বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মহান রাব্বুল আলামিন বৈধ ও পবিত্র বস্তু ভক্ষণ করা এবং সৎপথে জীবিকা অর্জন করার প্রতি কুরআনুল কারিমে বারবার তাকিদ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে, তোমরা তা আহার করো এবং কোনোক্রমেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা আল বাকারাহ : আয়াত ১৬৮)।
এই আয়াতে কারিমায় বৈধ ও পবিত্র বস্তুসমূহকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ করা হয়েছে। সৎপথে ও ন্যায়ানুগ পন্থায় সে সকল জীবিকা অর্জন করা হয়, তা বৈধ ও হালাল। কিন্তু অসৎ পথে ও অবৈধভাবে অর্জিত বস্তু নিশ্চয়ই হারাম। অসৎ পথে জীবিকা অর্জন করা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করার শামিল। তাই মহান আল্লাহপাক শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন এবং এর মাধ্যমে অসৎ পন্থায় জীবিকা অর্জনের পথও নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছে।
সৎভাবে জীবিকা অর্জনের গুরুত্বকে তুলে ধরে পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এই দুনিয়া শ্যামল সুন্দর, যে তাতে সৎপথে সম্পদ অর্জন করে এবং তা ন্যায়ভাবে ব্যয় করে, আল্লাহপাক তাকে এর সওয়াব দান করেন এবং বিনিময়ে তাকে জান্নাতে পৌঁছে দেন। তার যে ব্যক্তি দুনিয়াতে অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করে এবং অন্যায়ভাবে তা ব্যয় করে, আল্লাহপাক তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করিয়ে দেন।
আর অনেক ব্যক্তি অন্যায়ভাবে আল্লাহ ও তার রাসূলের সম্পদ আত্মসাৎ করে, তবে পরকালে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম। (বায়হাকি : শোয়াবুল ঈমান)। এই হাদিস জীবিকা ও সম্পদ ন্যায় ও সৎভাবে অর্জন করার এবং ন্যায় ও মঙ্গলকর কাজে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। এর বিপরীত পন্থা খুবই গর্হিত ও নিন্দনীয় পন্থা, যা মানুষকে দুনিয়ার জীবনে অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেয় এবং পরকালে জাহান্নামের বাসিন্দা হতে বাধ্য করে।
তা ছাড়া এতিম, মিসকিন ও দুঃস্থদের মাল-সম্পদ আত্মসাৎ করাও মহাপাপ। যার পরিণতি জাহান্নামে গমন ছাড়া কিছুই নয়। এই পৃথিবীতে সৎপথে জীবিকা অর্জনের সহজতর পথের পরিচয় পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় উম্মতদের সামনে তুলে ধরেছেন। জীবিকা অর্জনের হাজারো পথ এবং তরিকা রয়েছে।
তবে সহজভাবে কেমন করে ন্যায় ও মঙ্গলকর পথটি বেছে নেয়া যায়, এর প্রতি দিকনির্দেশনা প্রদান করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, (১) ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার ধর্মকে পরিপূর্ণ, সুঠাম ও সংশোধন করে দিন, যা আমার সকল কাজ-কর্মকে পবিত্র করবে।’ (২) ‘আপনি আমার পার্থিব দুনিয়ার ব্যাপার ও কর্মকান্ডসমূহ সুঠাম ও সুগঠিত করে দিন, যেগুলোতে আমার জীবিকা রয়েছে।’ (৩) ‘আপনি আমার পরকালকে সুন্দর ও সুঠাম করে দিন, যেখানে আমাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে, প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’ (৪) ‘আপনি আমার হায়াতকে কল্যাণ, মঙ্গল ও নেক আমলের জন্য বৃদ্ধি করে দিন এবং (৫) আমার মৃত্যুকে সকল প্রকার অনিষ্ট বেদনা থেকে আরামদায়ক করে দিন।’ (সহিহ মুসলিম)।
এই হাদিসে জীবন পরিক্রমার পাঁচটি স্তরের কল্যাণ ও মঙ্গলের লক্ষ্যে পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রার্থনা ও মুনাজাত বিবৃত হয়েছে। জীবন চলার পথে এই পাঁচটি অধ্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। এগুলোর সবকটিই একটির সাথে অপরটি গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এর একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির পরিপূর্ণতা কল্পনা করা যায় না।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই হাদিসে মৃত্যুকে সকল অনিষ্ট হতে আরামদায়ক করার প্রার্থনা করা হয়েছে। এই প্রার্থনা সকল মানুষেরই করা উচিত। তবে ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করা এক শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এই নেয়ামত লাভের অর্থ সুপ্রশস্ত করে তোলে সৎপথে উপার্জিত জীবিকা। প্রকৃতপক্ষে যারা অসৎ পথে জীবিকা অর্জন করে তারাই দুনিয়াদার।
হাদিসে আছে ‘দুনিয়াদার লোকেরা স্বাভাবতই গোনাহ হতে রক্ষা পেতে পারে না।’ (বায়হাকি)। তাই তাদের মৃত্যু কোনোক্রমেই আরামদায়ক হয় না। তা ছাড়া উল্লিখিত হাদিসে কল্যাণ ও মঙ্গলকর্ম সম্পাদনের জন্য দীর্ঘায়ু লাভের কামনা করা হয়েছে। এই পৃথিবীতে মানুষ দীর্ঘকাল বেঁচে থাকলে অধিকহারে পুণ্য কর্ম করার সুযোগ যেমন পায়, তেমনি বদ আমলও বেশি করার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু তাই বলে, নেকির পরিবর্তে গুনাহকে যারা অবলম্বন করে তারা প্রকৃতই অকৃতজ্ঞ ও অভিশপ্ত। তাদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে আল্লাহর পক্ষ হতে কোনো পুরস্কারের ব্যবস্থা নেই। আবার পরকালে প্রত্যাবর্তন অবশ্যম্ভাবী। সেখানে নেক ও বদ আমলের জন্য সকলেরই ফল ভোগ করতে হবে।
আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা প্রত্যক্ষ করবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও প্রত্যক্ষ করবে।’ (সূরা যিলযাল : আয়াত ৬-৭)। মূলত, দুনিয়ার জীবনে অসৎ পন্থায় জীবিকার্জনের দ্বারা নিজেকে ক্লেদাক্ত ও কলুষিত করে তুললে পরকালের সুন্দর ও মনোহর প্রত্যাবর্তনস্থল কামনা করা বাতুলতা মাত্র। শুধু তা-ই নয়, সৎভাবে অর্জিত জীবিকার নির্যাস হয় মঙ্গল ও কল্যানের ধারক ও বাহক।
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘বিশ্বস্ত সত্যবাদী মুসলমান ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহীদদের সঙ্গী হবে।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম)। সর্বোপরি ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয়গ্রহণকারী ব্যক্তি অসৎপন্থায় জীবিকার্জনের লক্ষ্যে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে না। ইসলাম ধর্মে যে সব কাজের অনুমোদন নেই, ধার্মিক মুসলমান ব্যক্তি কোনো কালেই সেগুলোকে সমর্থন করেন না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।