হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী
চলমান বিশ্ব অর্থনীতি বৈষম্যনীতি ও পুঁজির কেন্দ্রীভবনের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই বৈষম্য দেশে দেশে কালে কালে ক্রমেই প্রকট আকার ধারণ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররা রাষ্ট্রের উপর কর্পোরেট পুঁজিবাদের নিয়ন্ত্রণকে রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র ও জনগনের স্বাধীনতার জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়া এখন সেই কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন। মার্কিন শিল্পপতি হেনরী ফোর্ড বলেছিলেন, ‘এটা যথেষ্ট মঙ্গলজনক যে দেশের মানুষ আমাদের ব্যাংকিং এবং অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছুই বোঝেনা, আমার বিশ্বাস তারা যদি এটা বুঝত তবে আগামীকাল সকাল হওয়ার আগেই দেশে বিপ্লব ঘটে যেত।’ এ থেকে বোঝা যায়, পশ্চিমা গণমানুষের অজ্ঞতার উপর ভর করেই কর্পোরেট পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকাশ ঘটেছে এবং টিকে আছে। সাময়িক প্রোপাগান্ডা ও কর্পোরেট কালচার ও মিডিয়ার ভেল্কিবাজিতে একটি জনগোষ্ঠিকে কিছু সময়ের জন্য হয়তো বোকা বানানো যায়। কোটি কোটি মানুষকে দীর্ঘদিন ধরে ঠকানো বা বোকা বানানোর অব্যাহত চেষ্টা অবশেষে চরম পরিনতি ডেকে আনতে পারে। হেনরী ফোর্ডের ভাষায় যাকে বিপ্লব ঘটে যাওয়া বলা হয়েছে। মার্কিন রাজনীতিক, ট্যাক্স ল’য়ার এবং ব্লগার বব লর্ড এর লেখা একটি কলাম সম্প্রতি আইসিএইচ ব্লগে প্রকাশিত হয়। ‘ইনেকুয়ালিটি উইল গেট ওর্স আনটিল দেয়ার ইজ অ্যা রিভ্যুলিশন’ শিরোনামের নিবন্ধে পুঁজিবাদের কেন্দ্রীয় চারিত্র্য হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ও রাজনীতির চরম পরিনতির সমুহ আশঙ্কাকেই ফুটিয়ে তোলতে চেষ্টা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক বিবর্তনের হাত ধরে আগামীর সম্ভাব্য পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বানী করতে গিয়ে বব লর্ড ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সাহিত্যিক ওয়াশিংটন আর্ভিং-এর ছোটগল্প রিপ ভ্যান উইংকেলের কাহিনীর সাথে রূপকল্প হিসেবে ভবিষ্যতের মার্কিন সমাজব্যবস্থাকে তুলনা করেছেন। দ্বিতীয় পুরুষ পাঠকের প্রতি তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, রিপ ভ্যান উইংকেলের মত এক গভীর ঘুমের আচ্ছন্নতা থেকে ২০৪০ সালের বসন্তে জেগে উঠার পর পাঠক কি দেখতে পাবেন। সেখানে তিনি নিজেই জবাব দিয়েছেন, এভাবে- অন্য অনেক কিছুর মধ্যে হয়তো দেখা যাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোন এক প্রার্থী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ধারণ করেছেন। আজকের মত তখন হয়তো রাষ্ট্রের সম্পদের শতকরা ৯০ভাগ শতকরা একভাগ জনগোষ্ঠির হাতে কক্ষিগত থাকার অবস্থা আরো ঘনীভুত হয়ে সেই একভাগের একশ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে উঠবে। মার্কিন জাতীয় অর্থনীতির সেই উত্তুঙ্গ কেন্দ্রীভবনের ধারা এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। মার্কিন অর্থনীতির এই বিবর্তনের ধারা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, তুমি যদি আরো ২৪ বছর আগে ১৯৯২ সালে জেগে উঠতে, তাহলে হয়তো দেখতে পেতে, তখনকার মার্কিন ডেমোক্রেটদলীয় প্রেসিডেন্ট পদ প্রাথী বিল ক্লিন্টন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যবান একভাগ মানুষের দেশের ৯০ ভাগ জনগনের সমান সম্পদের মালিকানা নিয়ে নিজের আক্ষেপ প্রকাশ করছেন। আজ ২৪ বছর পেরিয়ে এসে আরেক ডেমোক্রেট ক্যান্ডিডেট বার্নি স্যান্ডার্স দেখাচ্ছেন, বিল ক্লিন্টনের সময়ের চেয়ে ধনীক শেণীর সম্পদ আরো ১০ গুন বৃদ্ধি পেয়ে আরো এক দশমাংশ মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে।
কপোর্রেট ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতায়নের শুরু থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পতনের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার দ্বারা পুরো মার্কিন সমাজ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাস করার চরম বাস্তবতার বিরুদ্ধে অষ্টাদশ শতকে তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন প্রথম সুনির্দ্দিষ্ট হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে একসময় তাদের উত্তরসুরীরা পিতৃপুরুষের জয় করা রাষ্ট্রে নিজেদেরকে বাস্তুহারা ও পরাধীন হিসেবে আবিষ্কার করবে। আর বিংশ শতকে এসে মার্কিন সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি লুইস ডি ব্রান্ডিস বলেছিলেন, আমরা আমাদের দেশে হয় গণতন্ত্রকে ধারণ করব, অথবা গুটি কতক লোকের হাতে সম্পদের বিশাল ভান্ডার কুক্ষিগত রাখতে দেব, তবে একই সঙ্গে এ দু’টিই করতে পারবনা। ১৯৯২ সালের তুলনায় দুই হাজার চল্লিশ সালে মার্কিন অর্থনীতিতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হাজারগুন বেড়ে যাবে বলে বব লর্ড আশঙ্কা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধকারময় ভবিষ্যতের পরিনতি থেকে পরিত্রানের উপায় নির্দেশ করে তিনটি মৌলিক পরিবর্তন বা নীতিগত পন্থা ও পদক্ষেপ গ্রহনের কথা বলেছেন। প্রথমত: মার্কিন আইন প্রণেতাদের ধনাঢ্যদের স্বার্থ সংরক্ষনকারী মানসিকতা পরিহার করতে হবে, এ ধরনের ট্যাক্স পলিসির মূল লক্ষ্যসমুহ পরিবর্তন করতে হবে। এই রাজস্বনীতির আওতায় সবচে ধনীরা সবচে কম রাজস্ব দিয়ে থাকে, আর দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের উপর তাদের আয়ের তুলনায় অনেক বেশী খাজনা বা রাজস্ব ধার্য করা হয়। দ্বিতীয়ত: আয় বৈষম্য নিরসনে উচ্চ আয়ের লোকদের জন্য উচ্চ করহার প্রদানের বাধ্যবাধকতা রাখতে হবে। তৃতীয়ত: উচ্চবিত্তের হাতে পুঞ্জিভুত সম্পদের সংরক্ষণ ও হস্তান্তরের ক্ষেত্রে অকল্পনীয় ফাঁক-ফোঁকড়গুলো বন্ধ করতে হবে। সেখানে উত্তরাধিকারিদের মধ্যে বিলিয়ন ডলারের সম্পদ হস্তান্তরেও ন্যুনতম ট্যাক্স আদায়ের প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হয়না। এসব দৃশ্যমান বৈষম্য ও আইনগত ব্যত্যয় সমুহের উত্তরণ ঘটিয়ে একটি বৈষম্যমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব কিনা। এমন স্বকীয় প্রশ্নের স্বকৃত সমাধান বা উত্তর হচ্ছে, সম্ভব-তবে এর জন্য একটি রাষ্ট্রবিপ্লবের প্রয়োজন হবে। তা’ না হলে অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই কদাকার দুষ্টচক্র আরো খারাপের দিকে যাবে। জনগনের বিপ্লব ছাড়া রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক ও আইন প্রণেতারা কখনো স্বাভাবিক গতিতে, স্বপ্রণোদিত হয়ে এই পরিবর্তনের পথে পা’ বাড়াবেনা, এটা সসুনিশ্চিত।
আমরা বাংলাদেশে সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এখন এক চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। বাংলাদেশের এই বাস্তবতা বিশ্বব্যবস্থার বৈষম্যনীতিরই একটি উপজাত প্রতিফলন। একটি উদার মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং এককেন্দ্রীক বা ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থার অংশীদার হিসেবে আমরা বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করছি তা’ মূলত: পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি ক্ষণভঙ্গুর খোলসমাত্র। এই খোলসের আড়ালে রয়েছে সামগ্রিক ব্যবস্থার উপর অদৃশ্য সুতোর নিয়ন্ত্রন ও লুণ্ঠনের কালোহাত। ঔপনিবেশিক বৃটিশরা এখানে যে বর্ণচোরা মুৎসুদ্দি শ্রেনী গড়ে তুলেছিল। তাদের উত্তরসুরীরা নানাভাবে সা¤্রাজ্যবাদের দালালি করে জনগনের স্বাধীনতা ও সম্পদের উপর নিজেদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বৃটিশরা এদেশে বাণিজ্য করতে এসে প্রথমেই এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্মীয় ও বর্ণগত মতপার্থক্য এবং একশ্রেনীর মানুষের মধ্যে ক্ষমতা ও ধনলিপ্সার জন্য বিপদসঙ্কুল পথে পা বাড়ানোর বাসনা দেখে তারা পুলক অনুভব করেছিল। তারা বৃটিশ-ভারতে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের নীতি হিসেবে ‘ডিভাইড এন্ড রোল’ নীতির সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে সফল হয়েছিল বলেই ভারতসহ তাদের মূল রাষ্ট্রের চেয়ে আয়তনে ও জনসংখ্যায় বহুগুন বড় বড় ভ’খন্ডকে শতাধিক বছর ধরে নিজেদের আয়ত্বে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ভারত দখলের আগে ফসলহানি ও দুর্ভীক্ষপীড়িত ইংল্যান্ড ভারতকে শোষন করে বিশ্বের শীর্ষতম সমৃদ্ধ সা¤্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়। বৃটিশরা যে অর্থে শত বছরে একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ গড়ে তোলতে সক্ষম হয়েছিল। তারই উত্তরসুরী হিসেবে মার্কিনীরা তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ততটা সংহত করতে সক্ষম হয়নি। পরিবর্তিত বাস্তবতায় পশ্চিমা সংখ্যাগরিষ্ঠ(৯৯ ভাগ) জনগনের সম্পদের মালিকানা তুলে দেয়া হয়েছে কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে। অর্থনীতিতে সম্পদের সীমাবদ্ধতার ধারনা একটি স্বতসিদ্ধ বিষয়। যুগে যুগে অর্থনৈতিক বাণিজ্যের কমোডিটিতে কিছু পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটলেও মানুষের মধ্যে ভোগের লিপ্সা ও ক্ষমতার দ্বন্দের কোন সীমাবদ্ধতা বা পরিসমাপ্তি নেই। অতএব সভ্যতার শুরু থেকে অদ্যাবধি রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জনগনের সম্পদ কুক্ষিগত করার দ্বন্দে আপাত: সমাধান এসেছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেপথ্য নিয়ন্ত্রক কর্পোরেট ব্যাংকার এবং মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বিনিয়োগকারিরা যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদকেই নিজেদের অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদী স্বার্থ টিকিয়ে রাখার প্রধান অবলম্বন হিসেবে গ্রহন করেছে। দেশে দেশে অন্তহীন যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে লাখ লাখ মানুষ হত্যা, একের পর এক সমৃদ্ধ জনপদকে ধ্বংসস্তুপ ও পদানত করার পরও কোথাও তাদের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হতে দেখা যায়নি। সেই পঞ্চাশের দশকে কোরীয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত প্রায় সব যুদ্ধেই মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের পশ্চাদপসারণ হলেও ভেতর থেকে ফুলে ফেঁপে উঠেছে অনেকটা অন্ধকারে থাকা মধ্যস্বত্বভোগি কপোর্রেট অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকরা। তাদের কাছে সরকার, রাষ্ট্র ও জনগন জিম্মি হয়ে পড়েছে। বিগত দশকের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল তা’ মার্কিন পুঁজিবাদি সা¤্রাজ্যবাদের পতনের ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিল। ২০১১ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা কাটিয়ে উঠতে শুধুমাত্র ব্যাংকিং সেক্টরে বেইলআউট তহবিলের যোগান দেয়া হয়েছিল ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালে মার্কিন ফেডারেল বাজেটের আকার ছিল ৩.৮ট্রিলিয়ন ডলার। এ হিসেবে কর্পোরেট অর্থনীতির উদ্ধার তহবিলের পরিমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭ বছরের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বড়। মার্কিন জনগনের সঞ্চিত ও গচ্ছিত সম্পদ ও সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা তহবিলকে কাটঁছাট করে এবং বৈদেশিক ও আভ্যন্তরীণ ঋণের মাধ্যমে এই অর্থের যোগান নিশ্চিত করা হয়।
মার্কিন ট্রেজারির সাবেক এসিসট্যান্ট সেক্রেটারী এবং মার্কিন পুঁজিবাদি অর্থনীতির প্রতিকী প্রতিষ্ঠান ওয়ালস্ট্রীটের প্রতিনিধিত্বশীল সংবাদ মাধ্যম ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের অ্যাসোসিয়েট এডিটর পল ক্রেইগ রবার্টস চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারে কার্ল মার্কস এবং লেনিনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাত্বিক দার্শনিক মার্কস ও লেনিনের অর্থনৈতিক সমাজদর্শনকে যুগের অগ্রবর্তি বলে বর্ননা করেছেন পল রবার্টস। অর্থাৎ পশ্চিমা দুনিয়ার সমাজতাত্বিকরা এখন আত্মবিশ্লেষন ও পেছনে ফিরে তাকানোর কথা ভাবতে শুরু করেছে। ঊনবিংশ শতকে সামন্ততান্ত্রিক অভিজ্ঞতার আলোকে কার্ল মার্কস ভবিষ্যতের পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রিডিকশন করে যে বিপদজনক ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন তৎকালীন সময়ে তা’ ছিল যুগের অনেক বেশী অগ্রবর্তি। বিশেষত: অফশোরিং জব মার্কেট এবং পুঁজিবাদি অর্থায়নের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তখনো বিশ্বের কাছে ছিল অজ্ঞাত, অপরিচিত। তবে পুঁজিবাদি বিশ্বের আজকের বাস্তবতা কার্ল র্মাক্সের ভবিষ্যদ্বানীর চেয়েও বিশৃঙ্খল ও ভয়াবহ। আজকে যখন শতকরা ১ ভাগেরও কম সংখ্যক মানুষের হাতে অধিকাংশ সম্পদ কেন্দ্রীভুত হয়ে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা আরো কেন্দ্রীভুত হয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মত পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই গিলে খেতে শুরু করেছে, তখন পশ্চিমা সমাজতাত্ত্বিকরা একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা বলছেন।
তবে পশ্চিমা সমাজের ভেতরকার বর্তমান বাস্তবতা ভিন্নতর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে পঞ্চাশের দশকে কমিউনিজম ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নানা ধরনের উদ্ভট সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে দেখা গেছে, ঠিক একইভাবে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো কমিউনিজমের স্থলে ইসলামকে প্রতিস্থাপন করছে। রিপাবলিকান সিনেটর জোসেফ ম্যাকার্থারের কমিউনিজম বিরোধি যে প্রচারনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে কোন তথ্যপ্রমান ছাড়াই কমিউনিষ্ট সন্দেহে যে কাউকে হয়রানি ও ডিপোর্ট করার সুযোগ ছিল। তখন কমিউনিস্ট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের এজেন্ট সন্দেহে হাজার হাজার মানুষকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। বিশেষত: সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও পূর্ব ইউরোপ থেকে অভিবাসি নাগরিকরা ব্যাপক হারে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। ম্যাকার্থিজমের যুগ থেকে আজকে অর্থশত বছর পেরিয়ে এসে ইতিমধ্যে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। একটি এককেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদি বিশ্বব্যবস্থায় ইসলাম ও মুসলমানদেরকে পশ্চিমা পুঁজিবাদের মূল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে পশ্চিমা অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের পোলারাইজেশন ঘটতে শুরু করেছে। পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়ার অনুঘটকরা যতই বেশী ইসলামভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে, পশ্চিমা অনুসন্ধিৎসু যুব সমাজ ততই যেন ইসলামের প্রতি কৌতুহলি ও আগ্রহী হয়ে উঠছে। পাশাপাশি একটি সমান্তরাল ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা ক্রমে জোরদার হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। ১৯৯০ দশক থেকে বছরে ১৫ থেকে ২০ ভাগ হারে ইসলামী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটছে। গুটিকতেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের মালিকের হাতে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার বিপরীতে প্রতিটি মানুষের কাছে সম্পদের মালিকানাসহ সুষম বন্টন নিশ্চিত করাই ইসলামী অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে ইসলামিক ফিনানসিয়াল সিস্টেমে সম্পদের পরিমান প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার আগামী ৩ বছরের মধ্যে তা সাড়ে ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের সীমা অতিক্রম করবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে বিশ্বসম্প্রদায়কে মুক্ত করতে ইসলামই যে সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠিত হবে, তা’তে বিষ্ময়ের কিছু নেই। পাশাপাশি পুঁজিবাদি শোষনের টাইটানিক ইতিমধ্যেই ডুবতে শুরু করেছে । এ ক্ষেত্রে একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনোজাগতিক সমাজ বিপ্লবের জন্য বিশ্বসম্প্রদায়কে আরো প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।