হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিশেষত: মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামরিক-রাজনৈতিক পরাশক্তি দেশগুলো যার যার অবস্থান পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্ব, ফিলিস্তিন সঙ্কট নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদিরা বরাবরই একপাক্ষিক ভূমিকা পালন করে এসেছে। মধ্যপ্রাচের মুসলিম দেশগুলোর তেলসম্পদের উপর নির্ভর করে তাদের গাড়ি, বিমান, উৎপাদনব্যবস্থা ও অর্থনীতির চাকা সচল থাকলেও বিশ্বের শতকোটি মুসলমানের প্রত্যাশার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তারা সব সময়ই যুদ্ধবাজ, জায়নবাদি ইসরাইলকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। তাদেরই ছত্রছায়া অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তায় জবরদস্তিমূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত কয়েক মিলিয়ন ইসরাইলীর ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটিকে মধ্যপ্রাচ্যে অপরাজেয় শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখতে গত সাতষট্টি বছর ধরে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলারের সরাসরি সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। তাদের এই সহযোগিতা নিয়ে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক শক্তিধর লাঠিয়ালে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমাবিশ্ব যখন ওয়েপন্স অব মাস ডেস্ট্রাকশন (ডব্লিউএমডি) মজুদের কল্পিত অভিযোগ তুলে ইরাকে ভয়াবহ সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেশটিকে ধব্বংস্তূপে পরিণত করেছে, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও কোটি মানুষকে গৃহহীন করে ইরাককে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আন্তর্জাতিক পারমানবিক অস্ত্রনিরোধ চুক্তিতে সই করার পরও ইরানের কথিত পারমাণবিক অস্ত্র পরিকল্পনার বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দশকের পর দশক ধরে অবরোধ, বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা এবং সামরিক হুমকি জারি রেখেছে। তখন মধ্যপ্রাচ্যের অবৈধ ক্ষুদ্ররাষ্ট্র ইসরাইলকে একদিকে নিউক্লিয়ার-হাইড্রোজেন বোমা বানানোর সুযোগ দিয়েছে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ন্যূনতম বাধ্যবাধকতা বা শর্তলঙ্ঘন করে গাজা ও পশ্চিম তীরের আরবদের ভূমিতে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের তৎপরতা অব্যাহত রাখার সুযোগ দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, দেশে দেশে বিভেদ-অনৈক্য ও অশান্তির মূলই হচ্ছে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের পশ্চিমাদের লাঠিয়ালের ভূমিকা গ্রহণ করা। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে অজেয় যুদ্ধবাজ শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখতেই গত ৭ দশক ধরে ইঙ্গ-মার্কিনীদের মধ্যপ্রাচ্যনীতি প্রণীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর বিপরীতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি শক্তির সাথে ঠা-া লড়াইয়ে অবতীর্ণ এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার মিত্রদের মধ্যপ্রাচ্যনীতি ছিল অনেকটা অস্পষ্ট ও অগোছালো। পুরো আশির দশকে (ডিসেম্বর ১৯৭৯ থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯) আফগানিস্তানে সোভিয়েত সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়েই মার্কিনীরা মধ্যপ্রাচ্যে সিআইএ’র নেটওয়ার্ক ও সামরিক তৎপরতা বৃদ্ধির সুযোগ গ্রহণ করেছিল। সে সময় আফগান মুজাহিদদের অর্থ, অস্ত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদি শক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যের পেট্টোডলারে পুষ্ট তাদের বশংবদ দোসররা। সময়ের ধারাবাহিকতায় বিশ্বপ্রেক্ষাপট বদলে গেলেও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ঠা-া লড়াইয়ের কুশীলব পরাশক্তিগুলোর অবস্থান বদলায়নি। রাজনীতি ও অর্থনৈতিক কৌশলগত অবস্থান ভেদে বন্দুকের নলগুলো, বোমারু বিমানের লক্ষ্যবস্তুগুলো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে শুধু। বিপ্লবের পর ইরানকে ধ্বংস করতে অথবা বিপ্লব ব্যর্থ করতে ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে সব ধরনের সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছিল, ইঙ্গ-মার্কিনী এবং মধ্যপ্রাচ্যের বশংবদ রাজারা। মার্কিনী প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্রের সাথে সাথে অপ্রচলিত রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র ও ডাব্লিউএমডি’র মাধ্যমে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও ইরানকে কাবু করা যায়নি। ইরান-ইরাক যুদ্ধের ব্যয়ভার ও দায়দেনা পরিশোধ করতে গিয়ে ইরাকি প্রেসিডেন্ট ১৯৯০ সালে কুয়েতে দখলদারিত্ব চালিয়েছিল পশ্চিমাদের ইঙ্গিতেই, তবে পশ্চিমাদের সমর্থন ও বন্দুকের নল ও যুদ্ধবিমানের লক্ষ্যবস্তু বিপরীত দিকে ঘুরে যেতে এক মুহূর্তও সময় লাগেনি। প্রথমতঃ কুয়েতকে মুক্ত করা, অতঃপর দীর্ঘমেয়াদী অবেরোধ বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরাককে দুর্বল করার পর মিথ্যা অজুহাতে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে, ফাঁসিতে ঝুলিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে একটি সক্ষম রাষ্ট্র হিসেবে ইরাকের টিকে থাকার সম্ভাবনাটুকুও তারা এখন ধ Ÿংস করে দিচ্ছে। সেই সাথে ইরান, সিরিয়া, লিবিয়া, মিশর, তুরস্ক, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবগুলো রাষ্ট্রকে দেউলিয়া, অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করে তোলার সাম্রাজ্যবাদি নীল নকশার বাস্তবায়ন চলছে।
মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সমরসজ্জার পেছনে রয়েছে একদিকে ইসরাইলের নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমাদের রণকৌশল. অন্যদিকে তাদের দানবীয় বিপুল জ্বালানি চাহিদার নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত রাখার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ রক্ষা করা। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার প্রধান মনোযোগ নিবদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য ও আরব-ইসরাইল সংকটকে ঘিরে। বিশেষতঃ ১৯৪৮ সালে আরবদের ভূমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাস্তবতাকে আরবরা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। আরব প্রতিবেশীদের দ্বারা ইসরাইলকে একঘরে কোণঠাসা রাখার দুই দশকের মাথায় ১৯৬৭ সালে ইসরাইল বিশাল সামরিক শক্তি নিয়ে একই সাথে মিশর, সিরিয়া এবং জর্দানের বিশাল ভূ-ভাগ দখল করে নেয়। আরবরা ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের কথা, ফিলিস্তিনিদের ভূমি এবং স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়ার কথা ভুলে গিয়ে গোলান মালভূমিসহ সদ্য হারানো ভূমি ফেরত পাওয়ার চেষ্টায় ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তবে আগের পরাজয় থেকে শিক্ষা নিয়ে ১৯৭৩ সালে আরবরা তাদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধারে যে সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছিল তা সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ার পর পশ্চিমারা যুদ্ধবিরতি চাপিয়ে দিয়ে আরব ভূমিতে ইসরাইলের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখার সুযোগ করে দেয়। নিজেদের হারানো ভূমি ফেরত পেতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের দূতিয়ালিতে ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিডে ইসরাইলের সাথে সমঝোতা চুক্তিতে উপনীত হয় মিশর। এভাবেই বার বার আরব মুসলমানদেরকে ইসরাইলের হাতে মার খেয়ে মার হজম করতে বাধ্য করেছে পশ্চিমারা। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং আফগান মুজাহিদদের হাতে সোভিয়েত বাহিনীর পরাজয় এবং হেজবুল্লাহ ও হামাসের মত ইসরাইল বিরোধী শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠার পাশাপাশি জাতিসংঘের ২৪২ নম্বর রেজুলেশনের আওতায় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রেক্ষাপট মজবুতভিত্তি ও ব্যাপক বিশ্বজনমত অর্জন করে। বিশ্বের অন্যতম অপরাজেয় ও শক্তিশালী আইডিএফ বা ইসরাইলী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনী গেরিলা বাহিনী হামাসের শক্তিমত্তা ইতিমধ্যে একাধিকবার প্রমাণীত হয়েছে। গাজা উপত্যকায় দশকব্যাপী ইসরাইলের স্থল, নৌ ও আকাশ অবরোধের পরও যখন হামাসের হাতে মার খেয়ে ইসরাইলী বাহিনীকে গাজা থেকে ফিরে আসতে হয়, তখন স্বাধীন ও মুক্ত ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী ইসরাইলের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে, ইসরাইল সম্ভবতঃ এই আশঙ্কাই করছে। মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নী, কুর্দি-তুর্কি, আরব-পার্সি ইত্যাদি ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত বাধিয়ে, রাজতন্ত্র ও সন্ত্রাসবাদি গ্রুপগুলোর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে একটি অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ হেজিমনি অবস্থা তৈরির পেছনে মূলত, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সম্ভাবনাকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়াস কাজ করছে। অন্যদিকে বিশাল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বলয়ভুক্ত দেশগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পশ্চিমারা বিপুল অর্থ লগ্নি করে যে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স (এমআইসি) গড়ে তুলেছিল তা তাদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের প্রধান অবকাঠামো হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে ওয়ারশ’ জোটের মত ন্যাটো বা এমআইসি’র গুরুত্ব ফুরিয়ে যাওয়াই ছিল সঙ্গত। কিন্তু গত আড়াই দশকে ন্যাটো জোটের আকার এবং পশ্চিমাদের সামরিক বাজেট দুটিই আরো বেড়ে যেতে দেখা গেল। মার্কিন জনগণের মৌলিক অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট কাটছাঁট করে হাজার হাজার কোটি ডলারের সামরিক বাজেট বাড়ানো হয়েছে শুধুমাত্র কর্পোরেট মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ব্যবসায়িক মুনাফা অক্ষুণœ রাখতে। যুদ্ধ সাংবাদিক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে অনেক যুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী, পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদি যুদ্ধের একজন কঠোর সমালোচক লেখক-গবেষক আন্দ্রে ভিচেকের লেখা একটি নিবন্ধ গত বুধবার আইসিএইচ ব্লগে ছাপা হয়। ‘হাউ দ্য ওয়েস্ট ক্রিয়েটস টেররিজম’ শিরোনামের দীর্ঘ নিবন্ধে তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার পেছনে পশ্চিমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। একস্থানে তিনি লিখেছেন, ‘ইসলাম ও মুসলমানদের একটি শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করাতে, সাম্রাজ্যবাদিরা প্রথমেই শেকড় বিচ্ছিন্ন ও উগ্রপন্থী মুসলমানদের বিভিন্ন সংগঠনকে হাত করে এবং আরো কিছু নতুন সংগঠন সৃষ্টি করে, অতঃপর অনবরত প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং অর্থ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে এমনভাবে তৈরি করে যেন তারা সত্যিই পশ্চিমা সমাজে ভয় ও আতঙ্ক তৈরির যথোপযুক্ত শক্তি হিসেবে আর্বিভুত হয়’।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে এতদিন মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদিদের এক তরফা গেম-প্লান বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন সম্ভবত, সেই বাস্তবতার কিছুটা পরিবর্তন সূচিত হওয়ার আলামত দেখা যাচ্ছে। সিরিয়ায় আইএস এবং বিদ্রোহী দমনে সরাসরি রাশিয়ান সামরিক হস্তক্ষেপের মধ্যদিয়ে এবং ইরানের সাথে ৬ জাতির রাজনৈতিক সমঝোতার টেবিলে চীন ও রাশিয়ার সক্রিয় ভূমিকায় এই পেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। প্রায় ৫ বছর আগে তিউনিসিয়া থেকে সৃষ্ট আরব গণজাগরণের ঢেউ যখন মিশরের তাহরির স্কোয়ারে লাখো মানুষের প্রতিবাদ সমাবেশের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন সম্ভাবনাকে জাগ্রত করেছিল, যে ঢেউয়ে স্ট্রংম্যান হিসেবে খ্যাত হোসনি মোবারককে ক্ষমতার মসনদ থেকে ভাসিয়ে নিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে একটি গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে ইরাক ও আফগানিস্তানের পাশাপাশি গত ৫ বছরে সেখানে মিশর, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের মত দেশকে নতুনভাবে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। গৃহযুদ্ধ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে টালমাটাল মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশের শাসকরা এখন আর ফিলিস্তিন ও আরব-ইসরাইল সঙ্কট নিয়ে মাথা ঘামায় না। উপরন্তু এদের কেউ কেউ গোপনে আঁতাত করে প্রতিপক্ষ দমনে ইসরাইলের সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের একাকীত্ব ঘোচাতে এবং আরব প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সামরিক আধিপত্যের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে পশ্চিমারা যখন নতুন নতুন প্লট তৈরি করছে, তখন রাশিয়া এবং চীনের মত সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো পশ্চিমাদের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। গত ২১ জানুয়ারি মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত আরবলীগের সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বক্তৃতা করেন। শি জিন পিং তার বক্তৃতায় ১৯৬৭ সালের ‘সিক্স ডে ওয়ার’ পূর্ববর্তী সীমানারভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে তার দ্ব্যর্থহীন অবস্থান প্রকাশ করেছেন। ইতিপূর্বে গত বছর আরবলীগের সম্মেলনে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের রাশিয়ান সমর্থন এবং সক্রিয় ভূমিকার অঙ্গীকার করেছিলেন। তবে এর আগে থেকেই চীন ও রাশিয়া ফিলিস্তিনের মুক্তির লক্ষ্যে নিজের কূটনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আসছে। তাদের এই যৌথ প্রয়াসের ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের তীব্র বিরোধিতা ও কূটনৈতিক তৎপরতাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে একটি ‘নন-মেম্বার অবজারভার স্টেট’র মর্যাদা দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মত জাতিসংঘ সদর দফতরে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। একে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রাথমিক স্বীকৃতি হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা যখন অবশ্যম্ভাবি হয়ে উঠেছে, ইসরাইল এবং পশ্চিমারা তখন মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটকে আরো বিস্তৃত করে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার দূরভিসন্ধি গ্রহণ করছে। একদিকে তারা ইরাক ও সিরিয়ায় নতুন করে স্থল সেনা নামানোর পরিকল্পনা করছে, পাশাপাশি তারা নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের শাস্তিপূর্ণ সমাধানের বিভ্রান্তিকর কথাও বলছে। তবে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের প্রধান উৎস হিসেবে সর্বাগ্রে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিকে যথাশিগগির মেনে নেয়া এবং আরব দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার বিশ্বাসযোগ্য তৎপরতা থেকেই মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব। সৌদি আরবে একজন শিয়া রাজনীতিকের মৃত্যুদ-কে কেন্দ্র করে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও উভয় দেশই পরস্পরের সাথে সংঘাতে না জড়ানোর প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি মার্কিনীরাও উভয় পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে বলে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে। সেই সাথে মার্কিনীরা আগ বাড়িয়ে এই কথাও বলছে যে, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কোন যুদ্ধ বাধলে তারা সৌদি আরবের পক্ষ নেবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হলে দুর্ভাগ্যজনক, নির্মম ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি থেকে কেউ রেহাই পাবে না। শুধুমাত্র ব্রিটিশ তেলকোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাণিজ্য খর্ব করে ইরানী তেলক্ষেত্রগুলোকে রাষ্ট্রীয়করণ করার মধ্য দিয়ে ইরানী জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে কাজে লাগানোর চিন্তা করেছিলেন বলেই ১৯৫৩ সালে ইরানের ইতিহাসের প্রথমবারের মত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল সিআইএ এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। একইভাবে মিশরে ফেরাউনের যুগ থেকে চারহাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকেও মাত্র এক বছরের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত করেছিল মার্কিন সমর্থনপুষ্ট মিশরীয় সেনাবাহিনী। মধ্যপ্রাচ্যে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক মোহাম্মদ মোসাদ্দেক সফল হলে, সাদ্দাম হোসেনকে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররোচনা না দিলে, পশ্চিমা মদদপুষ্ট তথাকথিত বিদ্রোহে গাদ্দাফিকে হত্যা করা না হলে, সিরিয়ার জনগণকে তাদের নেতা নির্বাচনের সুযোগ দিলে এবং মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে গণতন্ত্র বিকাশের সুযোগ অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যই হতো বিশ্বের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাদপীঠ। বিশ্বের কোন পরাশক্তির পক্ষে উম্মাহর ভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী মধ্যপ্রাচ্য বা কোন মুসলিম দেশকে বশংবদ পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব ছিল না। পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র ও প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হয়ে চীন, রাশিয়া ও ইরানের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর শাসকরা স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হলে ইসলামী দুনিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সেই সম্ভাবনাকে বিশ্বের শতকোটি দরিদ্র মুসলমানের ভাগ্যোন্নয়ন ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগানো সম্ভব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।