বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের কাহিনী নতুন ফেতনা নয়। এ ফেতনার গুরু ঠাকুর ইহুদি আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ছিল মদিনার অধিবাসী। হিজরতের পর এ মোনাফেক মুসলমানের রূপ ধারণ করে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোপনে যেসব অপপ্রচার চালিয়েছিল, ইতিহাসে তার বিশদ বিবরণ লিখিত রয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে সব আন্দোলন ও ফেতনা ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য শুরু করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়ঙ্কর ছিল মিথ্যা নবুওয়াতের দাবি ও মোরতাদ ফেতনার পরে ‘রাফেজিদের’ উৎপাত ও ফেতনা। একই সাথে যুক্ত হয়েছিল ইবনে সাবার ফেতনা সে ছিল ‘আহলে বায়াত’ এর ফাজায়েল তথা গুণকীর্তণ করে তাদের আশ্রয় গ্রহণের চেষ্টা করে। সে আহলে বায়ত হতেও সাহাবায়ে কেরামকে আলাদা আলাদা শ্রেণিতে বিভক্ত করার প্রয়াস চালায়। অতঃপর এ ফেতনা প্রসারিত হতে থাকে।
এ ফেরকা সুযোগ পেলেই মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে ত্রুটি করেনি এবং যখনই তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে, সে সুযোগেরও পূর্ণ সদ্বব্যবহার করেছে। তারা বায়তুল্লাহর উপর হামলা চালিয়েছে, ‘হাজরে আসওয়াদ’ (কালো পাথর) উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে, মুসলমানদের গণহারে হত্যা করেছে, হাজীদের লাশ দিয়ে ‘জমজম’ কূপ ভর্তি করেছে, উলামাকে শহীদ করেছে। এসব রক্তাক্ত মর্মান্তিক ঘটনা ছিল তাদের অপকীর্তির নিদর্শন।
রাফেজিদের পূর্বে কোনো অমুসলিম লেখক কুরআন ও সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে ছিল বলে জানা যায় না। রাফেজিদের বিভিন্ন ফেরকা রয়েছে যাদের পরিচয় দেয়া এ ক্ষেত্রে আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের সম্পর্কে এতটুকু বলে রাখা দরকার যে, মোহাক্কেক উলামার মতে, তাদের আকিদা বিশ্বাস হচ্ছে, কুরআনের আয়াতগুলো কম অথবা কিছু আয়াত লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর কয়েক ব্যক্তি ছাড়া সকল সাহাবা মুরতাদ হয়ে গিয়েছিলেন অথবা ফাসেক (পাপাচারী) হয়ে গিয়েছিলেন (নাউজুবিল্লাহ) ইত্যাদি। এখানে সেই পুরানো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করেও বলা যায় যে, রাফেজি ও তাদের মতাদর্শী, অনুসারীদের ইসলামবিরোধী অপপ্রচার-অপতৎপরতা সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে যেমন ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি অমুসলিম ও পশ্চিমা লেখকগণও সেগুলো লুফে নেন এবং সেগুলো ইহুদি, খ্রিষ্টান, নাস্তিকদের ও দালিলিক অস্ত্র হিসেবে তারা ব্যবহার করতে থাকেন এবং আরো নতুন নতুন ও অভিনব অপপ্রচারগুলো সংযোজন করতে থাকেন। ইসলাম, মুসলমান, কুরআন এবং হাদিস বিরোধী অপপ্রচারণাময় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণির নামে মুসলমান তা পাঠ করে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়ে উঠছে।
এ ভূমিকার আলোকে আমরা বলতে পারি, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার, মিথ্যাচার, বিভ্রান্তি ও নানা প্রকারের সংশয় ছড়ানো তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এ শ্রেণির লোক নানা ভাগে বিভক্ত। যথা- মুসলমান নামধারী বিভ্রান্ত বহু প্রকারের ফেরকা, গোষ্ঠী, দল এবং ‘উলামাসু’ ইত্যাদি ও অমুসলিম পশ্চিমা বা ইউরোপীয় খ্রিষ্টান পন্ডিত লেখক, সাংবাদিক, ইসলামবিদ্বেষী এবং মোনাফেক, নাস্তিক এবং ইহুদি, মোনাফেক ও পুত্তলিক প্রভৃতি রয়েছে।
প্রথমেই বলে রাখা দরকার, শুরু থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি যারা ক্ষতি সাধন করেছে তারা অমুসলিম কেউ নয়, তারা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী, তারই উম্মত ‘বাহাত্তর বিভ্রান্ত ফেরকা’ ও তাদের অনুসারী এবং তাদের থেকে উদ্ভ‚ত আরো শতশত ফেরকা দুনিয়াময় বসবাসকারী মুসলিম জনপদগুলোর মধ্যেই ইসলামের রূপ ধারণ করে আছে। এ গোমরাহ (বিভ্রান্তরা) ইসলামের বিকৃতি, অপব্যাখ্যা, কুৎসা রটনা, সংশয়, সন্দেহ সৃষ্টি এবং অপপ্রচারের তুফান সৃষ্টি করে রেখেছে। আর হুজুর (সা.)-এর ঘোষিত ‘ফেরকায়ে নাজিয়া’ ভুক্ত ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আছহাবি’ এর খাটি অনুসারী দল ও সম্প্রদায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের হক্কানি ওলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখ বুজুর্গাণ তাদের সকল অপপ্রচার-অপকর্মের দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে আসছেন।
এই বাস্তবতাও স্মরণযোগ্য যে, কুরআন, হাদিস এবং ফেকাহ ইত্যাদি ইসলামের সকল মৌলিক শাস্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সংক্রান্ত কিতাবাদী আরবি ভাষায় রচিত হওয়ার কারণে আরবিবিদগণই সেগুলো সরাসরি বুঝতে পারতেন, রচনা করতে পারতেন। আগেকার যুগের লেখক, সঙ্কলকদের রচনাবলি পরবর্তীকালে দুনিয়ার প্রসিদ্ধ ভাষাগুলোতে ভাষান্তরিত হতে থাকে এবং সে সময় পর্যন্ত সৃষ্ট ধর্মীয় মতবাদগুলোও প্রত্যেক ভাষা-ভাষী অবগত হতে পারে। বিদেশি অমুসলিম কিছু সংখ্যক পন্ডিত ব্যক্তি আরবি ভাষা আয়ত্ত করে অনেক মৌলিক আরবি গ্রন্থ তাদের নিজ নিজ ভাষায় অনুবাদ করেন এবং তারা ইসলাম সংক্রান্ত নানা বিতর্কিত বিষয়কে সম্বল করে সেগুলোকে একদিকে যেমন ফুঁলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করতে থাকেন, তেমনি অপরদিকে তাদের রচনাবলির মাধ্যমে ইসলাম, ইসলামের নবী এবং কুরআন সম্পর্কেও নানা বিকৃতি, অপপ্রচার এবং কুৎসা রটনা করতে থাকেন। ইসলামবিদ্বেষীরা এ সুযোগ কখনোই হাতছাড়া করেনি।
যদি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিকে খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা ও মদিনা জীবনে ২৩ বছরের নবুওয়াত যুগের প্রতি তাকানো হয়ম তখন দেখা যাবে মক্কার কাফের-কোরেশ, মদিনার ইহুদি-মোনাফেক এবং খ্রিষ্টানরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার-ষড়যন্ত্রের যে দীর্ঘ জাল বিস্তার করেছিল; ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।