Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফেসবুকে অবৈধ সিগারেটের রমরমা বাণিজ্য

বড় রাজস্ব ক্ষতিতে সরকার

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৩১ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ আসে তামাক শিল্প থেকে। মোট রাজস্ব আয়ের অন্তত ১০ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং ব্যবহার কমাতে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে সম্পূর্ণ তামাকমুক্ত করতে গত কয়েক বছর ধরে সিগারেটের দাম বাড়াচ্ছে সরকার। মূল্য বাড়ায় একদিকে যেমন ধূমপানে অনুৎসাহী হয় অন্যদিকে বেশি দামের সিগারেট থেকে রাজস্বও বেশি আদায় হচ্ছে। কিন্তু বাড়তি দামের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে নকল সিগারেট উৎপাদন করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে নতুন মাধ্যম হিসেবে ফেসবুককে ব্যবহার করছে। নকল সিগারেটে বাজার ছেয়ে যাওযায় এ খাত থেকে সরকার বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া সিগারেট ও বিদেশ থেকে অবৈধপথে আসা চোরাচালান করা সিগারেট বাণিজ্য বন্ধে বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, সীমান্তবর্তী জেলা প্রশাসনসহ সব জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দিতে গত ২২ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ডিও লেটার (আধা-সরকারি চিঠি) দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক শ্রেণির অবৈধ কারবারি দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে নকল ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে কম দামের সিগারেট বাজারে সরবরাহ করছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে এ ধরনের অবৈধ সিগারেটের বাজার কয়েক হাজার কোটি টাকার মতো। যেখান থেকে সরকার কোনো রাজস্বই পাচ্ছে না।
এদিকে অবৈধ সিগারেট বিক্রিতে নতুন কৌশল গ্রহণ করছে একটি চক্র। তারা ফেসবুকে পেইজ খুলে নামি-দামী ব্রান্ডের বিভিন্ন সিগারেটকে নকল করে কম মূল্যে বাজারজাত করছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, জয় সাহেদ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে- পাইকারি লাগবে, সেনর গোল্ড, কিনতে চাই। আর নাসির গোল্ড, সেনর গোল্ড, সিটি ব্লাক এবং ব্লাক সিগারেটের ছবি দেয়া হয়েছে। অপরদিকে সোনালী দিন বিজনেস, অল্প পুঁজির ব্যবসা এবং ব্যবসায়িক কথাবার্তা পেজ থেকে কারো লাগলে জানাবেন লিখে পোষ্ট করা হয়েছে জিরা, ব্লাক, শহিদ, সেনর গোল্ড, ডিরোডি, উইলসন, শাহারা এবং জাভা ব্লাক সিগারেটের ছবি দেয়া হয়েছে।
এছাড়া এলএলবি নাজমুল বেপারী অল্প পুঁজির ব্যবসা, ব্যবসায়িক কথাবার্তা পেজ থেকে ব্যবসার জন্য মশার কয়েল ও চা পাতা বিক্রির কথা বলে লিখেছে সিগারেট ১০ থেকে ১৫ টাকা (প্রতি প্যাকেট। ১ প্যাকেটে ১০টি সিগারেট) এই রেটে কে কে দিতে পারবেন, মেসেজে জানান- রেগুলার প্রোডাক্ট নেয়া হবে। এদিকে ফ্যাবিয়ান হোসেন আলভিন সেল বাজার/এক্সচেঞ্জ বাজার (ফেসবুক ভার্সন) ইসি লাইট ফ্রি। ইসি-লাইট কোরিয়া থেকে আনা সিগারেট গুলা ১৫ বক্স আছে। প্রতি বক্সে ১০ প্যাকেট করে লিখে ইসি লাইট সিগারেটের ছবি পোষ্ট করা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী, নিম্নস্তরের সিগারেটের মূল্য (প্রতি ১০ শলাকার প্যাকেট) ৩৫ টাকা। প্যাকেটের মূল্য বৃদ্ধির ফলে নিম্নস্তরের সিগারেটের প্রতি শলাকার মূল্য এখন ৪ টাকা। কিন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে মাত্র এক থেকে দেড় টাকায়। সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে কিছু উৎপাদনকারী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সিগারেটের প্যাকেটে নকল অথবা পুনঃব্যবহৃত ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে প্রতি প্যাকেট সিগারেট বিক্রি করছে ১০-১৫ টাকায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিগারেটের ব্রান্ডকে উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন-এই তিন মূল্যস্তরে ভাগ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সিগারেট থেকে কর আদায় করে থাকে। এই তিন মূল্যস্তরের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ধূমপায়ী কম মূল্যের অর্থাৎ নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তা। সরকার এই নিম্নস্তরের সিগারেটের মূল্য থেকে প্রায় ৭১ শতাংশ (সম্পূরক শুল্ক ৫৫ শতাংশ + মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ + হেলথ সারচার্জ ১ শতাংশ) রাজস্ব আয় করে থাকে। এ হিসাবে সরকার ৩৫ টাকা মূল্যের প্রতি প্যাকেট সিগারেট থেকে প্রায় ২৫ টাকা রাজস্ব আয় করে। এই অর্থ সংগ্রহ সঠিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে বাজারজাত করার আগেই সিগারেট প্যাকেটের গায়ে সরকারের সরবরাহকৃত ব্যান্ডরোল সংযুক্ত করতে হয়। রাজস্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি ধূমপান থেকে মানুষকে নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে নির্ধারিত মূল্যের কমে বাজারে সিগারেট বিক্রি করাও আইনত অপরাধ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘ট্যাক্স স্ট্যাম্প পুনঃব্যবহার করা ও নকলভাবে উৎপাদন করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।’
চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী যেখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপস্থিতি কম সেখানে এই সিগারেটের প্রসার বেশি। সরকারকে কোনো রাজস্ব দেওয়া হয় না বলে এই সিগারেটে বিক্রেতারাও লাভ বেশি পায়। বাজার ঘুরে দেখা যায়, অধিক মুনাফার লোভে বিক্রেতারা ক্রেতাদের এসব সিগারেট ক্রয়ে আকৃষ্ট করে। যদিও কখনও কখনও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করে, তখন কিছুদিনের জন্য এসব অবৈধ সিগারেট বিক্রি বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি বুঝে উৎপাদনকারীরা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং দোকানিদের জরিমানার টাকার সমপরিমাণ সিগারেট বিনামূল্যে সরবরাহ করে। ফলে বিক্রেতা আবার নতুন উদ্যমে এ ধরনের সিগারেট বিক্রিতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়া এসব অবৈধ ব্র্যান্ডের সিগারেটের মধ্যে অন্যতম হলো- শাহারা, দেশ ব্ল্যাক, টপি টেন, ফ্রেশ গোল্ড, সেনর গোল্ড, সেনর গোল্ড পিউর, সেনর গোল্ড ক্ল্যাসিক, সেনর গোল্ড নং ১, সেনর গোল্ড এসআর, সুপার সেনর গোল্ড ইত্যাদি। দেশের একেক অঞ্চলে একেক ব্র্যান্ডের প্রসার বেশি। শুধু সেনর গোল্ড নামেই বাজারে রয়েছে পাঁচ ধরনের সিগারেট। কিন্তু এই ব্র্যান্ডের বৈধ মালিকানা কোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের তা এনবিআর থেকেও জানা যায়নি।
অবৈধ ও চোরাচালানকৃত সিগারেটের বিক্রেতারা সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিকে বাঁধাগ্রস্ত করছে বলে উল্লেখ করেছেন তামাক বিরোধী সংগঠন মানবিক-এর কারিগরিক পরামর্শক রফিকুল ইসলাম মিলন।#



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফেসবুক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ