হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই কবে পদ্য রচনা করেছিলেন, ‘চল্ চল্ চল্/উর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল/নি¤েœ উতলা ধরণী তল/অরুণ পথের তরুণ দল/চল্রে চলর্ েচল্।’ কবির এই আহ্বান যুগে যুগে তরুণদের উদ্বেলিত, উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করেছে। হতাশাকে উড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছে। তরুণদের আশা সঞ্চারণী এবং তেজোদীপ্ত এমন আহ্বান বাংলা সাহিত্যে খুব কমই হয়েছে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ একটু ভিন্নভাবে লিখেছিলেন, ‘ওরে নবীণ ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘাঁ মেরে তুই বাঁচা।’ তিনি মরার আগে যারা আধামরা হয়ে আছে, তাদের জাগিয়ে তুলতে নবীণদের এই আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর নজরুল উপলব্ধি করেছিলেন, তরুণদের উদ্দীপ্ত করতে না পারলে জাতি কোনো দিনই এগিয়ে যেতে পারবে না। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না, তাড়াতেও পারবে না তাদের। তিনি অস্ত্র-গোলাবারুদ নয়, তরুণদের তারুণ্য জাগিয়ে তুলতে ছন্দবহু কবিতার অমীয় সুধা বেছে নিয়েছিলেন। তরুণদের অন্তরে এই সুধা ঢেলে দিয়েছিলেন। আমরা যদি আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকাই, তবে দেখব, বাংলাদেশের মূল শক্তি হয়ে রয়েছে নজরুলের সেই চির তরুণ দল। এমন তরুণ ও তারুণ্য এই উপমহাদেশ তো বটেই উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ তারুণ্য সঙ্কটে ভুগছে। তারা উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে তরুণদের আমদানি করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে তারুণ্য উপচে পড়ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের ইউএনডিপি তার এক প্রতিবেদনে এমন কথাই বলেছে। ‘শেপিং দ্য ফিউচার : হাউ চেঞ্জিং ডেমোগ্রাফিকস ক্যান পাওয়ার হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ এখন তরুণদের দেশ। তারুণ্যে ভরপুর। দেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। কর্মক্ষম মানুষ আছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলা হয়েছে আগামী ১৫ বছরে, অর্থাৎ ২০৩০ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। আর দেশে বয়স্ক বা ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। ২০৩০ ও ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১২ ও ২২ শতাংশে। তার অর্থ হচ্ছে, তরুণের সংখ্যা দুর্বার গতিতে বৃদ্ধি পাবে, আর প্রকৃতির নিয়মে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা কমতে থাকবে। বলা যায়, বাংলাদেশ তারুণ্যে ঝলমল একটি দেশ। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঝলমল কতদিন টিকে থাকবে? যদি তরুণদের তারুণ্য যথাসময়ে যথাযথভাবে কাজে লাগানো না যায়, তবে একটা না একটা সময় তা থিতিয়ে আসবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘আধমরা’য় পরিণত হবে। বিশ্লেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যদি এই তরুণদের কাজে লাগানো না যায়, তবে তাদের তারুণ্য আগামী ৩০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকবে। তারপর বুড়িয়ে দেশের বোঝায় পরিণত হবে। এখন মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন হচ্ছে, আমরা এই তরুণদের কীভাবে এবং কতটা কাজে লাগাতে পারছি বা পারব? নাকি তাদের এভাবেই রেখে দেব?
দুই
বর্তমান সরকারের সময় অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে বেশ গর্ব করতে আমরা দেখি। এ নিয়ে শাসক দলের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। তার অনুকূলে বিদেশের কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তো কথাই নেই। আমাদের সাফল্য, আমাদের সাফল্য বলে কান ঝালাপালা করে ফেলে। অথচ দেশের এই যে বিশাল তরুণ জনসংখ্যার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। বলতে শুনিনি, এটা আমাদেরই সাফল্যের কারণে হয়েছে এবং এই তরুণদের তারুণ্য আমরা কাজে লাগাব। অবশ্য সরকারের এ নিয়ে নিশ্চুপ থাকার কারণ রয়েছে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই তো কর্মসংস্থানের বিষয়টি এসে পড়বে। এই বিশালসংখ্যক তরুণের বেশিরভাগ বেকারের কর্মসংস্থানের কথা বলে বিপাকে পড়বে নাকি! তার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো। সরকার ভালো করেই জানে, সে দেশে যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেনি। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস-ই কিছুদিন আগে বলেছে, যেখানে বছরে ১৩ লাখ কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সেখানে গত দুই বছরে হয়েছে মাত্র ৬ লাখ। অর্থাৎ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দূরে থাক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। বিবিএস এ কথাও বলেছে, গত দেড় দশকের মধ্যে বেকারের সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি। বেকারের মধ্যে ৭৪ শতাংশই তরুণ-তরুণী। সরকারের সামনে এই পরিসংখ্যান যেখানে জ্বলজ্বল করছে, সেখানে ইউএনডিপির প্রতিবেদন নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কোনো কারণ নেই। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা তারুণ্যে সয়লাব হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ নিয়ে গর্ব করতে পারি। কারণ আমাদের কর্মসংস্থান করার কোনো ক্ষমতা নেই। আমরা কেবল বলতে পারি, এই তারুণ্য কাজে লাগাতে হবে। তবে বললেই তো হবে না, যে সরকারের দায়িত্ব এদের কাজে লাগানো, সেই তো ভালো জানে সে কতটা অক্ষম। ক্রিকেটে দর্শক সবসময়ই ব্যাটসম্যানের কাছে প্রত্যাশা করে সে চার-ছক্কার বন্যা বইয়ে দিক। দর্শক এটা বুঝতে চায় না, যে ব্যাটসম্যানের কাছে এই প্রত্যাশা, সেই না ভালো জানে চার-ছক্কা মারা কতো কঠিন! চার-ছক্কা মারতে পারলে তো তারও আনন্দ লাগে। এ আনন্দ দর্শকের আনন্দের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। দর্শকেরও মাথায় রাখা উচিত, চার-ছক্কা এমন ব্যাটসম্যানের কাছেই প্রত্যাশা করতে হবে, যে সত্যিকারের ব্যাটসম্যান। দশ নম্বর ব্যাটসম্যান যিনি মূলত বোলার এবং কদাচ ব্যাট করেন, তার কাছ থেকে চার-ছক্কা আশা করা একটু বেশি প্রত্যাশাই হয়ে যায়। মাঠে খেলা আর গ্যালারি বা টেলিভিশনের সামনে বসে খেলা দেখা এক কথা নয়। হ্যাঁ, অবশ্যই যারা ক্রিকেট খেলে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতা দিয়ে ক্রিকেটার হতে হয়। তাদের লক্ষ্যই থাকে দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ করা। দর্শকের প্রত্যাশা পূরণ তারা তখনই করতে পারে, যখন খেলাটা খেলার জন্য তারা যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করে। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দক্ষতা ও যোগ্যতায় ঘাটতি থাকলে, কোনো সরকারের পক্ষেই সঠিকভাবে দেশ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আমরা বলছি না, বর্তমান শাসক দলের সবক্ষেত্রে দক্ষতা-যোগ্যতার অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সাফল্য রয়েছে। তবে যে জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি দক্ষতা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখার দরকার, সে জায়গাটায় যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতির দিকে যদি আমরা তাকাই, তবে দেখব সেখানে প্রকৃত উন্নতির চেয়ে শ্লোগানের উন্নতি অনেক এগিয়ে। এর মাঝে বিরাট শুভঙ্করের ফাঁকি লুকিয়ে আছে। এই ফাঁকিঝুঁকি নিয়েই শাসক দলের পক্ষ থেকে এক ধরনের ফাঁকা বুলি আওড়ানোর প্রবণতা রয়েছে। এই বুলি বিশালসংখ্যক বেকারের কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটার মতো মনে হওয়া স্বাভাবিক। তারা প্রশ্ন করতেই পারে, দেশে লাখ লাখ বেকারের বোঝা নিয়ে অর্থনীতি উন্নতি হচ্ছে কিভাবে? ইউএনডিপির প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশ বেকার। যুব জনগোষ্ঠীর একটি অংশ মা-বাবার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এরা কাজ চায়। না পেলে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এটাই তো বাস্তবতা! কোনো তরুণ কি চায় সে মা-বাবার বেকার ছেলে হয়ে থাকুক? বেকারত্বের অসম্মানজনক জীবনযাপন করুক? আমরা প্রতিনিয়ত সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলি। এই কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশকে অর্থনীতিতে ‘এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার’ হিসেবে অহরহ বলা হতো। সে সময় এ কথাও শোনা গেছে, এখন আর বাসা-বাড়িতে কাজ করার মতো কোনো লোক পাওয়া যায় না। বাসা-বাড়িতে চাকর-বাকরের কাজ কেউ করতে চায় না। এর যুক্তিও ছিল। বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্প যেভাবে প্রসারিত হয়েছিল, তাতে একজন অনভিজ্ঞ কাজের লোকও সেখানে চাকরি পেয়ে যেত। তারা বাসা-বাড়ির দাসত্ব থেকে সম্ভাবনাময় চাকরিকেই প্রাধান্য দিত। একের পর এক গার্মেন্ট শিল্প প্রতিষ্ঠার কারণে দেশের বেকারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতে পরিণত হওয়া এই গার্মেন্ট শিল্পে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর কর্মজীবীরা বেকার হয়ে পড়ছে। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত দুই বছরে ১৬৯৩টি কারখান বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক ও কর্মকর্তা বেকার হয়েছে। তারা এসে যুক্ত হয়েছে, চাকরি প্রত্যাশী বেকারের মিছিলে। অর্থনীতির অন্যতম বড় একটি স্তম্ভ জনশক্তি রপ্তানি খাত। এই খাতটিও এখন করুণ দশায় উপনীত। জনশক্তির সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই রপ্তানি সর্বকালের সর্বনি¤œ পর্যায়ে পৌঁছেছে। কোনো কোনো দেশ লোক নেয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেশগুলোতে সফর করেও আশাজনক উন্নতি হয়নি। আমরা এ কথাও জানি, সরকারি পর্যায়ে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো নিয়ে সরকারের উল্লাসের রেশ কাটতে না কাটতে মালয়েশিয়া সরকার লোক নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এসব শ্রম বাজার খুলবে খুলবে করেও খুলছে না। বাংলাদেশে বেকারদের কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান এই দুইটি খাতে যখন কর্মসংস্থান হওয়ার পরিবর্তে উল্টো বন্ধ হচ্ছে এবং বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন আমরা কীভাবে আশা করি, অর্থনীতিতে শনৈশনৈ উন্নতি করছি।
তিন
সরকারের তরফ থেকে আমাদের দেশে মাথাপিছু আয় বছরে ১৪৬৬ ডলার বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ঘোষণা নিয়েও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। মাথাপিছু আয়ের এ হিসেব ধরলে দেখা যায়, ষোলো কোটি মানুষের প্রত্যেকের মাসে গড় আয় ৯ হাজার ৭৭৩ টাকা। এরমধ্যে যে আয় করে না বা বেকার তার আয়ও রয়েছে। আবার একটি পরিবারের লোকসংখ্যা যদি পাঁচ জনও হয় এবং একজন কর্মজীবীসহ যারা বেকার, তবে সেই পরিবারের মাসে আয় দাঁড়ায় ৪৮ হাজার ৮৬৬ টাকা। এ হিসেবে তো বাংলাদেশে কোনো দরিদ্র ও ভাসমান পরিবার থাকার কথা নয়। প্রত্যেকটি পরিবারই যথেষ্ট সচ্ছল হওয়ার কথা। বেকারত্বের তো প্রশ্নই উঠে না। অথচ সরকারের হিসেবেই দেশে বেকারের সংখ্যা লাখ লাখ আর বেসরকারি হিসেবে কয়েক কোটি। ফলে মাথাপিছু আয়ের এ হিসাব যে একটা জাজ্বল্যমান শুভঙ্করের ফাঁকি, তা পাঠক মাত্রই বুঝতে পারছেন। ইউএনডিপির প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যারা কর্মজীবী তাদের শতকরা ৮০ ভাগ প্রতিদিন উপার্জন করেন ৩১৩ টাকা। মাসে ৯৩৯০ টাকা। একজন কর্মজীবী, যার সংসারে তিন জন সদস্য রয়েছে, তার পক্ষে কি এই আয় দিয়ে মৌলিক চাহিদা পূরণ করে জীবনযাপন করা সম্ভব? শহরের একজন কর্মজীবীর কথা চিন্তা করলে তো তা অকল্পনীয় ছাড়া কিছু মনে হওয়ার কথা নয়। তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে যে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও অর্থনীতির উন্নতির কথা বলা হচ্ছে, তা ঠিক না বেঠিক, তা বোধ করি পাঠকদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি নিয়েও রয়েছে নানা ধরনের হিসাব। সরকার চলতি অর্থ বছরে জিডিপি ৭.০৫ শতাংশ হয়েছে বলে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে এবং এ জন্য তার প্রধান প্রতিপক্ষকে দোষারোপ করে বলেছে, তারা জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন না করলে আরও আগেই এই জিডিপি অর্জন করা যেত। এতদিনে সাড়ে ৭ শতাংশও ছাড়িয়ে যেত। অথচ বিশ্বব্যাংক বলেছে, জিডিপি হবে ৬.৮ শতাংশ। দেশি-বিদেশি অন্যান্য সংস্থাগুলোও এরকমই আভাস দিয়েছে। তাহলে তো বলতে হয়, শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলই নয়, এসব সংস্থাও সরকারের বিরোধিতা করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব সংখ্যাতাত্ত্বিক জিডিপি দিয়ে দেশের উন্নয়নের কথা বলা অনেকটা ধাপ্পাবাজির ব্যাপার। আবার অনেকে বলছেন, ফ্লাইওভার বা বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প দেখিয়ে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরলেই প্রকৃত উন্নয়ন বোঝায় না। প্রকৃত উন্নয়ন সেটাই যেখানে অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য থাকে। ব্যাপকহারে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষের হাতে স্বচ্ছন্দে চলার মতো অর্থ থাকে। বলাবাহুল্য, দেশে এখন এ পরিস্থিতি নেই। সরকারকে ঘিরে থাকা একটি শ্রেণী বা এর বাইরে কিছু মানুষের হাতে অগাধ অর্থকড়ি থাকাকে যদি সরকার মানুষের উন্নতি হয়েছে বলে মনে করে, তবে বলার কিছু নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের বেশিরভাগ কর্মজীবী যে বেতন পায়, তা দিয়ে নিজের ও পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে পারছে না।
চার
বাংলাদেশের সম্ভাবনা অফুরন্ত। এদেশে সম্পদের অভাব নেই। সবচেয়ে বড় সম্পদ দেশের মানুষ। একটা সময় বিপুল জনসংখ্যাকে দেশের বোঝা মনে করা হতো। এখন এই জনসংখ্যা বিশেষ করে তরুণ শ্রেণী দেশের অমীত সম্ভাবনা হয়ে দেখা দিয়েছে। তাদের উদ্যম এবং উন্নয়নের তাকিদ গার্মেন্টস শিল্পসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার আজ যে রেমিট্যান্স নিয়ে গর্ববোধ করছে, তা উদ্যমী তরুণদের বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের কারণেই হয়েছে। আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি, তরুণরা প্রতিষ্ঠা লাভ করার জন্য কী স্পৃহা নিয়ে ছুটে চলেছে! তাদের বেশিরভাগই পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তাদের এই পথ সৃষ্টি করার মূল দায়িত্ব যে সরকারের, সে সরকার তা করে দিতে পারছে না। দেশে যে স্বাভাবিক কর্মসংস্থান থাকার কথা, তাও টিকিয়ে রাখতে পারছে না। কর্মসংস্থানের পথ যদি ক্রমেই সঙ্কুুচিত হয়ে আসে, তাহলে এ বিপুল বেকার তরুণরা কী করবে! তাদের হতাশ হয়ে নুয়ে পড়া ছাড়া কি আর কোনো গতি থাকতে পারে? এর ফলে কি আমরা ক্রমেই একটি হতাশ জাতিতে পরিণত হতে যাচ্ছি না? এ কথা তো সবসময়ই বলা হয়, যে জাতির তরুণ সমাজকে উজ্জীবিত করা যায় না, হতাশার সাগরে ভাসতে হয়, সে জাতি কোনো দিন এগিয়ে যেতে পারে না। জাতিকে উজ্জীবিত করার দায়িত্ব যে সরকারের সে সরকারই যদি বাস্তব পরিস্থিতি আমলে না নিয়ে ফাঁকা বুলি আউড়িয়ে নিজেই উজ্জীবিত হয়, তবে সে জাতির দুঃখ মোচনের আশু কোনো সম্ভাবনা থাকে না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে যেন এ ঘটনাই ঘটে চলেছে। আমাদের কথা হচ্ছে, সরকারকে দেশের বাস্তব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নজর দিতে হবে। কথার ফুলঝুরি না ছড়িয়ে, অসার আশার বাণী না শুনিয়ে প্রকৃত উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে। দেশের যে অমিত সম্ভাবনার তরুণ শ্রেণী, তাদের কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটি শ্রেণীর উন্নয়নের দিকে না তাকিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উন্নতির চিন্তা করতে হবে। বিনিয়োগ সঙ্কটের সমাধান, বিদ্যমান কর্মসংস্থান ধরে রেখে বিপুলসংখ্যক তরুণের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে উপলব্ধি করতে হবে, দেশের মানুষই যদি ভালো না থাকে, তবে অর্থনীতির যত উন্নতির কথাই বলা হোক না কেন, তা কোনো কাজে আসবে না। উন্নতির ফানুস উড়িয়েও কোনো লাভ হবে না। একটা সময় এই ফানুস যে চুপসে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।