Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

সিলেটে মনোনয়নে ব্যবসায়ীদের আধিক্য, ঐক্যফ্রন্ট-মহাজোটে প্রার্থীদের মতিগতির সাথে তাল মেলাতে পারছেন না রাজনৈতিকরা

সিলেট ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৮, ৬:৪০ পিএম

সিলেট মহাজোট-ঐক্যফ্রন্টে মনোনীত প্রার্থীদের বেশির ভাগ-ই ব্যবসায়ী। ঠাঁই হয়নি মনোনয়ন দৌড়ে রাজনৈতিকদের। মহাজোটের সিলেট বিভাগীয় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ মনোনয়ন চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। মনক্ষুন্ন হয়েছে তার অনুসারীরা। একইভাবে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন বিএনপি সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা: সাখাওয়াত হোসেন জীবন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন। রাজপথে রাজনীতিতে তারাই দলের শক্তি। নেতাকর্মীদের প্রাণ ভ্রমরা। কিন্তু হেরে গেছেন মনোনয়ন দৌড়ে। একই সাথে ব্যর্থ হয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের ত্যাগী ও বিশ্বস্ত নেতা এডভোকেট আব্দুর রকিব, পারেননি মনোনয়ন লাভে ফুল-টাইম পলিটিশিয়ান জেলা আ‘লীগের সেক্রেটারি শফিকুর রহমান চৌধুরী। তাদের কাতারে রয়েছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সিলেট আ‘মীলীগের পরীক্ষিত অভিভাবক বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তাদের কথা কাজে নির্দেশনায় অনুগত। বিপদে-আপদে ভরসা দিয়ে পাশে থেকে বলিয়ান করেন নেতাকর্মীদের। কিন্তু মনোনয়নে তাদের মূল্যায়ন করেনি মহাজোট বা ঐক্যফ্রন্ট। মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ এই রাজনৈতিকরা ফুল টাইম নেতাকর্মীদের আগলে রাখেন, সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুতে নিরন্তর কাজ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে রাজনীতি-ই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। দলে সরকারে থাকলে ফায়দা যেমন লুটেন বিরোধী দলে গেলে হয়রানীর চরম ঝাঁপটায় বিপর্যস্ত হন তারা। মামলা, কারাবরণ-সহ সার্বক্ষণিক ঝুঁকিতে পার করেন তাদের যাপিত জীবন। সেকারনে এইসব নেতাদের চুড়ান্ত স্বপ্ন থাকে সংসদ পর্যন্ত পৌছার। কিন্তু এবারও তারা মনোনয়ন বঞ্চিত। টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীরা নিলামে নিয়ে গেছে তাদর নির্বাচনের স্বপ্নের টিকেট ! এমন আফসোস এখন তাদের মধ্যে। কোন ধরনের পট-পরিবর্তন হলে, মনোনয়ন প্রাপ্ত ব্যবসায়ীরা থাকবেন নিরাপদে, দলের মধ্যে জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে। নেতাকর্মীদের পাশে থাকার কোন চিন্তাই থাকবে না তাদের মন-মগজে। রাজনীতির দরজা বন্ধ করে, ব্যবসার দুয়ার প্রশস্ত করবেন সরকার বা বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের আঁতাত করে।

কিন্তু রাজনৈতিকরা পড়ে থাকবেন মাঠ রাজনীতির কঠিন পরীক্ষায়। দলীয় কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামলেই প্রশাসনের রক্তচুক্ষ সহ হামলা মামলা কপালে জুটবে তাদের ভাগ্যে। বিপন্ন হয়ে উঠে তাদের জীবন। লন্ডভন্ড হয় যাবে সাজনো গোছানো সকল আশা ভরসা। তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের ঘাড়ে পড়বে মামলার পাহাড়। বাস্তবতার সকল ঝুঁকি নিয়ে তারা পথ চললে, তাদের অবস্থা যেন কলুর বদল। চলমান মনোনয়ন প্রদান ঘটনার মধ্যে দিয়ে তাদের অবস্থান হয়ে উঠছে, তারা শুধু ব্যবহার হবেন রাজনীতির নামে। রাজনীতির চরম প্রাপ্তি এমপি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ বঞ্চিত হয়ে থাকতেই হবে তাদের। তাে
দর মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে সংসদে যাবেন দলের নির্বাচিত এমপিরা। সেই এমপিদের সাথে থাকবে রাজনীতির বাস্তবতার কঠিন ফারাক। তারপরও মেনে বা মানিয়ে নিতে হচ্ছে তাদের। দলের মাঠের পালর্স নিয়ে বুঝাপাড়ায় থাকবে মতানৈক্য। ব্যবসায়ী এমপিরা ব্যস্ত থাকবে ব্যবসার পসরা সুসংহত করতে, দলের সাংগঠনিক ভিত্তি সুরক্ষায় তারা মনোযোগী হবেন না। পারলে নিজ বলয়ের অনভিজ্ঞ লোকদের চাইবেন কমিটিতে স্থান করে দিয়ে, কমিটি নিয়ন্ত্রিত রাখতে।
সিলেট-১ (সদর-সিটি কর্পোরেশন)আসনে অর্থমন্ত্রী আব্দুল মাল আব্দুল মহিতের ভাই. ড.একে অব্দুল মোমেন আ‘লীগের প্রার্থী। বর্ণাঢ্য প্রফেশনাল ক্যারিয়ার থাকলেও রাজনীতিতে তার থলি শূন্য। দলের স্বার্থের চেয়ে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা বজায়ে তিনি থাকবেন তৎপর। সুবিধাভোগী অরাজনৈতিক একটি শ্রেণী তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু তাদের অপকর্মের দায়ভার পড়বে দল ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের উপর। ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। রাজনীতিতে তিনি একেবারে নবীন। নিজস্ব বলয় রয়েছে তার। কিন্তু বিএনপির টোটাল রাজনীতিতে তিনি অর্জন করতে পারেননি আস্থা । বয়সে তরুণ এই ব্যবসায়ী রাজনৈতিক, রাজনীতির বিবেচনায় মনোনয়ন লাভ করেনি এ নিয়ে দলে চলছে গুঞ্জন। সেকারনে দলের সিনিয়র পরীক্ষিত নেতারা তার উপর চমর নাখোশ। তাকে নিয়ে চলমান রয়েছে ‘ইগো‘ গত প্রবলেম। তাকে মানিয়ে বা মেনে নিতে পারছেন না দলের বেশিরভাগ সিনিয়র প্রভাবশালী নেতা। তারা মূলত মনে করছেন দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের চ্যালেঞ্জ করেই মনোনয়ন ছিনিয়ে এসেছেন তিনি । সেকারনে মুক্তাদিরের শেষ দেখার নীরব অপেক্ষা করছেন তারা।
সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসানীনগর) আসনে সার্বিক বিচারে তুলনামূলক এক রাজনৈতিক চরিত্রকে মনোনয়ন দিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। সেই প্রার্থী নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসনিা রুশদি লুনা, কর্মী-সমর্থক সহ দলের নিকট ভরসাপূর্ণ তিনি। মহাজোটের প্রার্থী জাপার ইয়াহিয়া চৌধুরী এহিয়া, লাঙ্গলের করুন অবস্থা তার আসনে। তিনি মূলত যুক্তরাজ্য প্রবাসী এক ব্যবসায়ী। বাইচান্স এমপি হওয়ার সুযোগ পান, স্থানীয় আ‘লীগের দুই চৌধুরীর আধিপত্য কেন্দ্রিক দ্বন্দ্বে। লুনা নির্বাচনে পরাজিত হলে মাঠেই থাকবেন, কিন্তু মহাজোট প্রার্থী পরাজিত হলে তার খোঁজ পাওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাহলে অসহায় হয়ে পড়বে তার কর্মী সমর্থকরা । কিন্তু মনোনয়ন না পেলে মনোনয়ন প্রত্যাশী আ‘লীগের শফিকুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও মাঠ ছেড়ে থাকার উপায় নেই। সরকারে থাকলে নিরাপদে থাকবেন, না হলে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে পারেন তারা।

সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জ) আসনে মহাজোটের এমপি হয়েছেন যুক্তরাজ্য ও দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী। তার সাথে মনোনয়ন যুদ্ধে ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, দক্ষিণ সুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান আবু জাহিদ, রাজনৈতিক হাবিবুর রহমান হাবিব। এ রাজনৈতিকের বদলে মনোনয়ন লাভ করলেন তৃতীয়বারে মতো ব্যবসায়ী মাহমুদ-উদ-সামাদ চৌধুরী। জিতলে তো মাঠে থাকবেন, কিন্তু পরাজিত হলে চড়াই উৎরাই সব ঘষা খাবেন মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থী ও দলের নেতাকর্মীরা। এমপির দেখা মিলবে কি না তা নিয়ে সন্দেহের শেষ নেই। বিএনপির একাধিক রাজনৈতিক প্রার্থীকে পেছনে পেলে মনোনয়ন লাভ করেছেন শীষ ব্যবসায়ী শফি আহমদ চৌধুরী। সব আমলই তিনি অভিজাত। ১০বছরের বিএনপির রাজনীতির কঠিন সময়েও তিনি ছিলেন নিরাপদ। কিন্তু তারপরও ত্যাগীরা মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যবসায়ী শফি পেয়ে গেলেন টিকেট। নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয় হলেও শফিকে পাওয়া যাবে নিজ বলয়ের কল্যানার্থে। না হলে শফি চল যাবেন, মাঠ ছেড়ে আয়েশের নিরাপদ জীবনে। কর্মী-সমর্থকরা ঘষা খেয়ে বিপন্ন হলেও খেয়াল রাখার কেউ থাকবে না।
সিলেট-৪ কোম্পানীগঞ্জ-গোয়াইনঘাট-জৈন্তা) আসনে ভাগ্যবান প্রার্থী মহাজোটের ইমরান আহমদ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন তার। এমপি হয়ে বিশেষ বদৌলতে। রাজনীতিতে সেই মাপের কোন পরিচয় নেই তার। পরাজিত হলে দলের নেতা কর্মীরা নিজকেই সামলে নিয়ে আগামী দিন মোকাবেলা করতে হবে। বিএনপির প্রার্থী দিলদার হোসেন সেলিম। সেলিমের পরিচয়- অবস্থান এই আসনে বিশাল। রাজনীতি-ই তার ধ্যান-জ্ঞান। জয় বা পরাজয়ে কর্মী সমর্থকদের সাথে নিয়েই সামনে থেকে মোকাবেলা করবেও তিনি।

সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনে দেশের প্রখ্যাত শিক্ষা ব্যবসায়ী হাফিজ আহমদ মজমুদার আওয়ামীলীগের প্রার্থী (সাবেক এমপি)। রাজনীতি নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে রয়েছে তার ব্যাপক গ্রহণযোগ্য পরিচিতি। তিনি পরাজিত হলে, মাঠ ছেড়ে চলে যাবেন এটাই বাস্তবতা। কর্মী-সমর্থকরা কঠিন পরিস্থিতি নিজেই মোকাবেলা করতে হবে। মূলত অভিভাবকহীন হয়ে উঠবে দল। দলের তৃণমূলের প্রার্থী রাজনৈতিক মাসুক আহমদ মনোনয়ন পাননি। অথচ তৃণমূলে দলের এক অভিভাবক ছিলেন তিনি। ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হয়েছেন জমিয়তের উবায়দুল্লাহ ফারুক। নেহাত সাদা সিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। রাজনীতির কঠিন চালে অনভিজ্ঞ। প্রশাসনিক ডিলিংয়ের বাস্তবিক দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। সেখানে জামায়াতের সাবেক এমপি রাজনৈতিক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী মনোনয়ন পেলে ভোট রাজনীতি প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ হয়ে উঠতো। পরাজিত হলেও নেতাকর্মীদের আগলে রাখার সামর্থ্য ছিল তার ।

সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনে মহাজোটের প্রার্থী শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি। আগামী দিনে রাজনীতি বা নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার মতো শারীরিক ও মানসিক শক্তি দোলাচালে থাকবে। তারপরও একান্ত পরাজিত হন তাহলে দলের নেতাকর্মীদের সাথে সম্পর্ক থাকবে তার। দেশ বরেণ্যে প্রাজ্ঞ এই রাজনৈতিক সিলেট বাসীর জন্য গর্ব। রাজনীতিই তার ধ্যান-জ্ঞান। রাজনীতিতে পরীক্ষিত এক অনুসরনীয় চরিত্র তিনি। জিতলেও থাকবেন, হারলে ও থাকবেন মাঠে ছায়ার মতো। পক্ষান্তরে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ফয়সল আহমদ চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ভোট রাজনীতি বা মাঠ রাজনীতিতে তিনি অনেকটা নবাগত। গত ১০ বছর রাজনীতিতে ত্যাগের বদলে ব্যবসায় মনোযোগী হয়ে গড়েছেন বিত্ত-বৈভব। কিন্তু যারা মাঠ রাজনীতিতে পোড়া খেয়েছে,ঘরবাড়ি ছেড়ে মামলার পাহাড় ঘাড়ে নিয়ে দলের কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছে তাদের কপালে জুটেনি দলের মনোনয়ন। সব মিলিয়ে মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীদের সাথে তৃণমূল বা দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের নির্বাচনী কাজের বিস্তর ফারাক লক্ষণীয়। রাজনৈতিকরা যেখানে পাওয়ার পলিটিক্সের প্রভাব কাটিয়ে মাঠকে নিজেদের অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করে সফল হন, সেখানে মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থীরা চরম আপোষকামী। চিন্তা চেতনার বিস্তর দূরত্ব নিয়ে এই প্রার্থীরা দলের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা কতটুকু আদায়ে সমর্থ হন তা এখন দেখার বিষয়। একজন রাজনৈতিকের কাছে অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের যে প্রতিশ্রুতিতে কর্মী-সমর্থকরা আস্থাশীল হয়ে মনোবলে বলিয়ান হয়ে উঠেন, তার কোন কিছুই আশা করা যাচ্ছেনা দল মনোনীত এসব প্রার্থীদের উপর। সেকারনে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন দলের কর্মী সমর্থকরা।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ