Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

খুলনায় পাট গুদামে ১০ বছরে ২২০টি অগ্নিকান্ড

প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এটিএম রফিক/আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : খুলনার দিঘলিয়ায় জুট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে অন্তত এক হাজার ২০০ টন পাটপণ্য পুড়ে গেছে। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় লাগা আগুন চার ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে আসে। মিল কর্তৃপক্ষর দাবি, প্রাথমিকভাবে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুধু এটাই নয়; গত ১০ বছরে খুলনায় অন্তত ২২১টি ছোট-বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাটের গোডাউনে মজুদ করার আগে ফায়ার সার্ভিসের কিছু বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানছে না ব্যবসায়ী, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ও খোঁদ ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও। ফলে প্রতিবছর পাটের গোডাউনে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্সের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হচ্ছে। এমনকি এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের ওয়্যার হাউস ও ওয়ার্কশপ লাইসেন্স গ্রহণ ও নিয়মাবলি মেনে নেয়ার নির্দেশ থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
জুট টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার মোঃ কাওসার আলী মোল্লা জানান, সকালের পালায় মিল চালু অবস্থায় পাটের কাটিং এবং কার্টিস বিভাগে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে দাউ দাউ করে আগুন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দাবি করেন, আগুন দাউ দাউ করে জ্বলার সময় মিলের ছাউনিতে থাকা প্লাস্টিক টিনে আগুন লেগে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে মিলের শ্রমিকরা আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও প্লাস্টিক টিনের আগুন সর্বত্র ছড়িয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
মিল শ্রমিকরা জানান, হঠাৎ চালে আগুন থেকে মেশিন এবং পাটে আগুন ধরে গেলে তারা প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাইরে চলে আসেন। এই সময় হুড়োহুড়িতে ৫ জন শ্রমিক আহত হন।
আগুন লাগার পর খবর পেয়ে দিঘলিয়া, দৌলতপুর, নৌ-দমকল বিভাগে এবং বয়রা দমকল বিভাগের ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের ৪ঘন্টা চেষ্টা চালায়।
মিলের জেনারেল ম্যানেজার আরও জানান, এই মিলের তিনটি শিডিউলে প্রায় দুই হাজার নারী/পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। সকালের অন্তত ৮০০ শ্রমিক কর্মরত ছিল। এই মিলে উৎপাদিত সকল পাট পণ্য বিদেশে রফতনি করা হয়। রফতানিকৃত পাট পণ্য নেয়ার জন্য মিলের ঘাটে এমভি রোকেয়া নামক একটি কার্গো অবস্থান করছিল।
ফায়ার সার্ভিসের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক লুৎফর রহমান বলেন, আগুন লাগার পর খবর পেয়ে বয়রা স্টেশন থেকে তিনটি, খালিশপুর স্টেশন থেকে একটি, দৌলতপুর স্টেশন থেকে একটি এবং দিঘলিয়া নৌ-দমকল বিভাগের একটিসহ মোট ছয়টি ইউনিট প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
খালিশপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার তারেক হাসান জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণ করা যায়নি। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগুনের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও জানা যায়নি। তারা পাট ও পাটজাত পণ্য সরিয়ে সরিয়ে দেখছেন ভেতরে কোথাও আগুন আছে কি-না। আগুনের কারণ ও ক্ষতির পরিমাণ নিরূপনে একটি কমিটি গঠন করা হবে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, খুলনা জেলায় ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পাটের গুদামে ১৩টি অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষতি দেখানো হয় ২১ কোটি টাকা। আবার ২০১২ সালে খুলনা বিভাগের পাটের গুদামে ৭৭টি অগ্নিকা-ে ৮ কোটি ৬০ লাখ ৯৬ হাজার, ২০১৩ সালে ৪৯টি অগ্নিকা-ে ১২ কোটি ২৮ লাখ ৭৬ হাজার ৭০০, ২০১৪ সালে ৪৭টি অগ্নিকা-ে এক কোটি ৬৬ লাখ ৪৯ হাজার ৫৩০, ২০১৫ সালে সাম্প্রতিক অগ্নিকা- বাদে ২৪টি ঘটনায় ক্ষতি দেখানো হয়েছে ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৪ টাকা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী খুলনা বিভাগে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে পাটের গুদামে ২২০টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। আর সেসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি দেখানো হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের অক্টোবরে খুলনার দৌলতপুরে এফআর জুট  ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের ১০ নম্বর গোডাউনে আগুন লেগে প্রায় ২৫ কোটি টাকার পাট পুড়ে গেছে বলে দাবি করা হচ্ছে। এর আগেও ওই প্রতিষ্ঠানটির কয়েকটি পাটের গুদামে আগুন লাগার ইতিহাস রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০০৬ সালে দিঘলিয়ার শরিফ জুট গোডাউনে অগ্নিকা-ে ক্ষতিপূরণ দেখানো হয় এক কোটি ১৯ লাখ, ২০০৭ সালে দৌলতপুর উত্তরা পাট সংস্থা, ইস্টার্ন ট্রেডার্স, গোল্ডেন জুট সাপ্লাইয়ে পৃথক অগ্নিকা-ে ক্ষতি হয় তিন কোটি ৫৯ লাখ ৩৫ হাজার ৩৯০, ২০০৮ সালে সবুজ বাংলা গোডাউনে তিন কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার ৮০০, ২০০৯ সালে পিপলস জুট মিল গোডাউনে ২০ লাখ, ২০১০ সালের ক্রিসেন্ট জুট মিল গোডাউনে ৯ লাখ ২০ হাজার ও দুই লাখ ৫২ হাজার ৬৬৯, ২০১১ সালে ক্রিসেন্ট জুট মিল গোডাউনে ১৩ লাখ ৯ হাজার ৫০০, জিয়া ও মোল্লা জুটে সাত কোটি ৪০ লাখ, অগ্রণী জুট সংস্থায় তিন কোটি ৫০ লাখ ও সৌরভ ট্রেডার্সে দেড় কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। সর্বশেষ গতকাল বুধবার সকালে খুলনার দিঘলিয়ার এ অগ্নিকান্ডে অন্তত ৫০ কোটি টাকা মূল্যের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি মালিক পক্ষের।
 অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ অগ্নিকা-ই সাজানো। স্বল্প পণ্য পুঁজি করে ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের হাত করে প্রতিবছরই কিছু ব্যবসায়ী এ ধরনের ঘটনা ঘটায়। ফলে সরকার ও বীমা কোম্পানির কোটি কোটি টাকা গুনতে হলেও কিছু ব্যক্তি লাভবান হয়। সর্বশেষ ঘটনায় সোনালী ব্যাংক দৌলতপুর শাখার কর্মকর্তারা ও গ্রীন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কর্মকর্তারাও গোডাউন পরিদর্শন করে সন্তুষ্ট হয়ে পাটের জন্য ব্যাংক ঋণ ও বীমা পলিসি অনুমোদন করেন। আবার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ফায়ার লাইসেন্স থাকার কথা বলা হলেও সরেজমিনে অগ্নিনির্বাপণের নিজস্ব কোন ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের ফলে আগুন লাগার দাবি করা হলেও ফায়ার সার্ভিস বলছে, গোডাউনে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকার কোন নিয়ম নেই।
কাঁচাপাট রপ্তানিকারক ও খুলনা চেম্বার অব কমার্সে পরিচালক সাইফুল ইসলাম পিয়াস বলেন, পারিবারিকভাবে দীর্ঘদিন পাট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পাট অন্যতম দাহ্য পদার্থ, তবে সহজে এতে আগুন লাগার কথা না। এ ধরনের অগ্নিকা-ে মূলত পাইকার ও সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই প্রতিটি আগুন লাগার ঘটনার সঠিক তদন্ত হলে এসব ঘটনা কমে যেতো। এতে সরকার, বীমা কোম্পানিগুলো লাভবান হতো। আর এখন লাভবান হয় কিছু ব্যক্তি, সেটি বন্ধ হতো।
ব্যাংক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পাট ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়ার আগে পাট সংরক্ষণসহ আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিশেষ কারণে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ক্লেম করলে সে ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়। তবে এসব ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টি এড়িয়ে যান ব্যাংকাররা।
গ্রীন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও খুলনা আঞ্চলিক প্রধান শাহ জাহাঙ্গীর আবেদ জানান, পাট গুদামে পণ্য মজুদকরণে বীমা করার ক্ষেত্রে আমরা প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত ব্যবসায়ী, ব্যাংক ঋণ গ্রহীতা কি না এ বিষয়টি দেখি। আর ব্যাংক দেখে থাকে তাদের ফায়ার লাইসেন্সসহ আনুষঙ্গিক বিষয়। দুর্ঘটনা ঘটলে বীমা কোম্পানির নিজস্ব তদন্ত টিম, ব্যাংক, ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনসহ নানা বিষয় পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তবে কেউ ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা সৃষ্টি করলে ও তদন্তে তা প্রমাণিত হলে তারা ক্ষতিপূরণ পাবে না বরং তারা ব্যবসায়িক কমিটমেন্ট নষ্ট করবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: খুলনায় পাট গুদামে ১০ বছরে ২২০টি অগ্নিকান্ড
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ