Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জিম্বাবুয়ের কাছেও সাড়ে তিন দিনেই হার!

আরো একটি ব্যাটিং ব্যর্থতার গ্লানি

ইমরান মাহমুদ, সিলেট থেকে | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০১৮, ১১:৩৭ এএম | আপডেট : ৪:৩০ পিএম, ৬ নভেম্বর, ২০১৮

রেকর্ড গড়া জয়ের চ্যালেঞ্জ। সেই লক্ষ্যে ভালোই পথ দেখাচ্ছিলেন দুই ওপেনার ইমরুল-লিটন। তবে সেই স্বপ্ন রূপ নেয় বিষাদে। আরো একটি ব্যাটিং ব্যার্থতার গ্লানি নিয়ে হারের বৃত্ত ভাঙা হলো না বাংলাদেশের।

দুই ইনিংসেই বাংলাদেশের ব্যাটিংকে গুঁড়িয়ে দিয়ে দেশের বাইরে ১৭ বছর পর টেস্ট জিতল জিম্বাবুয়ে। প্রতিপক্ষের মাঠে তাদের সবশেষ জয়টিও ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০০১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রাম টেস্টে জিম্বাবুয়ে জিতেছিল ৮ উইকেটে। দেশের বাইরে এটি তাদের তৃতীয় জয়। জিম্বাবুয়ের অন্য জয়টি পেশাওয়ারে, ১৯৯৮ সালে পাকিস্তানকে তারা হারিয়েছিল ৭ উইকেটে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

জিম্বাবুয়ে ১ম ইনিংস: ২৮২।

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৪৩।

জিম্বাবুয়ে ২য় ইনিংস: ১৮১।

বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ৩২১) ৬৩.১ ওভারে ১৬৯ (লিটন ২৩, ইমরুল ৪৩, মুমিনুল ৯, মাহমুদউ্ল্লাহ ১৬, শান্ত ১৩, মুশফিক ১৩, আরিফুল ৩৮, মিরাজ ৭, তাইজুল ০, অপু ০, আবু জায়েদ ০*; জার্ভিস ১৪-৫-২৯-১, চাটারা ৯-২-২৫-০, রাজা ১৭-১-৪১-৩, উইলিয়ামস ৮-২-১৩-০, মাভুটা ১০-২-২১-৪, ওয়েলিংটন ৫.১-০-৩৩-২)।

ফল: জিম্বাবুয়ে ১৫১ রানে জয়ী।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ: সিন উইলিয়ামস (জিম্বাবুয়ে)।

সিরিজ : ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে েজিম্বাবুয়ে।

রানের খাতা খোলার আগেই তাইজুল ইসলামকে ফিরিয়ে নিজের প্রথম টেস্ট উইকেট নিয়েছেন ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। বাঁহাতি স্পিনারকে ছক্কায় উড়াতে চেয়েছিলেন তাইজুল। টাইমিং করতে পারেননি, লং অনে সহজ ক্যাচ মুঠোয় নিতে কোন কষ্টই করতে হয়নি ব্রেন্ডন টেইলরকে।

মেহেদী হাসান মিরাজকে ফিরিয়ে নিজের তৃতীয় টেস্ট উইকেট নিয়েছেন ব্র্যান্ডন মাভুটা। দ্বিতীয় সেশনের মধ্যে জয় তুলে নেওয়ার আশা জাগায় জিম্বাবুয়ে। লেগ স্পিন পা বাড়িয়ে ডিফেন্স করতে চেয়েছিলেন মিরাজ। স্পিন করে বেরিয়ে যাওয়া বল তার ব্যাটের কানা ছুঁয়ে জমা পড়ে রেজিস চাকাভার গ্লাভসে। ১৫ বলে ৭ রান করে ফিরেন মিরাজ।

মুশফিকুর রহিমকে ফিরিয়ে জিম্বাবুয়েকে জয়ের আরও কাছে নিয়ে গেছেন ব্র্যান্ডন মাভুটা। লেগ স্পিনারকে আগের ওভারে সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটে-বলে করতে পারেননি মুশফিক। পরের ওভারে ব্যাটে -বলে করতে পারলেন কিন্তু খেলতে পারলেন না ঠিক মতো। ব্যাটের কানায় লেগে ডিপ স্কয়ার লেগে যায় ক্যাচ। ঝাঁপিয়ে দুই হাতে ক্যাচ মুঠোয় নেন ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। ৪ বলে ১৩ রান করেন মুশফিক।

এর আগে সিকান্দার রাজার স্পিন ভেল্কিতে দুই ওপেনারের সঙ্গে ফিরেন অধিনায়কও। মাঝে মুমিনুলকে ফিরিয়েছে জারভিস, ফেরার কাতারে যোগ হয়েছে শান্তর নামও। সিলেটের অভিষেক টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে লাঞ্চ বিরতিতে যাবার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে রেকর্ডগড়ে জয়ের সে স্বপ্ন, ৪৬.৫ওভার শেষে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশের সংগ্রহ ১১১।

ইমরুল কায়েস ও লিটন দাসের সতর্ক ব্যাটিংয়ে চতুর্থ দিনের শুরুটা ভালো করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ তত দৃঢ় হয়েছে জিম্বাবুয়ের। প্রথম সেশনেই তুলে নিয়েছে স্বাগতিকদের পাঁচ উইকেট।

লাঞ্চ থেকে ফিরে মুশফিকুর রহিম (১৩), মেহেদী হাসান মিরাজ (৭) আর তাইজুল ইমলামের (০) বিদায়ে সেই শঙ্কট আরো বেড়েছে স্বাগতিকদের। মাভুতার বলে সিকান্দারের ক্যাচে পরিণত হবার আগে ১৬ রান করেন নাজমুল হোসেন শান্ত।

আজ মঙ্গলবার দ্বিতীয় ইনিংসে শুরুর জুটিতে বাংলাদেশ পেল সিলেট টেস্টে নিজেদের প্রথম পঞ্চাশ রানের জুটি। সতর্ক ব্যাটিংয়ে দলকে এগিয়ে নিচ্ছেন ইমরুল কায়েস ও লিটন দাস। ২১তম ওভারের শেষ বলে ইমরুলের সিঙ্গেলে পঞ্চাশে যায় উদ্বোধনী জুটির রান। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জুটি ছিল ৩০ রানের।

জুটির রান পঞ্চাশ ছোঁয়ার আগে দুটি সুযোগ হাতছাড়া করে জিম্বাবুয়ে। পঞ্চদশ ওভারের শেষ বলে আসে প্রথম সুযোগ। সিকান্দার রাজার বল বাড়তি টার্ন করে লিটনের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে ক্যাচ যায় শর্ট লেগে। কিন্তু ব্রায়ান চারি সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি। সে সময় ২১ রানে ব্যাট করছিলেন লিটন।

চার ওভার পর আবার আসে সুযোগ। কাইল জার্ভিসের বলে ঠিক মতো কাট করতে পারেননি ইমরুল কায়েস। প্রথম স্লিপে থাকা হ্যামিল্টন মাসাকাদজা মুঠোয় জমাতে পারেননি ক্যাচ। উল্টো বাউন্ডারি পেয়ে যান ইমরুল। বাঁহাতি এই ওপেনার তখন ছিলেন ২২ রানে।

তবে সেই স্বস্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি স্বাগতিক শিবিরে। লিটন দাসকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে বাংলাদেশের শুরুর জুটির প্রতিরোধ ভাঙেন সিকান্দার রাজা। অফ স্পিনারের বলের লেংথ বুঝতে ভুল করেন লিটন। স্টাম্পের সাদামাটা বল পুল করতে গিয়ে লাইন মিস করে ব্যাটে খেলতে পারেননি এই ওপেনার।

আম্পায়ার এলবিডব্লিউ না দিলে রিভিউ নেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। বল ট্র্যাকিংয়ে দেখা যায় বল লাগতো মিডল স্টাম্পে। পাল্টায় সিদ্ধান্ত, ৫৬ রানে প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ৭৫ বলে তিন চারে ২৩ রান করেন লিটন।

ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে মুমিনুল আউট হলেন বাজে শটে। প্রথম বলেই সিকান্দার রাজাকে চার মেরেছিলেন এই টেস্ট ভরসার। পরে তাকেই আবার চার মেরেছেন মাথার ওপর দিয়ে। কিন্তু আউট হলেন কাইল জার্ভিসের বলে, যে বলটি না খেলে ছাড়তে পারতেন অনায়াসেই। লেংথ থেকে একটু বাড়তি লাফানো বল বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পজিশনে না গিয়েই ব্যাট পেতে দিলেন মুমিনুল। কানাল লেগে বল গুড়িয়ে দিলো স্টাম্প। আরেকটি বাজে টেস্ট স্মৃতি নিয়ে থামেন মাত্র ৬ রান করে।

এরপর মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে এই বিপর্যয় সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন ইমরুল। তবে আগের দিন থেকে টানা বোলিং করে যাওয়া সেই সিকান্দারই বোল্ড করে থামান এই ওপেনারকেও। রাজাকে ভালো মতোই সামাল দিচ্ছিলেন বাঁহাতি এই ওপেনার। ফিরে গেলেন অফ স্পিনারকে অপ্রয়োজনীয় প্যাডেল সুইপ করতে গিয়ে। লেগ স্টাম্পের ফুল লেংথ বলে ইমরুল ঠিক মতো ব্যাটে লাগাতে পারেননি। গ্লাভসে লেগে বল উপড়ে ফেলে তার লেগ স্টাম্প। ১০৩ বলে ৪৩ রান করে ফিরেন ইমরুল।

আবারও নিজের উইকেট ছুড়ে এলেন মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশ অধিনায়ক ফিরলেন সিকান্দার রাজার অফ স্পিনে বাজে এক শটে। সুইপ করবেন না ডিফেন্ড করবেন এ নিয়ে দ্বিধায় মাহমুদউল্লাহ খেলেন অদ্ভুত শট। বলে ছোঁয়াতে পারেননি ব্যাট। গ্লাভসে ছুঁয়ে শরীরে লেগে সহজ ক্যাচ যায় শর্ট লেগে বদলি ফিল্ডার ক্রেইগ আরভিনের কাছে। ৪৫ বলে ১৬ রান করে ফিরেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।

শুরু থেকেই স্পিনাররা রাজত্ব করছে সিলেটের আনকোড়া উইকেটে। জিম্বাবুয়ে দলের যেকম স্পিনার, সেরকম বল নিত্যদিনর ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে বেড়ায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। তবে আত্মাহুতির মিছিল একের পর এক যেভাবে সামিল হচ্ছেন, তাতে খুব শিগগিরই এই টেস্টের শেষ দেখতে পাবার কথা।

রাজা-জারভিসের সঙ্গে এবার শিকারির ভুমিকায় ব্রান্ডন মাভুতা। নাজমুল হোসেন শান্তকে ফিরিয়ে টেস্টে নিজের প্রথম উইকেট নিলেন এই বাঁ-হাতি স্পিনার। বাজে বলে বাজে শটে ফিরেন তরুণ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ঠিক মতো গুগলি করতে পারেননি মাভুতা। সেই বলই তাকে এনে দেয় উইকেট। শর্ট বলে পয়েন্টে সিকান্দার রাজাকে ক্যাচ দেন ৩২ বলে ১৩ রান করা শান্ত। জয়ের পথে আরেকটু এগিয়ে দিলেন জিম্বাবুয়েকে। 

তৃতীয় দিন

প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট, জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসেরও তার শিকার ৫ উইকেট। প্রথমবারের মত ম্যাচে ছুঁলেন ১১ উইকেটের মাইলফলক। সিলেটে অভিষেক টেস্ট রাঙাতে একজন বোলারের যা যা করণীয় সেটিই করে দেখিয়েছে তাইজুল ইসলাম। তার ঘূর্নির যাদুতে গতকাল সোমবার দ্বিতীয় ইনিংসে মাসাকাদজার দল গুটিয়ে যায় ১৮১ রানে। তিন স্পিনারের ম্যাচে তিনটি উইকেট নেনি মেহেদী হাসান মিরাজ, আরেকজন নাজমুল ইসলাম অপুর ঝুলিতে জোড়া শিকার।

২ ম্যাচ সিরিজের প্রথমটি জিততে বাংলাদেশের চাই ৩২১ রান। রেকর্ড তাড়ার জবাবে দ্বিতীয় ইনিংসে সাবধানী শুরু করেছিলেন দুই ওপেনার লিটন দাস ও ইমরুল কায়েস। কোন রকম অঘটন ছাড়াই দিন পার করে স্বাগতিকরা। আলোকসল্পতার কারণে নির্ধারিত সময়ের ১৩.৫ ওভার আগে দিনের খেলা বাতিল করেন দুই আম্পায়ার। ১০.১ ওভার শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ ২৬। লিটন ব্যাট করছেন ১৪ রান নিয়ে, তার সঙ্গে ১২ রান নিয়ে আজ মঙ্গলবার চতুর্থ দিন শুরু করে মাহমুদউল্লাহর দল।

দেশের মাটিতে এত রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড নেই কোন দলেরই। সবচেয়ে বড় রান তাড়ার ইতিহাস আছে নিউজিল্যান্ডের দখেলে। ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের করা ৩১৭ রান পেরিয়ে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল কিউইরা। টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রান তাড়ার রেকর্ডটি এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ২০১৪ সালে এই জিম্বাবুয়েল বিপক্ষে ১০১ রানের লক্ষ্য টপকাতে পেরেছিল ৭ উইকেট হারানো মুশফিকুর রহিমের দল।

আগের রাতে সিলেটে হয়ে গেছে এর পষলা বৃষ্টি। তাতে যে উইকেটে প্রভাব ফেলে তা কাজে লাগিয়েই দিনের প্রথম আঘাতটা দেন মেহেদী হাসান মিরাজ। মাত্র ৪ রানে ব্রায়ান চারিকে সরাসরি বোল্ড করেন এই স্পিন অলরাউন্ডার। এরপরই আসে তাইজুল যাদু। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার আগেই ব্রেন্ডন টেলরকে ইমরুল কায়েসর তালুবন্দী করেন বাঁ-হাতি এ স্পিনার।

তবে দিনের সবচেয়ে বড় সাফল্যটা আসে মিরাজের হাত ধরে। আরেকটি ফিফটির মাত্র ২ রান আগে অাগে মাসাকাদজাকে এলবির ফাঁদে ফেলেন এই তরুণ তুর্কি। ১০৪ বলে তার ৪৮ রানের ইনিংসটি ৭টি চারে সাজানো।

পরপর দুই উইকেট হারিয়ে ছন্দে ফেরার ভিতও গড়ে ফেলেছিল জিম্বাবুয়ে। চতুর্থ উইকেটে সিন উইলিয়ামস আর সিকান্দার রাজার ২০ রানের জুটি ভাঙার কারিগর সেই তাইজুল। ২০ রান করা উইলিয়ামসকে ফেরান সরাসরি বোল্ড করে। পরের বলেই পিটার মুরকে ফিরিয়ে আবারও সম্ভাবনা জাগান আরেকটি হ্যাটট্রিকের। তবে সেটি না হলেও শিকারির শিকার থাকে অব্যহত।

এবার শিকার সিকান্দার রাজা, আরেকটি দুর্দান্ত বোল্ড। ২৫ রান করা এই অভিজ্ঞ জিম্বাবুইয়ানকে ফিরিয়ে প্রথমবারের মত টেস্টে ১০ উইকেট তুলে নেন তাইজুল। সেই সঙ্গে মাশরাফিকে বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় উঠে আসেন ৩ নম্বরে। ৭৮ উইকেট পেতে বর্তমানে টেস্ট না খেলা ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি যেখানে বোলিং করেছেন ৫১ ইনিংস, সেখানে এখন পর্যন্ত তাইজুলকে ২০ ম্যাচে ৭৯ উইকেট নিতে বোলিং করতে হয়েছে মাত্র ৩৫টি ইনিংসে।

তাইজুলের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে উইকেট ঝুলিতে পুড়ছেন মিরাজও। ৭ম উইকেটে চাকাভাকে নিয়ে দারুণ এক জুটির সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। তাকে এলবির ফাঁদে ফেলে ভাঙেন ৩৫ রানের সেই জুটি।

মাঝে নাজমুল ইসলাম অপুর জোড়া ধাক্কার পর শেষ উইকেটটিও তুলে ষোণ কলা পূর্ণ করেন তাইজুল। নাগ অপুর বলে ২০ রান করা চাকাভা তালুবন্দী হন মাহমুদউল্লার হাতে, তার আরেক শিকার মাভুতার ব্যাট থেকে আসে ৬ রান। এসেই দুটি চারের মারে ঝড়ো রান তুলতে চেষ্টায় থাকা তেন্ডাই চাতারাকে ফিরিয়ে প্রথম ইনিংসরে মতই ৫ নিয়ে দু’হাত উচিঁয়ে সতীর্থ আর গ্যালির দর্শকদের করতালির মাধ্যমে মাঠ ছাড়েন ১১ উইকেট শিকারি তাইজুল।

দ্বিতীয় দিন

প্রথম ইনিংসেও জিম্বাবুয়েকে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেননি তাইজুল। তার ঘূর্ণির যাদুতে প্রথম দিনের ২৩৬ রানের সঙ্গে আর মাত্র ৪৬ রান যোগ করেই শেষ হয় সফরকারীদের দ্বিতীয় দিনও। প্রথম ইনিংসে অলআউট হবার আগে মাসাকাদজার দল তুলতে পেরেছে ২৮২ রান। জিম্বাবুয়েকে গুড়িয়ে দিতে ১০৮ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট নেয়া এই বাঁ-হাতি স্পিনার হাত ঘুরিয়েছেনও সবচেয়ে বেশি, ৩৯.৩ ওভার।

জবাবে শুরু থেকেই বিপর্যয়ে বাংলাদেশ শিবিরও। ৫১ ওভার খেলতেই শেষে হয় বাংলাদেশের ইনিংস। অভিষিক্ত আরিফুল হক অপরাজিত আছেন ৪১ রানে। তাকে সঙ্গ দিতে ক্রিজে আসা লোকাল বয় আবু জায়েদ রাহি রানের খাতা খেলার আগেই ফেরেন রান আউটের শিকার হয়ে। তার আউটে অভিষেকে ফিফটি করা হলো না আরিফুলের, একপাশ আগলে খেলা ৯৬ বলের ইনিংসটি তিনটি চারে মোড়ানো। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশও থামে ১৪৩ রানে। সর্বশেষ ৭ টেস্টে মাত্র একবার প্রথম ইনিংসে দেড়শ পেরিয়েছিল বাংলাদেশ। লজ্জার সেই রেকর্ড বজায় থাকলো সিলেটের অভিষেক টেস্টেও।

প্রথম ইনিংসের সঙ্গে আর মাত্র এক রান যোগ করতেই শেষ হয় দিনের খেলা। প্রথম ইনিংসে শেষ ওভারে পর পর দুই উইকেট নেয়া তাইজুলের হ্যাটট্রিক সম্ভাবনা থাকলেও সেটি হতে দেননি অভিজ্ঞ হ্যামিল্টন মাসাকাদজা। আগের দিন ২ ওভার শেষে খেলা জিম্বাবুয়ের ঝুলিতে ১৪০ রানের লিড, হাতে ১০ উইকেট নিয়ে আজ তৃতীয় দিনের খেলা শুরু করে জিম্বাবুয়ে।

মূলত তেন্ডাই চাতারার গতির কাছেই পরাস্ত হয় বাংলাদেশ। এই মিডিয়াম পেসার একাই নেন তিন উইকেট, সিকান্দার রাজও নিয়েছেন ৩ উইকেট। দুটি শিকার কাইল জারভিসের, বাকিটি সিন উইলিয়ামসের। লাঞ্চ থেকে ফিরেই একে একে ফিরে যান লিটন দাস (৯), ইমরুল কায়েস (৫), নাজমুল হোসেন শান্ত (৫) এবং অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (০)।মুশফিক-মুমিনুলে এই বিপর্যয় মেরামতের একটা চেষ্টা করেছিলেন তবে অনেকদিন পর টেস্ট খেলতে নামা মুমিনুলের (১১) বিদায়ে সেটি আরো বাড়ে। সেই শঙ্কট আরো চরমে পৌঁছে মুশফিকের বিদায়ে। ৫টি চারে ৩১ রান করা এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে চাকাভার ক্যাচে পরিণত করেন জারভিস।

অভিজ্ঞদের আসা যাওয়ার এই মিছিলের স্রোতে কিছুটা বাধ দেয়ার চেষ্টায় থাকা মিরাজকে নিজের বলেই তালুবন্দী করেন সিন উইলিয়ামস। তার ৩৩ বলে ২১ রানের ইনিংসটি ৩টি চারে সাজানো। একটু পরেই জোড়া আঘাত হানেন সিকান্দার। তাইজুল (৮) ও অপুকে (৪) এই স্পিনার ফেরান ১২ রানের ব্যবধানে।

আগের দিন বাংলাদেশের অষ্টম টেস্ট ভেন্যু হিসেবে যাত্রা শুরু করে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। ঐতিহাসিক এই টেস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টস হেরে ফিল্ডিংয়ে নামার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। গতকাল শনিবার সিরিজের প্রথম টেস্টটি অজ্ঞাত কারণে সাড়ে ৯টার পরিবর্তে আধ ঘন্টা পিছিয়ে শুরু হয় সকাল ১০ টায়।

দেনা পাওনার হিসেব মিটিয়ে বলতে গেলে লড়াইটা হয়েছে সমানে সমানে। প্রথম দিন জিম্বাবুয়ের ৫ উইকেট ফেলতে পেরেছিলো বাংলাদেশ। মাসাকাদজার দলও ইঙ্গিত দিয়েছিলো বড় সংগ্রহের। ৯১ ওভার শেষে সফরকারীদের সংগ্রহ ছিল ২৩৬। তবে সেটিকে খুব একটা আশাজাগানিয়া সংগ্রহে নিয়ে যেতে পারেন নি পিটার মুর, রেগিস চাকাভারা।

মাটি কামড়ানো ২৭৩ মিনিট লড়াই করেও মুর অপরাজিত ছিলেন ৬৩ রানে। কোন ছক্কার পথে না হাঁটা তার ১৯২ বলের ইনিংসটি ৬টি চারে সাজানো। আর আগের দিনের অপরাজিত আরেক ব্যাটসম্যান চাকাভাকে ২৮ রানে ফিরিয়ে শুরু তাইজুলের দ্বিতীয় দিন। 

এরপর একে একে তার শিকারে পরিণত হয়েছেন ওয়েলিংটন মাসাকাদজা (৪), কাইল জারভিস (৪) ও তেন্ডাই চাতারা (২)। অভিষেকেই দুই উইকেট তুলে নিয়েছেন আরকে স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপু। একটি করে শিকার অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও লোকাল বয় আবু জায়েদ রাহির।

প্রথম দিন

ঐতিহাসিক এই টেস্টের প্রথম উইকেটটি নিয়েছেন স্পিনার তাইজুল ইসলাম। জিম্বাবুয়ের দলীয় ৩৫ রানে ব্রায়ান চারিকে (১৩) সরাসরি বোল্ড করেন এই ঘূর্ণির জাদুকর। প্রথম পানি পান থেকে ফিরেই দ্বিতীয় আঘাতটিও হানেন এই বাঁ-হাতি স্পিনার। এবার তার শিকার ব্রান্ডন টেলর (৬)। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার এই টপ অর্ডার ফেরেন শর্ট লেগে দাঁড়ানো নাজমুল হোসেন শান্তর হাতে ধরা পড়ে।

অনেকটা নীচু হয়ে আসা বলটি ঠিকমত তালুতে পুড়তে পেরেছিলেন কি না সেটি জানতে অবশ্য টিভি আম্পায়ারের সহায়তা নিতে হয়েছে দুই ফিল্ড আম্পায়ার কেটলবরো এবং রড টাকারের। তবে শেষ হাসি উঠেছে বাংলাদেশ ফিল্ডারদের মুখেই।

টানা দুই উইকেট হারিয়ে কিছুটা রক্ষণাত্নক খেলতে শুরু করে জিম্বাবুয়ে। মাঝ বিরতি পর্যন্ত আর কোন অঘটন ছাড়াই পার করে সফরকারীরা। তবে লাঞ্চ থেকে ফিরেই জিম্বাবুয়ের শিবিরে আঘাত হানেন ‘লোকাল বয়’ আবু জায়েদ রাহি। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে এলবির ফাঁদে ফেলেন এই পেসার।

তার আগে ৩৭ টেস্টে নিজের ৮ম ফিফটি তুলে নিয়েছেন অভিজ্ঞ এই ওপেনার। ১০৫ বলে তার ৫২ রানের ইনিংসটি ৪টি চার ও ২টি ছক্কায় মোড়ানো।

এই আনন্দের ঢেউ থামতে না থামতেই বিষাক্ত ছোবলে সফরকারীদের বিপদের ভরসা সিকান্দার রাজাকে ফেরান নাজমুল ইসলাম অপু। তার ঘূর্ণিপাক বুঝতে না পেরে সরাসরি বোল্ড হয়ে ফেরেন বাংলাদেশের গলার কাঁটায় পরিণত হওয়া এই মিডল অর্ডার। তার আগে খেলে যান ১৯ রানের এক ইনিংস।

অনেক ক্ষণ এক পাশ আগলে রাখা বিপদজনক হয়ে ওঠা সিন উইলিয়ামসকে ফেরান মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তবে অধিনায়কের বলের চাইতে দারুণ এক ক্যাচ নিয়ে এই শিকারের হকদার অবশ্যই মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রথম স্লিপে দাঁড়িয়ে দারুণ দক্ষতায় তালুবন্দী করেছেন ক্যাচটি। তবে তার ৮৮ রানের ঝলমলে এক ইনিংসে এরই মধ্যে প্রথম ইনিংসে লড়াইয়ের পুঁজি গড়ে নেয় সফরকারীরা। সেঞ্চুরি থেকে ১২ রান আগে ফেরার সময় ১৭৩ বলের ইনিংসটির পাশে জ্বলজ্বলে ৯টি চারের মার।

শনিবার সকালে অভিজাত ক্রিকেটের ঐতিহ্য মেনে ইংল্যান্ডের লর্ডস এবং ভারতের ইডেনের পর সিলেটেও বসানো হয়েছে ‘দ্য ফাইভ মিনিট বেল’। ম্যাচ শুরুর ৫ মিনিট আগে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম অধিনায়ক আকরাম খানের হাত দিয়ে এই বেল বাজিয়ে যাত্রা শুরু হয় সিলেট ভেন্যুর। সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ঐ টেস্ট দলের গর্বিত সদস্য পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত। তার অাগে বিশেষ মুদ্রা নিক্ষেপে হয় টেস্টের টস।

ঐতিহাসিক এই টেস্ট দিয়ে সিলেটের সঙ্গে অভিষেক হয়েছে বাংলাদেশের দু’জনের। স্পিন অলরাউন্ডার নামজুল ইসলাম অপুর সঙ্গে প্রথমবারের মত টেস্ট ক্যাপ মাথায় উঠেছে পেস অলরাউন্ডার আরিফুল হকের।

তিন স্পিনার ও এক পেসার নিয়ে খেলতে নেমেছে মাহমুদউল্লার দল। এই টেস্ট দিয়েই প্রায় ৯ মাস পর সাদা পোষাকের ক্রিকেটে ফিরেছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। গত বছরের ২০ জানুয়ারি মিডল অর্ডার এই ব্যাটসম্যান তার একমাত্র টেস্টটি খেলেছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রাইস্টচার্চে।

বাংলাদেশ একাদশ : লিটন দাস, ইমরুল কায়েস, নাজমুল হোসেন শান্ত, মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ (অধিনায়ক), আরিফুল হক, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাইজুল ইসলাম, নাজমুল ইসলাম অপু ও আবু জায়েদ রাহি।

তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়া জিম্বাবুয়ে দল জয়ের ধারা ফিরতে জিম্বাবুয়ে দলেও হয়েছে দু’জনের অভিষেক। প্রথমবারের মত দলটির হয়ে টেস্ট ক্যাপ মাথায় উঠেছে ডান হাতি স্পিন অলরাউন্ডার ব্রেন্ডন মাভুতা এবং অধিনায়কের আরেক ভাই ওয়েলিংটন মাসাকাদজা। এই নিয়ে দলটির হয়ে দেশেকে এই পরিবার থেকে নেতৃত্ব দিলেন তিনজন। অপরজন পেসার সিঙ্গি মাসাকাদজা।

জিম্বাবুয়ে একাদশ : হ্যামিল্টন মাসাকাদজা (অধিনায়ক), ব্রায়ান চারি, ক্রেইগ অরভিন, ব্রেন্ডন টেলর, সিন উইলিয়ামস, সিকান্দার রাজা, পিটার মুর, রেগিস চাকাভা, ব্রেন্ডন মাভুতা, ওয়েলিংটন মাসাকাদজা, কাইল জারভিস ও তেন্ডাই চাতারা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ