বিজয় দিবসের কবিতা
তুমি বাংলা ছাড়ো আবদুল হাই শিকদাররক্তচোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া আমার বছরগুলোআজকে যখন হাতের মুঠোয়কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী
বাংলাদেশ পৃথিবীর ৪৫টি মুসিলিম দেশের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, যার জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান। অবশিষ্ট নাগরিক প্রধানত হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। এ দেশটির বিস্তীর্ণ অংশ দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে বিরাজমান। পশ্চিমে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, উত্তরে কিছু অংশ পশ্চিম বঙ্গ ও কিছু অংশ আসাম সীমান্ত বরাবর অবস্থিত আর পূর্বদিকে মিয়ানমার সীমান্ত বরাবর বিস্তৃত। ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত প্রসারিত মুসলিম জাহানে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঈসায়ী সপ্তম শতক থেকে ইসলামের সুমহান পয়গাম মানবতার সার্বজনীন আবেদন নিয়ে আরব ভূখন্ড ধেকে বাংলায় আসতে থাকেন আল্লাহর ওলি-দরবেশ। তৎকালে দেশ-দেশান্তরে চালায় নৌপথই ছিল প্রধান নির্ভর, তাই বেঙ্গোপসাগরের কুলঘেঁষা এলাকাতেই প্রথমে এবং পরে ক্রমাগত অভ্যন্তর ভাগে তাঁরাই ইসলামের বাণী পৌঁছাতে থাকেন।
অন্য দিকে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়, পরে মুসলিম শক্তির আরো বিস্তারে ভারতে ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রসার পেতে থাকে। প্রবহমান এই স্রোতধারয় তের শতকের শুরুতে বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন।
বাংলার মানুষ ছিল দীর্ঘকাল অবহেলিত। এ দেশের আনার্য দ্রাবিড় এই জনগোষ্ঠীর ভাষাও ছিল আপাঙক্তেয়। বর্ণভেদ প্রথার প্রবক্তারা ঘোষণা করেছিলেন, এ দেশের মানুষের ব্যবহারিক ভাষায় শাস্ত্র চর্চা পাপ, এ পাপের সাজা রৌঢ়ব নামক নরকবাস। বর্ণভেদ আর অস্পৃশ্যতার অভিশাপে মানুষে মানুষে বিভেদের প্রাচীর মানবতার সূর্যকে আড়াল করে রেখেছিল, মানুষ্যত্বের এই চরম দুর্দিনে একদিকে মুসলিম শাসনে মানবিক উদার দৃষ্টভঙ্গী, অন্য দিকে ওলি-দরবেশগণের তৌহিদি পয়গামে সবাইকে আপন করে বুকে তুলে নেয়ার নিপীড়িত বাংলার মানুষ খুঁজে পেল মুক্তির পথ, আলোর সন্ধান। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রভু নেই, মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) তাঁর রাসূল কালেমা এই উদাত্ত দাওয়াত ছিল এদের কাছে যুগান্তকারী আহ্বান। কালেমা পাঠের মাধ্যমে এরা সবাই দাঁড়াল এক কাতারে, বিভেদের প্রাচীর ধ্বংস হলো। বহু শতাব্দীর জুলুম ও নিষ্পেষণে ক্লান্ত এ দেশের মানুষ লাভ করল মানব মর্যাদা।
১৩ শতকের শুরু থেকে আঠার শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত মুসলিম শাসন ছিল বাংলায়। এ শাসন কখনো দিল্লিকেন্দ্রিক সুবেদারি, কখনো স্বাধীন সুলতানাত। মুসলিম শাসনকালে ইসলামী আদর্শের অনুশীলন ছিল প্রধাণত ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। ওলি-দরবেশগণের দাওয়াতে আকৃষ্ট মুসলিম সমাজকে ইসলামী আদর্শে সুসংগঠিত করে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ইসলামী আদর্শে ঢেলে সাজানোর তৎপরতা ছিল না। অবশ্য মাঝে মধ্যে কোনো কোনো সুলতানের আমলে বিচার ব্যবস্থায় ইসলামী শরিয়তের প্রবর্তন ওই সময়কালের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। বস্তুত আর্দশ যতই সুন্দর হোক, সমষ্টিগতভাবে তাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর না করলে এই আর্দশ থেকে স্থায়ী ও ব্যাপক সুফল আশা করা যায় না।
পলাশী পরাজয় বাংলার আকাশে আনলো ঘন দুর্যোগ। মুসলিম সামাজ হারাল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। অর্থনৈতিকভাবে এদের মেরুদন্ড ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত সফল হয়েছিল। ডব্লিউ. ডব্লিউ হান্টার দ্য ইন্ডিয়ার মুসলমানস গ্রন্থে স্বীকার করেছেন, ১০০ বছর আগে মুসলিম সমাজ দরিদ্র ও অভাবী এটা ছিল অচিন্তনীয়; কিন্তু ১০০ বছর পর আজ মুসলিম সমাজ সচ্ছল ও বিত্তবান এটি অভাবনীয়। বস্তুত মুসলিম সমজের এই চরম দুর্গতি ইংরেজ ও তার এ দেশীয় দোসরদের গভীর যড়যন্ত্রের ফল। শুধু বাংলাতে নয়, উপমহাদেশের সর্বত্রই মুসলিম সমাজের একই অবস্থা। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতির পরিবর্তন ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। মনের পর্দায় ছবির মতো ভেসে ওঠে পলাশীর প্রান্তর, বালাকোটের ময়দান, তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা, হায়দার আলী, ফতেহ আলী টিপুর, প্রতিরোধ, ফকির মজনুশাহ্ ও হাজী শরীয়তুল্লাহর তৎপরতা।
বাহ্যত পরিচয় যাই থাকুক না কেন, শোষকের কোনো জাত নেই। তারা সবাই শোষক এই তাদের পরিচয়। অপরের অধিকার হরণ করে নিজে স্বার্থসিদ্ধি তাদের বিবেকে বাধে না। বাংলার বুকে এই শ্রেণীর মানুষ যুগে যুগে সৃষ্টি করেছে বিপর্যয়, দুর্ভিক্ষ, ঘরে ঘরে ক্রন্দন উঠেছে অন্ন-বস্ত্রের অভাবে। এরা কখনো অত্যাচারী শাসক, কখনো এদের পরিচয় প্রতাপশালী জমিদার নায়েব-গোমস্তা, মুৎসুদ্দী, সুদী মহাজন, সামন্তবাদী শাসক।
উপমহাদেশের নিপীড়িত মুসলিম সমাজের সাথে বাংলার মুসলামানও স্বপ্ন দেখল স্বাধীন বাসস্থানের । এমন দেশে যেখানে সমাজও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হবে নিশ্চিত; আর মুক্তির এই পথ ও নিশ্চয়তা আসবে মুসলিম লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের ঘোষণা মোতবেক ইসলামের সুমহান আদর্শ অনুসরণে। ভারত বিভক্তির বিঘোষিত নীতিমালার প্রেক্ষিতে জনসমষ্টির ধর্মীয় পরিচয়ের মানদন্ডে গোটা বাংলা পাকিস্তানের অন্তভর্‚ক্ত হওয়ার যৌক্তিকতা রাখলেও রাজনৈতিক ক‚টনীতি ও মুসলিম বিদ্বেষের ষড়যন্ত্রে বাংলা হলো বিভক্ত। পূর্ব বঙ্গ নামে সৃষ্টি হলো একটি প্রদেশ। আজ এর পরিচয় স্বধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পাকিস্তনের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী অধ্যুষিত এই এলাকা সঙ্গতভাবে অধিকারে হকদার ছিল যে ব্যবহার ও সম্পদের, ইতিহাস সাক্ষী প্রত্যাশিত সে ন্যায়বিচার ও ন্যায্য আধিকার এ দেশ পায়নি। কখনো রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে, কখনো বাঙালি বিহারি সম্পর্ক নির্ণয়ে কখনো সেনাবাহিনীতে লোক নিয়োগে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে দিনের পর দিন ধূমায়িত হয়েছে অসন্তোষ, যার প্রচন্ড বহিঃপ্রকাশ ঊনসত্তর থেকে একাত্তরের শেষ অবধি। লাখ লাখ শহীদের রক্ত ঝরল এই বাংলাদেশ। শতকরা আটানব্বই ভাগ ভোট পেয়ে যে নেতৃত্ব ক্ষমতার হকদার হলো, তাকে ক্ষমতা অর্পণ করলে অকারণ রক্তক্ষয়ের বিষাদান্তিক নাটকের দৃশ্যগুলো এত মর্মান্তিক হতো না।
মুক্তিবাহিনী, সামরিক, আধা সামরিক বাহিনী ও এ দেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করেছে। যারা ভাবলেন : পাকিস্তান বিভক্ত এই এলাকায় সৃষ্টি করবে বহিঃশক্তির আধিপত্যবাদ, এ দেশ হারাবে স্বকীয় স্বাধীন সত্তা, তার সংগ্রামের সপক্ষে থাকতে পারেনি। যুদ্ধ চলাকালেই এঁদের অনেকের মতের পরিবর্তন ঘটে বাস্তব অবস্থার আলোকে। অনেকে পরিবর্তন এসেছে আরো পরে। ঢালাওভাবে এদের স্বধীনতার শত্রু আখ্যায়িত করে মনে আত্মপ্রসাদ পাওয়া যেতে পারে হয়তো, কিন্তু মানুষের ধারণা ও চিন্তার বৈচিত্র্যের সঠিক মূল্যায়ন করা হয় না।
বাংলাদেশের মাটিতে জানা-অজানা মুক্তিযোদ্ধার কবরের পাশ দিয়ে হাঁটতে মন শোকাভ‚ত হয়; প্রাণের তাজা রক্ত ঢেলে এরা এনেছে এই স্বাধীনতা, আমরা যার উত্তরাধিকারী। অন্য দিকে, এ দেশে এমন বহু লোকের মৃত্যুর করুণ কাহিনী শুনি, যারা বিদ্যমান কাঠামো বহাল থাকার সপক্ষে থাকলেও পাক বাহিনীর বর্বরতাকে সমর্থন করেনি কোনোদিন। এদের জন্যও চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
এ দেশের তৌহিদবাদী মানুষেরা আল্লাহর নাম নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ইসলামের নির্দেশ- এই বিশ্বাস ছিল তাঁদের অন্তরে। নামাজ ও দোয়া দরুদ পাঠ করে নির্ভয়ে অপারেশনে যাত্রা; রাতের অন্ধকারে ঘরে ফিরে মাকে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করার অনুরোধ, নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, রোজা রাখার মাধ্যমে সন্তানের কোলে ফিরে আসার জন্য মায়ের মুনাজাত ও অশ্রুসজল কান্না, স্মরণকালে কালেমা পাঠ করে মুক্তিযোদ্ধার জীবনাবসান- এই ইতিহাস মিথ্যা নয়।
এই প্রান্তিকের বাইরে কিছু লোক এমন মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা করেছে যা শুনে মানবতা শিউরে ওঠে। সন্দেহের অক্টোপাশে জ্ঞানী-গুণী, অধ্যাপক, ডাক্তার, শিল্পী-সাংবাদিক, ইমাম, আলিম, মাওলানা বহু লোক প্রাণ হারালেন। মনুষ্যত্ব এখানে স্তব্ধবাক। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রবল ঝঞ্ঝার শেষে সাগরের প্রশান্তি ছিল কাম্য। হয়তো তাই হতো। কেননা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সামান্য সময়ের জন্য শোনা গিয়েছিল কিছু লোক এ দেশকে মুসলিম বাংলা নামকরণের পক্ষপাতী, তাদের বক্তব্য ছিল এতে মুসলিম বিশ্বের সাথে যোগাযোগ হবে সুবিধাজনক। ধীরে ধীরে বাস্তবতা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এদের তৎপরতা বন্ধ হয়। এরা স্বীকার করে নেয়, এ দেশের নামকরণ।
দেশের আপামর সকল মানুষের মনে দেশের অস্তিত্ব ও সার্বভৌম সত্তার বিশ্বাস সুদৃঢ় হলেও প্রত্যাশিত শান্ত পরিবেশ বাংলায় আসেনি। রাষ্ট্রীয় আদর্শ নির্ণয়ে মত-পার্থক্য শিক্ষানীতির বারবার পরিবর্তন, ঘন ঘন রাজনৈতিক পট বদলানো দেশকে যুদ্ধোত্তর সুস্থ করে তোলায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেও বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা তার অনুসরণে ব্যর্থ হয়েছি বারবার। জাতি হিসেবে আমরা বহুলাংশে অসহনশীল, অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতে শিখিনি, এর প্রমাণ দিয়েছি বারবার। মত-পাথর্ক্যরে এই তীব্রতা থাকলেও আমরা মনে করি বর্তমানে বাংলাদেশের সকল নাগরিক ভালোবাসে দেশকে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা বিপন্ন হোক এটা কারারোই কাম্য নয়। আমরা এই বিশ্বাসে স্বাধীনতা মূল্যায়ন ও তার সংরক্ষণে ইসলামী আদর্শের আলোচনায় অগ্রসর হতে চাই। প্রথমেই জানা দরকার স্বাধীনতার লক্ষ্য ও ইসলাম সম্পর্কে কি অভিমত। বাংলাদেশে পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও ইসলামী আদর্শ এই তিন মতবাদের অনুসারী বুদ্ধিজীবী বিদ্যমান। পুঁজিবাদের সমর্থকদের অভিমত ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার এই সাথে মানুষের কর্মময় বাস্তব জীবনকে গ্রথিত করা অনুচিত। একটি দেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্থনৈতিক মুক্তি। অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মানুষ অধিকার পাবে অর্থ উপার্জনের আর এই অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও তার পূর্ণ স্বাধীনতা। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তাগণ জীবনের সকল পর্যায় থেকে ধর্মকে নির্বাসিত করার কথা দীর্ঘকাল উচ্চারণ করলেও বাংলাদেশে ইদানীং এরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মকে আবদ্ধ রাখায় সম্মত হয়েছে। আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এরা শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। তৃতীয় দলের বক্তব্য শুধু অর্থনীতিতে নয়, জীবনের সকল স্তরে ইসলামী বিধান চালু ও তার অনুসরণেই স্বাধীনতার সত্যিকার তাৎপর্য নিহিত।
এই ত্রিধাবিভক্ত বুদ্ধিজীবীরা এ দেশের সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে এবং এদের আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ করছে এ দেশের জাগ্রত ছাত্রসমাজ।
আমরা মনে করি, বিশ্বে ধর্ম নামে প্রচলিত অন্যান্য মতবাদের সাথে ইসলামকে এক করে দেখার ফলেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি। মহানবী মোস্তফা (সা.) ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর মানুষের মৌলিক অধিকার লাভ নিশ্চিত করেন। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান জীবনের এই অপরিহার্য বিষয়গুলো সবার জন্য নির্ধারিত এ ঘোষণা ছিল। তিনি বলেছিলেন : ‘সমাজে যাদের কোনো অভিভাবক নেই, আমি তাদের অভিভাবক’। হজরত উমর (রা.) ছদ্মবেশে রাতের বেলায় সাধারণ মানুষের অভাবের খবর নিতেন এবং প্রয়োজন পূরণ করতেন। তাঁর বক্তব্য ছিল : ‘আমার শাসন আমলে সুদূর ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুরও যদি খাদ্য অভাবে মারা যায়, তার জন্য শাসক হিসেবে আমাকে পরকালে কৈফিয়ত দিতে হবে।’ হজরত আলী (রা.) তাঁর খিলাফত আমলের সুদীর্ঘকাল শুকনা রুটি পানিতে ভিজিয়ে খেতেন। কারণ হিসেবে তিন বলেন : ‘আমার শাসনকালে দেশে এমন লোক আছে যারা রুটি এভাবেই খায়। আমি খলিফা হয়ে তাদের চাইতে উত্তম কিছু খেতে পারি না’।
মহানবী (সা.) ও সাহাবাদের এই আদর্শ অনুসরণ করা হলে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য ভিন্ন মতাদর্শের আকর্ষণ সৃষ্টি হতো না। ইসলাম ব্যক্তিগত ব্যাপারে, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে এর কোনো কার্যকারিতা নেই- এ কথা উঠত না।
এ দেশের শতকরা ৮০ জন নিরক্ষর লোকের কাছে স্বাধীনতার অর্থ চাল-ডাল-কাপড়ের দাম কমা, পেট ভরে দুবেলা খাওয়া। এ দেশের বড় বড় নেতার সভায় বিপুল জনসমাগমের পেছনে বড় রহস্য- জনতার বিশ্বাস এরা ক্ষমতায় গেলে খাওয়া-পরা সহজ হবে, জিনিসপত্রের দাম কমবে। তাই মূল্যবান ও আকর্ষণীয় যত সংজ্ঞাই স্বাধীনতার স্বপক্ষে প্রদান করা হোক না কেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতার এই অর্থই ভালো বোঝে।
বুদ্ধিজীবী সমাজের কাছে স্বাধীনতার অর্থ আত্মবিকাশের সুযোগ। অর্থ সম্পদ এর সহযোগী আকর্ষণ। ইসলামী বিধানের আনুষ্ঠানিক বাহ্যরূপ নিয়ে যারা ব্যস্ত, তাদের কাছে স্বাধীনতার প্রধান কথা নামাজ- রোজা, পোশাক-পরচ্ছদ, বোরখা, আদব-তমিজ বিষয়ে মানুষের আরো একনিষ্ঠ হওয়া এবং অনৈইসলামী কাজ- বিশেষত সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া ও অশ্লীল শিল্প-সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া ইত্যাদি।
চতুর্থ এক শ্রেণীর মানুষ এ দেশে বিদ্যমান যারা স্বাধীনতাকে দেখে ধনী ও বিলাসী হওয়ার সুযোগ হিসেবে। এদের সর্বক্ষণিক লক্ষ্য, কত অবাধে বিপুল অর্থসম্পদের অধিকারী হওয়া যায় সেদিকে। নিবৃত্তিহীন এই আকাক্সক্ষা তাদের আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। দুর্ভাগ্য আমাদের এ দেশে এই শ্রেণীর মানুষের স্বার্থই বেশি সংরক্ষিত হয়ে আসছে। এরাই দেশের পরিচালিকা শক্তি। নইলে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালে চারজন কোটিপতির স্থলে বিগত ৩০ বছরে কি করে এদের সংখ্যা এত বেশি হতে পারে। বিপরীত দিকে ১২ বছর আগে এ দেশে ছিন্নমূল ও অভাবী মানুষ যা ছিল তা বেড়ে গেছে অনেক গুণ। মধ্যবিত্ত সমাজ ক্রমেই নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজে পরিণত হচ্ছে, নিম্নমধ্যবিত্ত দাঁড়াচ্ছে ফুটপাথে।
জনজীবনের এই সমস্যা সমাধানে পুঁজিবাদী বুদ্ধিজীবী মহল পশ্চাত্যের আদর্শে অনুরক্ত। সমাজতন্ত্রী সুধীগণের লক্ষ্য কমিউনিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনুসরণ। এ ব্যাপারে ইসলামী দলসমূহের অভিমত শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদত নয়, অর্থনীতিসহ সকল ব্যবস্থার মূলনীতি ঘোষিত হয়েছে আল কুরআনে। এই আদর্শে সত্যিকার অর্থেই জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহানবী মোস্তফা (সা.)।
বাংলাদেশের তরুণ যুবসমাজ উপরোক্ত তিনটি মতবাদে পরিচালত রাজনৈতিক নেতা ও সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে বিজড়িত। ইসলামী বিধানের সপক্ষে দল ও ছাত্র সংগঠনের সামনে একটি বিষয় অত্যন্ত ষ্পষ্ট থাকা দরকার। মহানবী (সা.) এর যারা বিরোধিতা করেছিল, তারা মূলত নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কোনো বাণী উচ্চারণ করেনি বরং দুঃখী মানুষকে আরো কষ্টে রাখতেই তারা আনন্দ অনুভব করেছে। এই শ্রেণীর মানুষ দ্বীন ইসলাম তথা মানবতার দুশমন। কিন্তু আমাদের দেশে বাহ্যত যাদেরকে ইসলামের দুশমন ভাবা হচ্ছে, তারা কি সত্যি সত্যি ইসলাম অপছন্দ করে? বিবাহে, আকিকায়, মরণে, ঈদে-কোরবানিতে এমনকি জুমার নামাজেও তারা শরিক হয়। ইসলামী বিধান মেনে চলে। মাওলানা সাহেব ছাড়া তাদের চলে না।
বস্তুত দীর্ঘ অনেক শতাব্দী যাবত ইসলামী আদর্শে দুস্থ মানব সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল করে তোলার বাস্তব ইতিহাস না থাকায় এদের দৃঢ় প্রতীতি জন্মেছে, ইসলামী আদর্শে এই সমস্যা সমাধান অসম্ভব। তা ছাড়া পাকিস্তান আমলসহ বিগত চার দশকের ইতিহাস এ দেশে ইসলামী দলের কাছে থেকে কুরআন-হাদিসের আলোকে দুস্থ মানুষের সপক্ষে মিছিল, প্রতিবাদী দুর্বার গণআন্দোলন প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বরং এই শ্রেণীর মানুষ যত না গরিব ও নিরন্ন মানুষের সান্নিধ্যে এসেছে, তার চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে বিত্তবানদের এবং এদের সান্নিধ্যের উষ্ণতায় ও প্রভাবে বিত্তবানদের অর্থ কমেনি।
ট্রাজেডি এখানেও যে, পন্ডিত কার্ল মার্কস, বিপ্লবী নেতা লেনিন ও মাওসেতুংয়ের বিপ্লবী চেতনা, কর্মজীবন ও তাদের গঠিত সমাজ ব্যবস্থার সাথে এদেশের শিক্ষিত যুব সমাজের নিবিড় পরিচয়- তার তুলনায় কুরআনের আলোকে গঠিত মহানবী (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত সমাজের সাথে পরিচয় একেবারে শূন্যের কোঠায়। কুরআন শরিফ আরবি ভাষায়, বাংলায় অনুবাদ করে এই যুব-ছাত্র সমাজের হাতে তুলে দেয়ার তেমন প্রচেষ্টাই গ্রহণ করা হয়নি। তাই ছাত্রদের দোষারোপ করা অযৌক্তিক। সেক্যুলার পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা এদের ইসলামবিমুখ করে তোলার পথে হয়েছে আরো সহায়ক।
স্বাধীনতা রক্ষার সাথে স্বাধীনতার লক্ষ্য সমাজদেহে বাস্তবায়িত করার প্রশ্ন-বিজড়িত। পূর্বেই বলেছি এদেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাধীনতার অর্থ জীবনে বেঁচে থাকার অধিকার লাভ। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশবাসী সকল মানুষের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন। দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন-রাত কাটায়। অসুখে পায় না পথ্য ও চিকিৎসা; বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চিত্র একটি দেশের স্বাধীন থাকার পক্ষে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এই সমস্যা সমাধানে ইসলামী বিধানের দৃষ্টিতে দেশের বিত্তবানদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনবোধে আইনের কঠোরতায় এই সমস্যা সমাধান করতে হবে।
আল-কুরআনের ঘোষণা :
১. ‘সমাজে যারা অভাবী, ভিক্ষুক ও বঞ্চিত মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ও মালিকানা রয়েছে ধনীদের অর্থ-বিত্ত ও সম্পদে।’
২. ‘এমন অবস্থা যেন সমাজে সৃষ্টি না হয় যার ফলে অর্থসম্পদ কেবলমাত্র তোমাদের ধনী ব্যক্তিদের হাতে আবর্তিত হতে থাকে।’
হাদিসে আছে :
‘অর্থ সম্পদ ধনীদের কাছে থেকে আদায় করে গরিব ও অভাবীদের মধ্যে বণ্টন করে দাও।’
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা না থাকলে দেশের স্বাধীনতা মানুষের কাছে কোনো আকর্ষণ দৃষ্টি করতে পারে না। দেশকে ভালোবাসবে, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় মানুষ প্রাণ দিতে তখনই এগিয়ে আসবে যখন তার পেটে থাকবে খাদ্য, পরণে থাকবে বস্ত্র। দেশ গরিব হলে দেশের সকল মানুষকেই গরিবানা হালতে চলতে হবে। গরিব দেশে যদি গরিব হতে থাকে আরো গরিব, আর সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠতে থাকে কতিপয় লোকের জীবনে, তবে কেন সাধারণ মানুষ শান্ত থাকবে, কেন ভালোবাসবে দেশকে? এরূপ অবস্থার নিরসন না হলে মানুষ স্বাধীনতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। অভাবের তাড়নায় মা স্বীয় সন্তান বিক্রি করে দিচ্ছে, সতিত্ব বিসর্জন দিচ্ছে বোনেরা-এ ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। এই দুরবস্থাকে কোনোক্রমেই আর উপেক্ষা করা চলবে না। আলেম সমাজকে আজ এ জবাব দিতে এগিয়ে আসতে হবে।
‘তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা দুর্বল, অসহায় নারী ও শিশুদের অবস্থা পরিবর্তন করতে যুদ্ধ করছ না? অথচ ওই শ্রেণীর মানুষেরা কাতর আর্তনাদে ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব, আমাদের এই এলাকা থেকে সরিয়ে নাও। কারণ এখানকার মানুষেরা জালেম। তুমি আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী পাঠাও।’ (সূরা নেতা : ৭৫)
কবি নজরুল বলেন :
‘ইসলাম বলে সকলের তরে মোরা সবাই
সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই
নাহি অধিকার সঞ্চয়ের
কারো আঁখি নীরে কারো ঝড়ে ফিরে জ্বলিবে দীপ
দুজনার হবে বুলন্দ নসিব লাখে লাখে হবে বদনসিব
এ নহে বিধান ইসলামে।
বাংলাদেশে আজ অসহায় সাধারণ মানুষের জন্য প্রথম প্রয়োজন খাদ্য-বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা, পরে নৈতিক মূল্যবোধের তালিম। পক্ষান্তরে ধনীদের জন্য প্রথম প্রয়োজন ইসলামী আদর্শে অর্থ আয় ও ব্যয়ের সঠিক পথ অনুকরণ। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে অর্ধাহারে, অর্ধনগ্ন রেখে সম্পদের স্তূপ গড়ে তোলে, স্ফীত হওয়ার পথে প্রবল বাধা সৃষ্টি করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে তিনভাবে। এক. সাম্রাজ্যবাদী কোনো শক্তি সম্প্রসারণ লালসায় আক্রমণ করে বসলে; দুই দেশের অভ্যন্তরে সৃষ্ট অরাজকতা ও অত্যাচারে কোনো বহিঃশক্তি নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসে দেশ দখল করে নিলে; তিন দেশে এমন মতবাদের লোক থাকতে পারে, যারা ওই মতবাদ প্রতিষ্ঠার অভিলাষে বাইরের কোনো শক্তিকে আমন্ত্রণ জানালে।
বাংলাদেশ নিকট প্রতিবেশীসহ পৃথিবীর সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে বিশ্বাসী। অন্য দেশের প্রতি তার লোলুপদৃষ্টি নেই, অপর কোনো শক্তি এ দেশ করায়ত্ব করুক এও তার কাম্য নয়।
দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা ও নিপীড়ন চললে সাহায্যে এগিয়ে আসাও বিপদমুক্ত করে ফিরে যাওয়ার ইতিহাসে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের উদারতা প্রশংসনীয়। সেদিন এই শক্তি ফিরে না গেলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতো।
বিশেষ কোনো মতবাদে দেশ গড়ার লক্ষ্যে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বিপ্লব ঘটানোর দম্ভোক্তি শোনা গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি পরিণামে কি শোচনীয় বিপর্যয় আনতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ আফগানিস্তান।
স্বাধীনতা রক্ষায় অংশগ্রহণ ইসলামী বিধানে শিশু, অসুস্থ নারী ছাড়া সবার জন্য বাধ্যতামূলক। কাজেই সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব সমধিক হলেও বেসামরিক নাগরিককে দেশরক্ষায় সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ যে পথেই দেমের স্বাধীনতা বিপন্ন হোক, তার মোকাবেলা করতে হবে।
আল্লাহ পাকের ঘোষণা :
‘তোমাদের সাথে যারা যুদ্ধ করতে আসে তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করো। এই যুদ্ধ হবে আল্লাহর পথে, আর এ ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করো না (অর্থাৎ ইসলামী বিধান অমান্য করো না)’। (সূরা বাকারা)
ইসলামের হিফাজত ও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় এই হুকুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফিকাহ শাস্ত্রের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বাদায়ায়েছ ছানায়ে’ বিশিষ্ট ইমাম আলাউদ্দীন আবু বকর ইবনে মাসউদ আলফেসানী বলেন : ‘দেশ শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এই ঘোষণার সাথে সাথে সবার উপর যুদ্ধে অংশগ্রহণ ফরজে আইন তথা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।’ এই দৃষ্টিতে মুসলিম সমাজের সকল নাগরিককে যুদ্ধের প্রয়োজনীয় ট্রেনিং প্রদান করা অপরিহার্য। বাংলাদেশে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিএনসিসির কার্যক্রম আরো ব্যাপক হওয়া প্রয়োজন। আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর কার্যক্রম আরো বিস্তীর্ণ করতে হবে।
দেশের প্রতিরক্ষার ঝাঁপিয়ে পড়ায় কুরআনের আহ্বান :
‘হে ঈমানদার লোকেরা। জিহাদের জন্য তোমরা অস্ত্রধারণ কর। অতঃপর ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অথবা সবাই সম্মিলিতভাবে রওয়ানা হও এবং (শত্রুর উপর) ঝাঁপিয়ে পড়ো।’ (সূরা নিসা)
‘হে বিশ্বাসীগণ! জিহাদের কঠিন মুহূর্তে তোমরা ধৈর্য ধারণ করো। দুশমনের মোকাবেলায় তোমরা দৃঢ়, অটল ও অবিচল থাকো। তোমরা সীমান্ত প্রহরার ব্যবস্থা করো। আল্লাহকে ভয় করো। তোমরাই সফলকাম হবে।’
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন :
‘আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার কামনায় একদিনের সীমান্ত পাহারা পৃথিবীর ও এর সমুদয় সম্পদের চাইতে অধিক মূল্যবান।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ে ইসলামী বিধান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সূরা আনফালে আল্লাহ বলেন :
‘সামর্থে ও উপকরণে যতদূর সম্ভব অধিক দক্ষতা, শক্তি ও সদা প্রস্তুত ‘ঘোড়া’ দুশমনের সাতে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত রাখবে। যেন ঐগুলোর কারণে আল্লাহর শত্রু, তোমাদের শত্রু যাদেরকে তোমরা জানো না, আল্লাহ জানেন, তারা ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকতে পারে। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান প্রদান করা হবে; তোমাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না।’
সেনাবাহিনীকে আল্লাহভীরু মর্দে মুজাহিদ হতে হবে। রোমান সেনাবাহিনীর সাথে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে রোমক সৈন্যের অবস্থা শোচনীয়। এমন সময় রোমকে সেনাপতি গোয়েন্দা পাঠালে ছদ্মবেশে মুসলিম বাহিনীর বীরত্বের মূল রহস্য জানতে। গোয়েন্দারা ফিরে গিয়ে জানাল : ‘হুন বিল লাইলে রুহবানুন ওয়া বিন নাহারে ফুরসানুন- অর্থাৎ মুসলিম সৈন্যরা রাত্র বেলায় তাদের উপাস্য আল্লাহভক্ত বান্দা হিসেবে ইবাদতে কাটায়। আর দিনে অশ্বারোহী বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে।’
এই চরিত্রে বাংলাদেশের সকল সশস্ত্র বাহিনীকে উজ্জীবিত হতে হবে। সেনাবাহিনীসহ দেশের সবাইকে আল্লাহর উপর গভীর আস্থা রেখে দেশে শান্তিশৃৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।
আল্লাহ ইরশাদ করেন :
‘সাহায্য শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে’।
অর্থাৎ আল্লাহ পাক যদি তোমাদের সাহায্য করেন, তবে তোমাদের উপর দুনিয়ার কোনো শক্তিই বিজয়ী হতে পারবে না। আর যদি আল্লাহ তোমাদের তাঁর সাহায্য থেকে বঞ্চিত রাখেন, তবে কে আর তোমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে?
‘তোমরা পরস্পর কলহ-দ্ব›দ্ব বিভেদ সৃষ্টি করো না, মনে রেখো, যদি তোমাদের মধ্যে ঐক্য না থাকে তবে তোমাদের সম্পর্কে দুশমনের মনে যে ভীতি ছিল, তা থাকবে না।’
‘ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর বিধানকে সুদৃঢ়ভাবে অনুসরণ করো; দলাদলি করো না।’
কুরআন শরিফে আল্লাহ আরো ঘোষণা করেন : ‘বলিষ্ঠ ঈমানে উজ্জীবিত হলে তোমরা ১০০ লোক এক হাজার কাফেরের উপর জয়ী হতে পারবে।’
‘উচ্চস্তরের ঈমান ও ধৈর্য থাকলে দশগুণ বেশি দুশমনের ওপর মুসলমান বিজয়ী হতে পারবে।’
শুধু সেনাবাহিনী নয়, আলোচনায় স্পষ্ট করতে চেষ্টা করেছি দেশের আপামর সকলের মধ্যে একটি উজ্জ্বল আদর্শের আলো থাকতে হবে। এই মৌল আকিদা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই শক্তিশালী দেশ তথা বলিষ্ঠ প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলা সম্ভব। এ ব্যাপারে একদিকে যেমন সামরিক, আধা সামরিক, সকল পর্যায়ের অফিসার, কর্মচারী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জাগ্রত ছাত্র সমাজকে কুরআনি আদর্শ ও মহানবী (সা.) ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জাগ্রত ছাত্র সমাজকে কুরআনি আদর্শ ও মহানবী (সা.) এর কর্মবহুল বাস্তব জীবন ইতিহাসের সাথে পরিচিত করে তুলতে হবে, তেমনি মনে রাখতে হবে, যুদ্ধজয়ের জন্য সমর উপকরণই শেষ কথা নয়, সামরিক উপায়-উপকরণ নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দরকার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় মনোবল, কঠোর সংকল্প আল্লাহর প্রতি সুগভীর বিশ্বাস, জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে সুষ্পষ্ট ধারণা। এই বিশ্বাসে সবাইকে সুদৃঢ় হতে হবে। আদর্শিক মজবুতি থাকলে এবং সেই সাথে উপযুক্ত রণসম্ভার, নির্ভুল ও যোগ্য নেতৃত্ব ও ট্রেনিং এবং দেশের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকলে দেশের স্বাধীনতাকে কেউ ধ্বংস করতে পারে না।
অথচ আমরা এ ব্যাপারে সবাইকে অভিজ্ঞ করে তুলতে পারিনি। ভিন্ন মতবাদে আকৃষ্ট দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এবং উদীয়মান ছাত্র-যুবক-শ্রমিকের কাছে ইসলামী আদর্শের মানবিক দিকগুলো তুলে ধরা আজ একান্ত প্রয়োজন। ইষলামী আদর্শের তা বললেই যেমন প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রগতিবিরোধী বুঝায় না, তেমনি ইসলামী আদর্শের সাথে নানা কারণে অপরিচিত থাকার ফলে পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদে অনুরক্ত সুধী ছাত্র-জনতার প্রতি ঘৃণা ও তাদেরকে ঢালাওভাবে ইসলামের দুশমন ভাবা ঠিক হবে না। আমরা বলব, যারা ইসলামী আদর্শে দেশ ও সমাজ গড়ে তোলায় যত্বামন, সচেষ্ট ও আগ্রহী, তাদের উদার হৃদয়ে বাস্তব উদাহরণে প্রমাণ করতে হবে অন্য মতবাদের চাইতে ইসলাম মানবকল্যাণে পূর্ণাঙ্গ বিধান, অধিকতর উপযোগী ও যুক্তিসঙ্গত। যারা ইসলাম সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞান রাখেন তাদের কাছে অনুরোধ, সমাজতন্ত্রের বই, রাষ্ট্রনীতির পাশ্চাত্য মতবাদ পড়–ন কোনো আপত্তি নেই, সেই সাথে কুরআন শরিফের সমাজ রাষ্ট্র ও মানবিক কল্যাণের যে মূলসূত্র আছে সেগুলোও জানতে চেষ্টা করুন। মানবদরদী রাসূল (সা.) তাঁর বাস্তব জীবনে জনকল্যাণধর্মী যে সমাজ গঠন করেছিলেন, সে সম্পর্কেও অবহিত হোন।
বস্তুত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ করে দেশ, দেশপ্রেম, দেশের স্বাধীনতার মূল্য এবং এ বিষয়ে নাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে কুরআন-হাদিস এবং ইসলামের ইতিাহসের উল্লেখ্য ঘটনা জানা থাকলে বাংলাদেশের মানুষ স্বধীনতা রক্ষায় সত্যিকার পথ নির্দেশ পাবে।
রাব্বুল আলামিন আমাদের তৌফিক দান করুন। ইসলামের মানব কল্যাণধর্মী আদর্শে এ দেশ গড়ে উঠক। আমিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।