বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ব্যবসা-বাণিজ্যে, বেচা-কেনা, লেন-দেনে এবং সামাজিক নানা কাজ-কারবারে ওজন ও পরিমাপের প্রয়োজন অপরিহার্য। আমাদের দেশে হিসাব ও ওজন মাপের জন্য নানা প্রকারের ব্যবস্থার মধ্যে দাঁড়িপাল্লা তথা পরিমাপযন্ত্র প্রচলিত। কিন্তু একশ্রেণীর অসাধু বিক্রেতা ক্রেতাসাধারণকে ওজনে সুকৌশলে কম দিয়ে থাকে। বেচার সময় ওজনে কম দেয়া এবং কেনার সময় ওজনে বেশি নেয়ার দৃষ্টান্তের অভাব নেই। এ ধরনের কারবার নৈতিকতাবিরোধী তো বটেই, একজনের স্বার্থ বা অধিকার হরণেরও শামিল, যা ইসলামে নিষিদ্ধ। হজরত শোয়েব (আ:) কওম ধ্বংস হয়েছিল এই পাপে।
‘শায়খুল আম্বিয়া’ ও ‘খতীবুল আম্বিয়া’ নামে খ্যাত হজরত শোয়েব (আ:) হেদায়েতের জন্য তিনটি সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের অভিমত। সম্প্রদায়গুলো হচ্ছে, ‘আহলে মাদয়ান’, ‘আসহাবে আইকা’ এবং ‘আসহাবে রাস্’। কোরআনে যেসব সূরায় শোয়েব (আ:)-এর কথা উল্লেখিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সূরা আরাফ, সূরা হুদ, সূরা শোআরা এবং সূরা আনকাবুত ‘মাদয়ান’বাসীরা যে এলাকায় বাস করত, তা ছিল অত্যন্ত সবুজ-শ্যামল এবং অধিক ফসল উপযোগী। তাই ওরা ছিল খুবই সম্পদশালী, ধনী এবং খোশহাল। তাই ওরা অল্পে তুষ্ট থাকত না।
ওরা যেমন ছিল বিত্তবান, তেমনি লোভী ও দুর্নীতিবাজও ছিল। ওরা জিনিসপত্র ও দ্রব্যাদির লেন-দেন ও বেচা-কেনায় কম-বেশি করত। ওরা জাল মুদ্রা প্রস্তুত করে লোকদের সাথে প্রতারণা করত। মোটকথা, ওরা হারামখোরী করত এবং ঘরে বসে বসে ‘লাত’ ও ‘মানাত’ মূর্তির পূজা করত। মাদয়ানবাসীদের এ হারাম উপার্জন ও মুফতখোরী এলাকার আর্থিক অবস্থা শোচনীয় করে তোলে। অনেকের মতে, আইকাবাসীদেরও একই অবস্থা ছিল।
হজরত মূসা (আ:)-এর শ্বশুর হজরত শোয়েব (আ:) ছিলেন অদ্বিতীয় বক্তা- খতীব। তিনি মূর্তিপূজক ও ওজনে কারচুপিকারী মাদয়ান ও আইকাবাসীদের এ অপকর্ম থেকে বিরত থাকার যতই অনুরোধ জানাতে থাকেন, ততই ওরা নবীর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে। বলে, ওরা পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করবে না। জিনিসপত্রের পরিমাপ ও ওজন সম্পর্কে বলে, এটি আমাদের মাল, আমরা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করব, তা কমানো- বাড়ানোর অধিকার আমাদের রয়েছে। ওরা নবীর আহ্বানে সাড়া দেওয়া তো দূরের কথা, নবীকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। এমনকি তাকে দেশ থেকে বহিষ্কারের এবং তাকে হত্যা করারও হুমকি দেয়।
হজরত শোয়েব (আ:) অত্যন্ত অতীষ্ঠ হয়ে ওদের জন্য বদ দোয়া করেন। তিনি তার ঈমানদার লোকদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। এতে তারা হাসি-ঠাট্টা করতে থাকে। অতঃপর ভীষণ গরম পড়তে শুরু করে এবং ক্রমে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। ঝর্ণা ও ক‚পগুলোর পানি এতই গরম হয়ে যায় যে লাগাতার ৭ দিনের প্রচন্ড গরমে গোটা শহর জাহান্নামে পরিণত হয়। অতঃপর একটি ভয়ঙ্কর শব্দে তারা সবাই ধ্বংস হয়।
সূরা তাতফীক এর প্রাথমিক আয়াতগুলোতে ওজন ও পরিমাপে বেশ-কম করার পরিণতির কথা বলা হয়েছে। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে, নাকি মদীনায় এ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। এ মতভেদের কারণ হিসেবে বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) যখন মক্কা হতে হিজরত করে মদীনায় পৌঁছেন তখন সেখানকার লোকদের দেখতে পান তারা ওজনে ও পরিমাপে বেশ-কম করে।
সর্বপ্রথম একটি মজলিসে তিনি লোকদের কোরআন শোনান এবং তাদের অবস্থা অনুযায়ী সময়োপযোগী এ সূরাটি শোনান যাতে প্রচলিত দাঁড়িপাল্লা ও পরিমাপযন্ত্র বেশ-কম করার কঠোর নিন্দা রয়েছে। এ কারণে লোকেরা মনে করতে থাকে যে, সূরাটি মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। (হক্কানী)
এ বর্ণনার পর আল্লামা হক্কানী অভিমত ব্যক্ত করেন যে; ‘সোবহানাল্লাহ! কি আকর্ষণীয় ওয়াজ ছিল? সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত মদীনাবাসীদের অপেক্ষা কোনো জনপদ পূর্ণ মাপে বা ওজনে সমকক্ষ নেই, তৎক্ষণাৎ সবাই সে কাজ ছেড়ে দেয়।’কোনো কোনো তাফসিরে আয়াতগুলোর শানে নুজুল সম্পর্কে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা:) যখন মদীনায় হিজরত করেন তখন দেখতে পান সেখানকার লোকরা ওজনে খেয়ানত করত।
বিশেষভাবে আবু জুহায়নাহ নামক এক ব্যক্তি এমন ছিল যে সে দু’ধরনের পরিমাপ রাখত। একটি নেয়ার এবং অন্যটি দেয়ার। এসব লোকের সম্পর্কে আয়াতগুলো নাজিল হয়েছে এবং তাদের সঠিকভাবে ওজন করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এবার দেখা যাক কোরআন ও হাদিসে এ সম্পর্কে কি বলা হয়েছে। সূরা ‘শোআরা’-এ বর্ণিত রয়েছে, ‘মাপ পূর্ণ করো এবং যারা পরিমাণে কম দেয় তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। সোজা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। মানুষকে তাদের বস্তু কম দিও না এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করে ফিরো না।’ (আয়াত: ১৮১-১৮৩)
সূরা ‘তাত্ফীক’-এ বলা হয়েছে, ‘যারা মাপে কম করে, তাদের জন্য দুর্ভোগ, যারা লোকের কাছ থেকে যখন নেয়, তখন পূর্ণমাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদের মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে?’ (আয়াত: ১-৪) সূরা ‘আনআম’-এ আল্লাহ বলেন, ‘যে ওজন করে দেবে, সে প্রতিপক্ষকে কম দেবে না এবং প্রতিপক্ষ নিজ প্রাপ্যের চেয়ে বেশি নেবে না।’ (আয়াত: ১৭২)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।