Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্যসেবার নতুন দিগন্ত নবজাতকের নিরাপত্তায় উঠান বৈঠক

প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শাহনাজ বেগম : সুজন ও সোনালীর সংসারে নতুন অতিথি আসছে। তারা দু’জনে একসাথে গর্ভকালীন সময়ের শুরু থেকেই প্রতিদিন কিছু টাকা জমায়। এখন সংসারে হিসাব করে টাকা খরচ করে সুজন। জরুরী প্রয়োজনে যানবাহন ও রক্তদাতার ফোন নাম্বার লিখে রাখে তারা। যেকোন ধরনের জটিলতা এড়ানোর জন্য সোনালী, তার শাশুড়ি এবং সুজন আলোচনা করে হাসপাতালে ডেলিভারী করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারপরও জরুরী প্রয়োজনের কথা ভেবে সোনালীর শাশুড়ি স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রসব সহায়তাকারী হনুফা আপার সাথে কথা বলে রাখে। কারণ সোনালী ও সুজনের পরিবার জানে যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছানোর দেরি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সেবা পেতে দেরি হলে গর্ভবতীর যেকোন বিপদ হতে পারে। জীবন বাঁচাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ৩ দেরি রোধ করতে শিখেছে কমিউনিটি হেলথ ভলেন্টিয়ার রাজিয়া সুলতানার কাছ থেকে সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নবাসী। কারণ, এই ৩টি দেরির মধ্যে যে কোন একটি দেরি হলেই গর্ভবতী ও নবজাতকের মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা থাকে। তাই কেবল সঠিক প্রসব পরিকল্পনা করেই গর্ভবতী ও নবজাতকের সুস্থ জীবন নিশ্চিত করা যায়। রাজিয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মা ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গর্ভবতী মায়েরা শিখছেন গর্ভে থাকা সন্তানের পুষ্টি সম্পর্কে। গর্ভ, প্রসব ও প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের প্রধান ৫টি বিপদচিহ্ন সম্বন্ধে সতর্ক করে এবং সচেতন থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন গ্রামবাসীকে। গ্রামের গর্ভবতী মায়েরা ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে শিখেছেন।
গ্রামবাসীর স্বাস্থ্য সচেতনতায় প্রতি মাসে একবার উঠান বৈঠক বসে। ৩০৫টি বাড়িতে বৈঠক হয়, স্থানীয়ভাবে এগুলোকে ‘খানা’ বলা হয়। প্রতিটি উঠান বৈঠকে অংশ নেয় প্রায় ৩০- ৩৫ জন নারী-শিশু। বৈঠকে যারা আসেন না বা আসতে পারেন না, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও স্বাস্থ্য সম্বন্ধে পরামর্শ দেয়া হয়। উঠান বৈঠকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে পাড়ার গর্ভবতী নারীর দিকে। যেসব বাড়িতে প্রসূতি রয়েছে, সেই প্রসূতির বাড়িতেই উঠান বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয় বলে জানালেন হেলথ ভলেন্টিয়ার রাজিয়া সুলতানা।
ঊঠন বৈঠক প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বা একই বাড়িতে হয় না। এ মাসে এই বাড়ি তো পরের মাসে অন্য বাড়ি। অবশ্য সেটা নির্ভর করে গ্রামের গর্ভবতী নারীর অবস্থানকে কেন্দ্র করে। সাধারণ সমস্যাগুলো নিয়ে উঠান বৈঠকে আলোচনা করায় গ্রামবাসীরা স্বাস্থ্য-সুরক্ষার কৌশল জানতে সক্ষম হয়েছে। মা ও শিশু যাতে নিরাপদ থাকে সেজন্য বাড়ি বাড়িতে এ আয়োজন। এর ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে যা ইতিবাচক।
সরেজমিনে গ্রামের স্বাস্থ্য পরামর্শ দেয়ার চিত্র দেখা গেল সিরাজগঞ্জের বেড়াবাড়ির বহলি ইউনিয়নের ধীপপুর গ্রামের নারীদের উঠান বৈঠকের। উঠনে গোল হয়ে বসে স্বাস্থ্যকর্মীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে ৪০ বছর বয়সী গোলনূর বেগম একজন। তিনি ভাল করেই জেনেছেন গর্ভবতী নারীর পাঁচটি বিপদচিহ্ন। গোলেনুরের মেয়ে গর্ভবতী। তাকে দিনে দুই ঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ করে দেন তিনি। সাথে নিয়মিত আয়রন ট্যাবলেট খাওয়াচ্ছেন। তিনি আরো জানেন, শিশুর জন্মের পরও মাকে দিনে একটা করে তিনমাস এই ট্যাবলেট খেতে হবে, যাতে রক্তস্বল্পতা দেখা না দেয়। এছাড়াও প্রসব পরবর্তী সময়ে নিয়ম করে ৪ বার চেক আপ করাতে হবে এবং তিনি জানেন অবশ্যই প্রথম চেক আপটা শিশু জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই হতে হবে। গোলনূর বেগম আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন, প্রসবের সময় হলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তার মেয়েকে কোন ভ্যানে নিয়ে যাবেন এবং সেখানে প্রসব করানো হবে কার হাতে।
গর্ভবতী মায়েদের হাশিখুশি থাকতে হবে বলে জানালেন, উঠান বৈঠকে উপস্থিত অন্য আরেকজন গ্রামবাসী রাজিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, বাড়িতে গর্ভবতী নারীর ভালভাবে যতœ নেয়ার কাজটা করা উচিত তার শাশুড়ীর। বাড়ীর গর্ভবতী বউকে প্রতিদিন আয়রণ বড়ি খাওয়া এবং দিনে দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ করে দেয়া উচিত গর্ভবতীর শাশুড়ীর। পাশাপাশি গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ, খিচুনি, চোখে ঝাঁপসা দেখলে নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়ার কথাও জানেন, বলে জানালেন রাজিয়া। রক্ত পরীক্ষা, টীকা নেয়াসহ প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি। এছাড়াও একজন কিশোরীকে ১৫ বছর থেকে টিটি টিকা নেয়ার প্রয়োজনীয়তা জানেন তারা। ২৮ দিন পরপর এই টিকা ২ বছর ৭ মাসে ৫টি টিকার ডোজ পূর্ণ করার নিয়ম জানেন তারা। তার প্রতিবেশীরাও শিখেছে কিভাবে বাল্যবিয়ে বন্ধ করা যায় এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য উন্নত স্যেনিটেশন ব্যবস্থা। তিনি জানান, এক সময় এ অঞ্চলে খোলা শৌচাগার বেশি থাকলেও এখন সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একটি বাড়ির খোলা শৌচাগার পুরো গ্রামবাসীর অসুস্থতার কারণ হতে পারে, সেটা এখন এলাকাবাসী জানেন।
জন্মের পরপরই নবজাতককে পরিষ্কার করা ও তিনদিন পরে শিশুকে গোসল করানো, ১ ঘন্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো এবং ১ মিনিটের মধ্যে বাচ্চা শ্বাস নিচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করা দরকার বলে জানালেন জেলা সদরের ফ্যামিলি প্লানিং অফিসার মাসুমা খাতুন সফটি। তিনি আরো জানালেন শিশু জন্মের প্রথম মিনিটকে ‘গোল্ডেন মিনিট’ বলা হয়।
গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৮ সালে সারাদেশে ১০ হাজার ৬শ’ কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮১৫টি তে। তারমধ্যে ৯শ’ কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব করানোর ব্যবস্থা আছে। এ পর্যন্ত গ্রামীণ জনগণের মাঝে ৫৬৮ কোটি টাকা মূল্যের ৩০ ধরণের ঔষধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত এক জরিপ অনুযায়ী ৩৫ কোটি বারের বেশি ভিজিটের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ সেবা গ্রহণ করেছে। সবচেয়ে খুশির খবর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ল্যাপটপের মাধ্যমে তথ্যসেবা ব্যবস্থ্যা চালু করা হয়েছে।
মা-শিশুর কল্যাণে ৬টি উদ্যোগ যেমন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জন্মনিবন্ধন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, বাল্যবিবাহ রোধ এবং পুষ্টি সম্পর্কে সরকারের কর্মকাÐগুলোতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে থাকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ। এসব তথ্য জানালেন ইউনিসেফের বগুড়া জোন অফিসের প্লানিং এন্ড ইনফরমেশন প্রোগ্রাম অফিসার নিলুফার আলম ডেইজি।
তিনি জানান, প্রসব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সেবা, সেনিটেশন সম্বন্ধে সচেতনতা, ভিটামিন খেলে বাচ্চা বড় হয়ে যায় এবং ডেলিভারীতে সমস্যা হয় সেই মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। দক্ষ ধাত্রী দ্বারা ডেলিভারির সংখ্যা বেড়েছে এবং যাদের ২টি সন্তান আছে তারা আর সন্তান নিবে না এটা এখন বুঝতে পেরেছে। তারা যেকোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় কমিউনিটি ক্লিনিকের দ্বারস্থ হতেও ভুল করেন না ।
বেলকুচি উপজেলার ভাংগাবাড়ী কমিউনিটি ক্লিনিকটি ছোট্ট হলেও জরুরি সব স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। সিরাজগঞ্জের এইচএমআইএস কনসালট্যান্ট শিলা সরকার বলেন, ২৯টি হেলথ-আইটেম দেয়া হয় এসব ক্লিনিকে। প্রয়োজনে রোগীকে উপজেলা কমপ্লেক্সে রেফার করা হয়। প্রতি ছয় হাজার বাসিন্দার জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত এটি খোলা থাকে। একজন হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট, একজন এফডবিøউএ থাকেন, যারা একদিন পর একদিন করে সেবা দেন। সিএইচসিপি হিসেবে কাজ করছেন, বিউটি রানী পাল। সপ্তাহের ছয়দিনই সেবা দিযে থাকেন বিউটি রানী । তিনি জানান, প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন রোগী সেবা নিতে আসেন। এমন ক্লিনিক বেলকুচি উপজেলায় ৩৬টি রয়েছে যোগ করলেন উন্নয়ন সংঘের সিরাজগঞ্জে জেলার প্রকল্প পরিচালক মো. শরীফউদ্দিন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে অর্থাত ল্যাপটপের মাধ্যমে প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে তথ্যসেবা ব্যবস্থ্যা চালু করা হয়েছে। এখানে রোগীর নাম একং রোগের পূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধ করা থাকে। তাছাড়া প্রয়োজনে সিএইচসিপি জেলা শহরের হাসপাতালের সাথে নিজের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের যোগাযোগ করতে পারে বা উন্নত সেবা দেয়ার পরামর্শ নিতে পারে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন সচেতনতায় সুস্থ আছে এলাকার মা-শিশু। তা সত্তে¡ও কিছু কিছু ব্যতিক্রম ঘটনাও ঘটছে। জর্ডান প্রবাসী ছেলের সাথে স¤প্রতি কিশোরী রুমার বাল্যবিয়ে। রুমা তার বয়স ১৮ বছর বললেও বোঝা যায় বিয়ের বয়স হতে রুমার এখনও বাকি। কোনো কোনো বাবা-মা মেয়ের ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা করলেও, কেউ কেউ আবার ‘ভালো পাত্র’ পেলে বিয়ে দিয়ে দিতে চান- জানালেন উঠান বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন। এমন মা-বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন উঠান বৈঠকের সচেতন নারীরা। অল্প বয়সে বিয়ে মানে অল্প বয়সে সন্তানসম্ভবা, সন্তানের জন্মের সময়টুকুতে কমবয়সী মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি থাকে। জীবিত থাকলেও অনেক জটিলতা নিয়ে বাঁচতে হয় তাদের। শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ও চেহারায় রক্তস্বল্পতার লক্ষণ সুস্পষ্ট রুমাকে এখনই সন্তান নিতে নিরুৎসাহিত করছিলেন কমিউনিটি হেলথ প্রতিনিধি রাজিয়া সুলতানা। ঠিক বয়সে সন্তান নিলে দু’জনেই সুস্থ থাকবে বলে বোঝানো হয় রুমাকে। কুফল জেনেও শতভাগ বাল্য বিয়ে রোধ করা প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্ভব হচ্ছেনা ঠিকই তবে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে তারা আশাবাদী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাস্থ্যসেবার নতুন দিগন্ত নবজাতকের নিরাপত্তায় উঠান বৈঠক
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ