একটা মিথ্যা সাজানো মামলা। অথচ পরবর্তীকালে প্রকাশ্যে বলা হয়েছে, তিনি গোপনে ভারতে গিয়েছিলেন। এখানে কাউকে বড় বা ছোট করার প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন প্রকৃত সত্য কোনটি তা উদ্ধার করা। কারণ একই সাথে পরস্পরবিরোধী দুটি কথা সত্য হতে পারে না। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পূর্ববর্তী দিনগুলোতে মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কী কী বিষয় আলোচিত হয়, তাও এ প্রসঙ্গে প্রমাণ্যভাবে জানা দরকার। দুর্ভাগ্যক্রমে এ ব্যাপারেও পরস্পরবিরোধী দাবি পাওয়া গেছে।
অনুরূপ সমস্যা ভুট্টো সম্পর্কেও। ভুট্টো পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলেন কি-না জানা যায়া না। কিন্তু পরবর্তীকালে ভুট্টো যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আইউব খানের কাঁধে সওয়ার হয়ে ধূমকেতুর মতো ঝড়ের গতিতে আবিভর্‚ত হয়েছিলেন এটা ঠিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি কি ছিলেন? পাকিস্তানের জন্য বাহ্যত তাঁর মায়াকান্নার অন্ত ছিল না। যে পাকিস্তানের জন্য প্রয়োজন হলে হাজার বছর ধরে ঘাস খেয়ে হলেও তিনি এটম বোমা বানাতে চেয়েছিলেন, সেই পাকিস্তান ভাঙার পেছনে তাঁর দান তো ছিল সবার চাইতে অনেক বেশি। ১৯৭০ সালের শেষদিকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তিনিও পশ্চিম পাকিস্তানের আরেক ‘স্বাধিকার’ আন্দোলন নেতৃত্বে দিচ্ছেন, যার স্লোগান ছিল- ‘হাম মাশরেকি পাকিস্তান কি গোলামি কভু নেহি বরদার্শত করুঙ্গা।’ অর্থাৎ আমরা পূর্ব পাকিস্তানের দাসত্ব কখনো সহ্য করব না। পূর্ব পাকিস্তান যখন আত্মরক্ষার জন্য স্বাধিকার আন্দোলনে ব্যস্ত, তখন পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানকে গোলাম করার এমন কোন্ ফিকির ছিল যে, তার বিরুদ্ধে এই অযাচিত হুঙ্কার? একি তবে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুত্বের রায় অস্বীকার করার পূর্বপ্রস্তুতি নয়? এই আলোকেই কি নির্বাচনোত্তর কালে এক দেশে দুটি মেজরিটি পার্টির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে তিনি বিরুদ্ধে ভুট্টোর হুঁশিয়ারি তাঁর পাকিস্তান প্রীতির প্রমাণ দেয় না। সর্বোপরি ভারতের যে বিমান লাহোর বিমান বন্দরে হাইজ্যাকের ফলে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণার সুযোগ পান, তা কি ভুট্টো ও ইন্দীরার একটি পাতানো খেলা ছিল না? কারণ ওই বিমান লাহোর ছিনতাই হওয়ার পর ভুট্টো স্বয়ং বিমানবন্দরে গিয়ে ছিনতাইকারীদের বাহবা দেন এবং তাদের সাথে একান্তে কথা বলেন।
উনিশশো সত্তরের নির্বাচনে এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছিল যে, পাকিস্তনের দুই অঞ্চলের একত্রে বাসবাসের দিন শেষ হয়ে গেছে। সত্তর সালেই পাকিস্তানের পশ্চিম অঞ্চলের তুলনায় পূবাঞ্চলের অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার চিত্র চূড়ান্তভাবে প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। এই পশ্চদপদতার কারণ হিসেবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে দায়ী করা যায় :
ক. ব্রিটিশ আমল থেকেই কৃষি ও শিল্পে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনামূলক পশ্চাৎপদতা,
খ. পার্টিশন কাউন্সিল কর্তৃক সম্পত্তির বুক ভ্যালু ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণের কারণে গোড়াতেই পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত হওয়া,
গ. পশ্চিম ও পাকিস্তানে দুই দুটি কেন্দ্রীয় রাজধানী নির্মাণে পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনা,
ঘ. অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প ও বাণিজ্য অধিকাংশের প্রধান দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান,
ঙ. কেন্দ্রীয় অফিসাদিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাধিক্য এবং
চ. দেশরক্ষা বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যাধিক্য।
দেশে গণতন্ত্র থাকলে পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাধিক্যের সুবাদে সুবিচার আশা করতে পারত। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় পাকিস্তানের ২৪ বৎসর কার্যত বেসাময়িক ও সামরিক ব্যুরোক্র্যাসির শাসনাধীন ছিল। এর ফলে উভয় অঞ্চলের মধ্যকার বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছেন বেশি। বৈষম্য থেকে বঞ্চনাবোধ, বঞ্চনাবোধে থেকে প্রতিকার ও প্রতিশোধ স্পৃহা, প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে পারস্পরিক অবিশ্বাস, অবিশ্বাস থেকে হিংসাবিদ্বেষ-সঙ্ঘাত ছিল অনেকখানি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তবুও বলতে হয়, বঞ্চনাবোধ তো ছিল পূর্বে পাকিস্তানের। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা ভুট্টোর সত্তর-একাত্তরের বক্তৃতায় পূর্ব পাকিস্তানবিরোধী বিষোদগায়ের উৎস কোথায়? এ কি কায়েমি স্বার্থ সংরক্ষণের সঙ্কীর্ণ তাগিত না বিদেশি মদদপুষ্ট অন্য কিছু?
এ প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন আসে অনিবার্যভাবে- পরস্পর বিদায়ের মনোভাব যদি উভয় পক্ষের মধ্যেই সৃষ্টি হয়ে থাকে, তবে আপসে কি দুই অঞ্চলে মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা সম্ভব হতো না? এর জন্য কি রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ একান্তই অনিবার্য হয়ে পড়েছিল? এমন যুদ্ধ কি না করলেই চলত না, যার শেষ মীমাংসার কর্তৃত্ব যাবে এমন এক শক্তির হাতে, উপমহাদেশের বহু শতাব্দীর ইতিহাসে যার মুসলিম বিদ্বেষ সুপ্রমাণিত? আমাদের মনে পড়ে, সত্তরের শেষ দিক থেকেই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বারবার বলেছেন, আপস মিলেমিছে দেশ ভাগ করে নিতে। সাতচল্লিশে দুটি অতি পুরাতন প্রতিপক্ষ যদি আপসে সাবেক ভারতবর্ষ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে পেরেছিল, একাত্তরে কেন অনুরূপ বিভাগ সম্ভব হলো না? এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ কি প্রয়োজন পড়েছিল শুধু অনিচ্ছুক জনগণের চোখকে ফাঁকি দিতে? উনিশশো একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পূর্বে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের খুব কম সংখ্যকই পাকিস্তানের বিরোধী ছিল। পঁচিশে মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র জনগণের ওপর বর্বর আক্রমণের পর খুব কম লোকই পাকিস্তানের সমর্থক ছিল। উভয় অঞ্চলের জনগণের মন পরস্পরের বিরুদ্ধে চিরতরে বিষিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এই পাতানো খেলায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কার সাথে আর কার কার যোগসাজস ছিল, তা জানা প্রকৃত ইতিহাস পুনরুদ্ধারের জন্যই আজ অপরিহার্য।
নেতাদের যার মনে যা-ই থাকুক না কেন, বাংলার দামাল ছেলেরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিন্তু এতটুকু মুষড়ে পড়েনি, যেমন কর্তব্য নির্ধারণে এতটুকু ভুল করেনি বাংলার মুক্তিকামি জনগণ। একাত্তরের ৯ মাসের মুক্তিযদ্ধ যে কোনো বিচারে ছিল একটি অসম যুদ্ধ। একটি দুর্ধর্ষ বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনতার প্রতিরোধের পেছনে জনগণের শক্ত মনোবল না থাকলে এ যুদ্ধ অঙ্কুুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত। তা যে হয়নি তার কারণ জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছে তাদের এ সংগ্রাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, তারা এও জানত, জুলুম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো সংগ্রামে আল্লাহর মদদ অবশ্যম্ভাবী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ। যারা এ যুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে, তরার ছাড়াও প্রায় ৯ কোটি মানুষ সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নানা পর্যায়ে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কেউ খাবার দিয়ে, কেউ আশ্রয় দিয়ে, কেউ অর্থ দিয়ে, কেউ অস্ত্র দিয়ে, কেউ পরামর্শ দিয়ে, কেউ শত্রুর অবস্থায় সম্পর্কে গোপন খবরাদি সরবরাহ করে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এই যুদ্ধে শামিল থাকার সন্দেহে বাংলার কত মানুষ যে পশ্চিমা বাহিনীর অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়েছে। কত বাড়িঘর, দোকানপাট ধ্বংস হয়েছে, কত লোক গৃহহারা হয়ে স্বদেশে পরবাসী হয়ে বনে-জঙ্গলে রাতে পর রাত কাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
এই যুদ্ধের কারণে যারা দেশে ত্যাগ করে বিদেশের মাটিতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেষ্টা করেছে, তাদেরও অনেকেউ বিদেশ-বিভুঁইয়ে শান্তিতে থাকতে পারেনি। যুদ্ধের গতিধারাকে বিদেশি শক্তি বারবার নিজেদের স্বার্থে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেছে, বহু মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দী ও হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে, তবুও চরম ধৈর্য সহকারে সব কষ্ট স্বীকার করে হলেও তরা যদ্ধ চালিয়ে গেছে। বিদেশি জমিনে বিদেশি শক্তির মনমতো লোকদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, বৈষম্য করা হয়েছে শত শত মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে, তবুও মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহে স্তব্ধ করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়া দেয়া হতো, যে জাতি তার ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে না, আল্লাহও তার ভাগ্য পরিবর্তন করেন না। আল্লাহর এই বাণীর আলোকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৯টি মাস ধরে লড়ে যান এক অনন্য যুদ্ধ-মুক্তি ও স্বাধীনতার অন্বেষার জালিমের জুলুমের দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে। অবশেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে এলো তাদের ঈস্পিত দিন- যেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় স্বীকারের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হলো স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ৯ মাসের দুঃস্বপ্ন ঘেরা অমানিশার অবসানে মুক্তির আলোয় জলমল করে উঠল একটি জাতি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিজয় দিবস

১৮ ডিসেম্বর, ২০২২
১৭ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন