Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আমাদের করণীয়

ক ম ল চৌ ধু রী | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৭ এএম

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারত বিভিন্ন দিক থেকে বাংলাদেশের প্রতি অত্যাচার, নীপিড়ন করে আসছে। ভারতের ন্যূনতম সহানুভ‚তি ও নেই তার গরিব প্রতিবেশী বাংলাদেশের ওপর। তাই ভারতের অব্যাহত বৈষম্য, অবিচার ও ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ ও জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে। ভারত আন্তর্জাতিক রীতি নীতি উপেক্ষা করে তার আধিপত্যবাদ আর সম্প্রসারণবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে তার গরিব প্রতিবেশীর অস্তিত্ব বিপন্নের মধ্যে দিয়ে। নদীমাত্রক দেশ বাংলাদেশ। নদীর প্রবাহের সাথে মানুষের জীবনপ্রবাহ জড়িত। সেই অর্থে নদী বাঁচবে, আমরাও বাঁচব। ভারত থেকে ৫৪টি এবং মিয়ানমার থেকে তিনটিসহ মোট ৫৭টি নদী শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। বাংলাদেশে একসময় ১২০০ নদীর নাম শোনা যেত, এখন ২০০ নদীও সচল নেই। সব শুকিয়ে চিকন মরা খালে পরিণত হয়েছে। চিহ্নই থাকছে না। আমাদের তিন দিক দিয়ে ঘেরা বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারত আন্তর্জাতিক নদীর সকল নিয়ম-কানুন লঙ্গন করে একতরফাভাবে উজানে বাঁধ দিয়ে পানিকে প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে মরুভ‚মিতে পরিণত করছে। ফলে হাওড়-বাওড়, বিল-ঝিল খাল, বিপর্যস্ত করে তুলছে। সারাদেশে প্রায় আট কোটি মানুষ আর্সেনিক আতঙ্কে রয়েছে। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুষ্টিয়া, বগুড়ার বিস্তর এলাকায় (৬০-৭৫) শতাংশ টিউবওয়েলে আর্সেনিক সমস্যা বিরাজমান। দেশের মোট ৬০টি জেলা ও ২৭১টি উপজেলায় আর্সেনিক বিষ কম বেশি রয়েছে। নদীর পানি কমে যাওয়ায় কৃষি, শিল্প, সেচ, নৌ-পরিবহন, গাছ-পালা, পরিবেশ, মৎস্য সম্পদ, পানীয় জলসহ বহুবিধ শঙ্কা প্রবল হয়ে জমির উর্বরতা নষ্ট ও শিল্প কারখানা ধ্বংস করে দিচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের পদ্মা, যমুনা, তিস্তা নদীতে এখন সম্পূর্ণ চর পড়ে গেছে। চরে এখন মানুষেরা ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলাধুলা করছে।
বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে অন্যততম প্রধান নদী পদ্মার ১৯ মাইল উজানে মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা নামক স্থানে ভারত ১৯৬১ সালে বাঁধ দেয়ার কাজ শুরু করে এবং ১৯৭৪ সালে ফিডার কেনেলসহ নির্মাণকাজ শেষ করে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে। আজ ৩২ বছর ধরে ভারতে পরীক্ষাই শেষ হলো না। (ভারত হচ্ছে সালিস মানি, কিন্তু তালগাছ আমার, এই নীতিতে বিশ্বাসী)। অথচ ভারত সরকার প্রায় আলোচনা ও সেমিনারে বলে থাকে, বাংলাদেশের ক্ষতিকারক কিছুই তারা করবে না। ফারাক্কা বাঁধ চালুর আগে বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে শীত মৌসুমে, ৪৭ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকত। ’৭৫ সাল থেকে নানা প্রকার সমঝোতা চুক্তি ইত্যাদি স্বাক্ষরের জমি এবং চার কোটি মানুষের জীবন ও পরিবেশকে বিপন্ন করা হয়েছে। শীতকালে বহু নদীতে নৌকার বদলে গরু-মহিষের গাড়ি চলে। প্রমত্তা নদীগুলো এখন চিকন মরা খালে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের ১৯৭১ সালের রেকর্ড থেকে দেখা যায়, নৌপথের দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার এবং বর্তমানে ছয় হাজার কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।
IRLP (Indian River Linking Project)--বাংলাদেশ নদীবাহিত পানির প্রায় ৬১ শতাংশ আসে ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে নামে ব্র‏হ্মপুত্রের পানি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মরুভ‚মি অঞ্চলে (মরুভ‚মিকে মরুদ্যানে পরিণত করার উদ্দেশ্য) সরিয়ে নেয়ার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে আমরা পানির জন্য হাহাকারের দেশে পরিণত হবো। ভারতের এরকম বৈরী আচরণ অব্যাহত থাকলে এ দেশে একদিন কারবালার মাতম উঠবে। সুবজ, শ্যামল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর প্রাণী বৈচিত্র্যে ভরপুর সুবৃহৎ বদ্বীপ বাংলাদেশ হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। বিশেষ করে জাতিসংঘ ঘোষিত পৃথিবীর মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ সর্বশ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ বনভ‚মি সুন্দরবনও হারিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে ভারসম্যহীন লভণাক্ততার কারণে সুন্দরী গাছের আগামরা রোগ দেখা দিয়েছে। ফলে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, গোটা পৃথিবীর পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা করেছেন খ্যাতনামা ভূতত্ত্ববিদ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল মান্নান (পুরান ঢাকার কৃতী সন্তান, বর্তমানে ফিনল্যান্ডের আউলু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে নিয়োজিত)। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে উজানের ৩০টি নদীতে ৩৩টি বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
শুধুমাত্র ফারক্কা বাঁধের প্রভাবে ৩৫ বছরে বাংলাদেশ হারিয়েছে ৮০ ভাগ নৌপথ। নৌপথে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহন কম খরচে করা যায়। নৌ-চলাচলের জন্য নদীর গভীরতা কমপক্ষে দরকার তিন মিটার, বাংলাদেশের কোনো কোনো নদীতে এখন তা দুই মিটারের নিচে। পানি চুক্তি অনুসারে ৩৬ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত পানি নিয়ন্ত্রণ করায় বাংলাদেশ পায় মাত্র আট হাজার কিউসেক পানি। এবার তাও পায়নি। ভারত বলেছে, এবার বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল কম হয়েছে, ইত্যাদি। ফারাক্কার পানি প্রবাহ বাড়ানোর জন্য ভারত সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও আসলে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভারত মুখে আর অন্তরে ১০০ ভাগ উল্টো কাজ করছে। উপরন্তু বিগত বছরগুলোতে ভারত গঙ্গার উজানে আরো ১৮টি ব্যারেজ এবং ৩০০টি ছোট-বড় জলাধার নির্মাণ করেছে। ফলে ফারাক্কায় গঙ্গার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে বলে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা যায়। শীত ও গ্রীস্মকালে যখন আমাদের প্রচুর পানি দরকার, তখন ভারত সবগুলো গেট বন্ধ রাখে। আর যখন বর্ষাকাল, আমাদের পানির দরকার নেই, তখন সবগুলো গেট খুলে দেয়। ফলে মহাপ্লাবনে আমাদের দেশ ডুবে যায়। ২০০৫ সালে আমাদের দেশে দুই মাসের মধ্যে তিনবার বন্যা হয়েছে। এতে ঘরবাড়ি, ফসলহানীসহ বাংলাদেশের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে সি. ডব্লিউপাস্প কন্ডেনসারকে সঠিকভাবে ঠান্ডা করতে পারছে না। ফলে কন্ডেনসারের ভ্যাকুয়াম কম এবং এগজস্ট টেম্পারেচার বেশি। বাধ্য হয়ে কম উৎপাদন করতে হচ্ছে। কারণ- (১) নদীর পানির গভীরতা কম। (২) নদীতে ফ্লো নেই। (৩) পানির অ্যামোনিয়া, কন্ডাস্ট্রিভিটি হর্ডনেসের পরিমাণ বেড়ে গেছে। (৪) অল্প সময়ের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণের অনেক আগে কন্ডেনসারের টিউবগুলো মরিচা ধরে ফুটো হয়ে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। (৫) নদীর পানিই বেশি গরম থাকে, ঠিকভাবে ঠান্ডা হয় না। কন্ডেনসারকে কিভাবে ঠান্ডা করবে? (৬) নদীতে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে ড্রেজিং করেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে কম। যে হারে পলি-বালি ইত্যাদি পড়ে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে এবং পানির গভীরতা কমছে। তাই মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে রাখা কঠিন হবে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের ৭৫ ভাগ এলাকায় পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ : ভারত এখন আবার মেঘনার উৎস নদী সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারার উজানে মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখ নামক স্থানে বোরাক নদীতে বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িক হলে সম্পূর্ণ সিলেট, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের ১২টি জেলা মরুভ‚মিতে পরিণত হবে। বিশ্বব্যাংক ভারতকে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে পাঁচ হাজার কোটি রুপি ঋণ দিয়েছে। ভারত ও ব্যাপারে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে সিডিউল বিক্রির পর এখন নির্মাণকাজ শুরু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ভারতের এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশের কুশিয়ারা নদী শুকিয়ে যাবে ও মেঘনা নদীতে চর পড়ে যাবে।
বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের আমলেই প্রধান বিরোধী দলসহ রাজনৈতিক দলগুলোর শুধু একটাই কাজ- সরকারের কঠোর সমালোচনা করে নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার অপচেষ্টা করা। যেমন- বর্তমানে বিদ্যুৎ সমস্যার জন্য বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে সকল প্রকার সমালোচনা করছে। কিন্তু বিরোধীদল কি একবারও ভেবেছে- গ্রীষ্ম ও শীতে বিদ্যুৎ কেন নেই? বাংলাদেশের নদীর পানি ভাতর গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে আটকে রাখার কারণে নদীতে পানি কম থাকায় বিদ্যুৎ উৎপন্ন চাহিদানুযায়ী হয় না। ভারত দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদ বিস্তার এবং মুখে লম্বা লম্বা কথা বলছে। অথচ গঙ্গার পানি চুক্তি ও তিন বিঘা করিডোরের সমস্যার সমাধান করছে না। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এই মুহূর্তে আমাদের করণীয় কাজ হচ্ছে যেমন- (ক) টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে সুরমা-কুশিয়ারা ও মেঘনা নদী শুকিয়ে মারার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। (খ) গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়করণ। (গ) আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামে ব্রক্ষপুত্র তিস্তার পানি প্রত্যাহারের চক্রান্ত প্রতিহতকরণ। (ঘ) বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। (ঙ) আঞ্চলিক সংস্থা সার্কে আলোচনা করে নিষ্পত্তিকরণ- না হয় আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে আমাদের ন্যায্য পানির হিস্যা আদায়করণ।
পানি আল্লাহর দান ও নেয়ামত। পানির অপর নাম জীবন। মানবকুলসহ সব প্রাণী ও উদ্ভিদের সৃষ্ট উপাদানও পানি। পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ পানি। পানি জীবনের জন্য আবশ্যক বলে মহান আল্লাহ তায়ালা পানিকে সহজলভ্য করে দিয়েছেন। অথচ এই হিংসুক মানব গোষ্ঠী একে অপরকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ইয়াজিদ কারবালার প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসেন (রা.) এর পরিবারসহ সঙ্গীদের ফোর্সদের পানি থেকে (রেবিকেড দিয়ে) বঞ্চিত করে দুধের শিশুসহ সবাইকে শহীদ করেছিল। ভারত ও তেমনি ৫৪টি নদীর উজানে বিভিন্ন বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে একবার শুকিয়ে ও আবার ডুবিয়ে মারার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাই সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামল বাংলার ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব রক্ষার্থে এই মুহূর্তে ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ভারতের এ রকম বৈষম্য, অবিচল আধিপত্যবাদ ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে রুখে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিজয় দিবস

১৮ ডিসেম্বর, ২০২২
১৭ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২
১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন